যেকোনো প্রকার তর্ক-বিতর্কের সময় পারস্পরিক যুক্তি বিনিময় করতে গিয়ে আমরা সবসময়ই নতুন কিছু জিনিস শিখি কিংবা যার সাথে আমরা যুক্তি বিনিময় করছি, তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে থাকি। আপনারা খেয়াল করে থাকবেন, তর্ক-বিতর্কের সময় সবার মধ্যেই একটি প্রবণতা থাকে, যে করেই হোক নিজের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য উপযুক্ত যুক্তি দেওয়া এবং সে যুক্তির পক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা। এটা করতে গিয়ে কেউই ‘শতভাগ’ নিরপেক্ষ থাকতে পারে না; অতি সামান্য মাত্রায় হলেও অসততার বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। কাজটা হতে পারে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা খানিকটা নিজের অজ্ঞাতসারেই। তবে নিজের অজান্তে হলেও, সেটা ধরতে পারা খুব কঠিন কিছু নয়।
অথবা ভিন্ন আরেকটা পরিস্থিতির কথা ভাবুন; ধরে নিন, আপনি ‘একনায়কতন্ত্রে’ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং মনে করেন, একনায়কতন্ত্রই একটি রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে। তাহলে আপনি শুধু এর হাতে গোনা ভালো কয়েকটা দিকই দেখতে পাবেন, যেমন: দ্রুত কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, অবকাঠামোগত উন্নতি, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদি। তবে এক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্রের অসংখ্য খারাপ দিক, যেমন- মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবিধানিক অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা, নির্যাতন, ভিন্নমত দমনসহ আরও হাজারটা ত্রুটি আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে আপনি আপনার এই বিশ্বাসকে নিজের কাছেই ‘ভালো’ এবং ‘সঠিক’ বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবেন। আর এটা করতে গিয়ে নিজের বিচার-বুদ্ধির সাথেই আপনি ছলনা করবেন।
এই যে একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রবণতা, এটা মানুষের সুষ্ঠু চিন্তাধারার ক্ষেত্রে খুব বড় এক অন্তরায় এবং দীর্ঘমেয়াদে কোনো মানুষের নিরপেক্ষ মত প্রদানের বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করে। এ প্রবণতার নাম ‘কনফার্মেশন বায়াস’। এ সমস্যাটি নিয়েই আজকের লেখা।
কনফার্মেশন বায়াস কী
‘কনফার্মেশন বায়াস’ নামক প্রবণতাটি মানুষের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ একটি প্রবণতা। একজন মানুষ যখন কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ বা মতধারা কিংবা নির্দিষ্ট কোনোকিছুতে বিশ্বাস করে থাকে, তখন তার মধ্যে একটা তাড়না কাজ করে সেই মতবাদ বা বিশ্বাসের স্বপক্ষে প্রমাণ যোগাড় করার। এক্ষেত্রে, যেসব প্রমাণ বা নিদর্শন তার মতবাদ বা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, তা যত শক্তিশালী বা স্পষ্টই হোক না কেন, মানুষটি সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা সেটিকে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করে থাকে, এবং তার বিশ্বাস বা মতবাদের অনুকূলে থাকা প্রমাণ বা নিদর্শন, তা যত দুর্বলই হোক না কেন, সেগুলোকে সে গুরুত্বসহকারে নিয়ে তার বিশ্বাস বা মতবাদকে আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে থাকে। এই প্রবণতাটিই হলো ‘কনফার্মেশন বায়াস’।
সংক্ষেপে, “আপনি যা দেখতে চান বা আপনার মন যা দেখলে আরাম পাবে, আপনি তা-ই দেখতে পাবেন। যা দেখলে আপনার মন অস্বস্তিতে ভুগবে, সেটা আপনি এড়িয়ে যেতে চাইবেন বা দেখেও না দেখান ভান করবেন।” – এটাই কনফার্মেশন বায়াস।
কনফার্মেশন বায়াসকে বাংলায় ‘পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিতকরণ’ এর প্রবণতা বলা যেতে পারে। এখানে, আপনি যা বিশ্বাস করেন, সেটিকেই আরো নিশ্চিত করতে চান বোঝানো হয়েছে। শুনতে অবাক লাগলেও, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যিনি ‘কনফার্মেশন বায়াস’কে পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে পারেন। আপনি যদি ‘কনফার্মেশন বায়াস’ সম্পর্কে জেনেও থাকেন, তবুও আপনি তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। খুব সামান্য মাত্রায় হলেও আপনার মধ্যে কোনো না কোনো বিষয়ে কনফার্মেশন বায়াস অবশ্যই রয়েছে, এবং একটু গভীরভাবে ভেবে দেখলেই আপনি তা বের করে ফেলতে পারবেন।
কেন ও কীভাবে মানুষের মধ্যে পক্ষপাতদুষ্টতা গড়ে উঠে
কী কী কারণে মানুষের মধ্যে কনফার্মেশন বায়াস তৈরি হয় সে কারণগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারি। তবে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কীভাবে এ জিনিসটা প্রোথিত হয়ে যায়, সেটা নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য।
মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার আশেপাশের জগত সম্পর্কে যতটুকু জানে বা দেখে, সেই অনুসারে তার বিশ্বাস বা মতবাদ গঠিত হয়। আবার যে মতবাদ বা বিশ্বাসটা তার মধ্যে গঠিত হলো, সেটা আবার তার আশেপাশের জগতকে পর্যবেক্ষণ করা ও জগত সম্পর্কে জানার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এটা এমন এক চক্র, যে চক্র ভেঙে বের হয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। মানুষের জৈবিক ও মানসিক সত্ত্বা যেকোনো প্রকার কঠিন কাজকে যথাসম্ভব পরিহার করে চলতে চায়। তাই মানুষ চায় না, তার পুরনো বিশ্বাসকে ভেঙে নতুন করে কোনো বিশ্বাস গঠন করতে। বরং, এতদিন সে যে বিশ্বাসটিকে আঁকড়ে ধরে আছে, সেটিকে সে রক্ষা করার প্রবণতা দেখায়; কারণ নতুন বিশ্বাস বা ধারণা গঠন করার চেয়ে পুরোনো ধারণাকে আঁকড়ে রাখা তুলনামূলকভাবে সহজ ও নিরাপদ। তবে এটি করতে গিয়েই সে কনফার্মেশন বায়াস প্রদর্শন করে।
আবার, মানুষ পরাজিত হতে পছন্দ করে না, সে কিছুতেই চায় না তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হোক, অর্থাৎ সে পরাজিত হোক। এটাও মানুষকে কনফার্মেশন বায়াসের দিকে ধাবিত করে।
আসুন, বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য কাল্পনিক একটি কথোপকথন দেখে নেওয়া যাক। ধরুন, আপনার এক বন্ধু নতুন একটি মোবাইল ফোন কিনতে চাচ্ছে এবং আপনার কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ চাচ্ছে। তবে সে একটি বিশেষ ব্র্যান্ড (‘ক’ ব্র্যান্ড) এর প্রতি অনুরক্ত। আপনাদের কথাবার্তা হতে পারে অনেকটা এরকম:
বন্ধু – কোন ফোনটা কিনলে ভালো হবে?
আপনি – কী কী ফিচার দরকার, সেটা আগে বল।
বন্ধু – পারফর্মেন্স ভালো হতে হবে, মেমোরি বেশি হতে হবে, ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী হতে হবে, লেটেস্ট অপারেটিং সিস্টেম থাকতে হবে, ২০-২৫ হাজার টাকার মধ্যে হতে হবে- মোটামুটি এগুলোই। [তার চাহিদাগুলো খেয়াল করুন]
আপনি – তাহলে ‘এক্স’ ব্র্যান্ডের এই ফোনটা নিয়ে নে, ভালো হবে সবদিক থেকে, তোর বাজেটের মধ্যে এর চেয়ে ভালো পাবি না।
বন্ধু – কিন্তু ‘ক’ ব্র্যান্ডের এই ফোনটা দেখ তো…
আপনি – হুম, মোটামুটি, তবে এর প্রসেসর খুব একটা ভালো না। আমি যতজনকেই এটা ব্যবহার করতে দেখেছি, তাদের সবাই বলেছে এর পারফর্মেন্স সন্তোষজনক না।
বন্ধু – হাজার হাজার ফোনের মাঝে দুয়েকটা তো ব্যতিক্রম হতেই পারে। [এখানে সে ফ্যাক্ট এড়িয়ে যাচ্ছে]
আপনি – তা হতে পারে। কিন্তু আমি যে ফোনটার কথা বললাম, সেটার ইউজার এক্সপেরিয়েন্স বেশ ভালো। তাছাড়া, তুই যেটার কথা বলছিস, সেটার তো মেমোরিও কম।
বন্ধু – কতটুকু আর কম, এই ৩ আর ৪ এ তেমন বিশেষ পার্থক্য নেই। ২/৪ হলে একটা কথা ছিল। [স্পষ্টতই ৩জিবি আর ৪জিবি মেমোরিতে পার্থক্য আছে। কিন্তু বিষয়টাকে সে প্রশমিত করার চেষ্টা করছে]
আপনি – প্রসেসর আর মেমোরি, দুইটার ক্ষমতাই যদি একটু একটু করে কমে যায়, তাহলে তো সামগ্রিক পারফর্মেন্স কমে যাচ্ছে!
বন্ধু – আহামরি কমবে না তো। তাছাড়া, পারফর্মেন্স একটু কম পেলেও এইটার ব্যাটারির ক্যাপাসিটি বেশি। তুই যেটা বললি, সেটার ব্যাটারির ক্যাপাসিটি তো এটার চেয়ে কম (আসলে সামান্য কম)! [দেখুন, সে গায়ের জোরে পারফর্মেন্সের বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার চাহিদাকে নতুন করে সাজিয়ে নিয়েছে শুধুমাত্র ‘ক’ ব্র্যান্ডের প্রতি তার বিশ্বাসটা বজায় রাখার জন্য]
এরকম একটি কথোপকথন অনেক দীর্ঘ হতে পারে, যদি আপনার বন্ধুটি তীব্র কনফার্মেশন বায়াসের শিকার হয়।
কনফার্মেশন বায়াস সবার মধ্যেই কম-বেশি থাকে এবং এর মাত্রা কম হলে সাধারণত সেটা কোনো মানুষের জীবনে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। একজন মানুষ যখন ছোট থেকে বড় হতে থাকে, তখন কীভাবে তার মধ্যে কনফার্মেশন বায়াস তৈরি হয়, সেটা বলা খুব কঠিন। তবে অনুমান করা যায়, একটি শিশুর মনে কীভাবে কৌতূহল তৈরি হয়, কীভাবে তার সেই কৌতূহলগুলো মেটানো হয়, তার আশেপাশে কোন ধরনের মানুষের বসবাস, সে কী ধরনের মানুষের সাথে চলাফেরা করে- এ বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারায় বিভিন্ন মাত্রার কনফার্মেশন বায়াস গড়ে উঠতে পারে। তার পরিবারের সদস্য কিংবা ছোটবেলা থেকেই সে যাদেরকে অনুকরণ করে অভ্যস্ত, তারা যদি প্রবলভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তার মধ্যেও সেটি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তীব্রভাবে কনফার্মেশন বায়াসে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় সকল বিষয়ে নিজের বিশ্বাসকে সত্য ও সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রমাণ খুঁজবে, যেসব প্রমাণ নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করবে এবং যেকোনো সাধারণ বা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কোনো ঘটনাকে একপাক্ষিকভাবে বিশ্লেষণ করে নিজের বিশ্বাসের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে পূর্বের কোনো স্মৃতি মনে করার ক্ষেত্রেও পুরো ঘটনা মনে না করে আংশিকভাবে মনে করবে যেন সে স্মৃতিটা তার বর্তমান বিশ্বাসের সাথে যুতসই হয়। এটা স্পষ্টত নিজের সাথেই প্রতারণা করা।
উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন, আপনার এক বন্ধু আছে, যে বর্তমানে অনেক প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। তার সাথে আপনার বর্তমান সম্পর্ক অনেক ভালো এবং আপনি বিভিন্ন প্রয়োজনে তার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকেন বা তার ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকেন। তবে পূর্বে তার সাথে আপনার সম্পর্ক বেশ খারাপ ছিলো এবং তার সাথে আপনার বেশিরভাগ অতীত-অভিজ্ঞতাই তিক্ত। কিন্তু বর্তমানে আপনার যে বিশ্বাস, অর্থাৎ “ওই বন্ধুটি আপনার খুব কাছের মানুষ”, এটিকে সমুন্নত রাখতে হলে সে বন্ধুটির সাথে আপনার গভীর সখ্যতা প্রমাণ করতে হবে, আর সেটি প্রমাণ করতে হলে আপনার সাথে তার অতীতের ভালো স্মৃতিগুলো বের করে আনতে হবে। এক্ষেত্রে, অতীতে তার সাথে ঘটে যাওয়া সামান্য কিছু ভালো স্মৃতির কথাই আপনার মনে পড়বে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার সাথে যেসব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সে স্মৃতিগুলোকে আপনার মস্তিষ্ক পাশ কাটিয়ে যেতে চাইবে। যদি সেগুলো মনে পড়ে যায়ও, সেক্ষেত্রেও আপনার মস্তিষ্ক সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোর ইতিবাচক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সচেষ্ট হবে, যদিও অতীতে ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে সেরকম ছিল না।
আমাদের জীবনে কনফার্মেশন বায়াসের প্রভাব
মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ক্যারিয়ার জীবনে কনফার্মেশন বায়াসের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
কেউ যখন আপনাকে প্রথমবার দেখে আপনার বিষয়ে কোনো একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, অর্থাৎ প্রথম দেখাতেই তার মনে আপনার সম্পর্কে যে ধারণাটা তৈরি হয়, সে ধারণা পরিবর্তন করাটা অত্যন্ত কঠিন একটা ব্যাপার। ধরুন, আপনি প্রকৃতপক্ষে একজন ‘এক্সট্রোভার্ট’ এবং আপনি নতুন কারও সাথে পরিচিত হতে গেছেন। এ অবস্থায় আপনি যদি ভদ্রতা বজায় রাখতে গিয়ে তাদের সাথে শান্তভাবে এবং খুব কম কথা বলেন, আপনার আচরণে খানিকটা লজ্জা প্রকাশ পায়, তাহলে তারা ধরেই নিবে আপনি একজন ‘ইনট্রোভার্ট’। পরবর্তীতে আপনি তাদের সামনে যতোই এক্সট্রোভার্টের মতো আচরণ করেন না কেন, তারা তাতে অবাক হবে, কিন্তু সহজে আপনাকে এক্সট্রোভার্ট হিসেবে মানতে চাইবে না।
আবার ধরুন, আপনার এক বন্ধু গাঁজার নেশায় আসক্ত। সবাই এটা জানে এবং তাকে সাবধান করে এ বিষয়ে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসকেরা এর কিছু উপাদানকে কয়েক ধরনের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এ অবস্থায় আপনার বন্ধুটি যদি এরকম একটি উদাহরণ দেখিয়ে দাবি করে, “দেখো, গাঁজা খারাপ কিছু না; বরং উপকারি!”, তাহলে বুঝতে হবে সে গাঁজার নেশার পাশাপাশি তীব্র কনফার্মেশন বায়াসেও আক্রান্ত। কেননা, পুরোপুরিভাবে জানার চেষ্টা করলে সে হয়তো জানতে পারতো, সরাসরি গাঁজা সেবন করা আর সেটাকে চিকিৎসার কাজে লাগানো ভিন্ন ব্যাপার এবং একে নেশার সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা কতটা ক্ষতিকর। সাপের বিষকে ওষুধ তৈরির কাজে লাগানো হয় বলে ইচ্ছা করে সাপের কামড় খেতে যাওয়া যে বুদ্ধিমানের কাজ নয়- সেটা হয়তো তাকে কিছুতেই বোঝানো সম্ভব হবে না।
কিছু মানুষ তর্কে জেতার জন্য স্পষ্টভাবেই তীব্র কনফার্মেশন বায়াস প্রদর্শন করে থাকেন। তাদেরকে বেশিরভাগ মানুষই মন থেকে সম্মান করতে পারে না এবং এ ধরনের মানুষরাই সাধারণত ‘চাপাবাজ’ বলে সমাজে পরিচিতি পান। এটা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর।
আবার কনফার্মেশন বায়াসের কারণে আপনি যে শুধু মানুষের সম্মানই হারাচ্ছেন তা নয়, বরং নিজেকে ঠকাচ্ছেন। তীব্র কনফার্মেশন বায়াসের কারণে আপনি খুব সম্ভবত জেনেশুনেও আপনার ভুল ধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, এর ভুল দিকগুলো দেখেও না দেখার ভান করছেন। এবং এ ভুল ধারণাটিই হয়তো সামগ্রিকভাবে আপনাকে সংজ্ঞায়িত করছে।
কুসংস্কারের ক্ষেত্রে কনফার্মেশন বায়াস সবচেয়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কেউ হাঁচি দিলে সেটা মঙ্গলজনক নয়। এখন, আপনি অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সপ্তাহের প্রথম ছয়দিন কেউ যদি হাঁচি দিয়ে থাকে এবং এ দিনগুলোতে যদি কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে থাকে, তাহলে আপনি এ ছয়দিনের কথা একদমই মনে রাখবেন না। কিন্তু সপ্তমদিন আপনি কোনো কারণে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কেউ যদি হাঁচি দেয়, এবং সেদিন যদি কোনো ছোটখাট দুর্ঘটনাও ঘটে ,তাহলে সে ঘটনা আপনি খুব গুরুত্বসহকারে মনে রাখবেন এবং হয়তো কয়েক বছর পরও এই গল্প মানুষের কাছে বলে বেড়াবেন। এভাবে কুসংস্কার আপনার চিন্তাধারায় কনফার্মেশন বায়াস আরোপ করছে এবং এটা কুসংস্কারের প্রতি আপনার বিশ্বাসকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
আবার পরিবার, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কারও প্রতি যদি আপনার মনে সন্দেহ কাজ করে থাকে, তাহলে কনফার্মেশন বায়াসের জন্য আপনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার আচরণকে নেতিবাচকভাবে নেবেন; এমনকি সাধারণ বা ইতিবাচক আচরণকেও। এভাবে আপনাদের সম্পর্ক নিশ্চিতভাবেই আরও খারাপের দিকে যাবে।
বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই এই কনফার্মেশন বায়াসের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। তারা হয়তো নতুন কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে, পূর্বেই যদি এই ব্যবসাটি সম্পর্কে তাদের মনে ইতিবাচক ধারণা জন্মে থাকে, তাহলে যতই জরিপ, সম্ভাবনা, রিস্ক ও অন্যান্য খুঁটিনাটি তাদেরকে দেখানো হোক না কেন, তারা শুধু ভালো সম্ভাবনাগুলোকেই প্রাধান্য দেবেন এবং শেষপর্যন্ত বিনিয়োগ করবেন। কারণ, ঐ যে বলা হলো, পূর্বের বিশ্বাস।
কনফার্মেশন বায়াসের সবচেয়ে বাজে নিদর্শন সম্ভবত বিভিন্ন পরিসংখ্যানিক জরিপ। যেকোনো বিষয় সম্পর্কে গাণিতিকভাবে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিসংখ্যানিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটা বিষয় হতে পারে। তবে এই পরিসংখ্যানকে অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়। এমনকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনোকিছু প্রমাণ করার জন্যও অনেকে পরিসংখ্যানের অপব্যবহার করে থাকে। যেমন- কোনো জরিপ করার সময় যদি জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আপনি কি সেই প্রতিষ্ঠানটির উপর সন্তুষ্ট?” তাহলে, খুব সম্ভবত তারা ইতিবাচক উত্তর দেবে। কিন্তু প্রশ্নটি যদি এভাবে করা হয়, “আপনি কি প্রতিষ্ঠানটির উপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট?” তাহলে নেতিবাচক উত্তর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ, এখানে প্রশ্নের ধরন অনুসারে আপনি জরিপের ফল কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পারবেন।
আবার মনে করুন, একটা অঞ্চলে ১,০০০ জন মানুষ বসবাস করে, এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৮০০ জনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু এ নিয়ে জরিপ করার সময় ১,০০০ জনের কাছেই তো আর যাওয়া সম্ভব না, তাই আপনি কিছু মানুষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবেন। এখন আপনি যদি মাত্র ১০ জনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন, এবং এই ১০ জনের মাঝে ৮ জনই অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জরিপের ফল দাঁড়াবে এমন- “জরিপে দেখা গেছে অমুক অঞ্চলের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই স্বচ্ছল”; যদিও প্রকৃত চিত্রটা ঠিক তার বিপরীত। এ ধরনের কাজ মাঝেমধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয় বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। আবার অনেক সময় পরিসংখ্যানের বিস্তারিত তথ্য না দিয়ে আংশিক তথ্য দিয়েও প্রকৃত সত্যটাকে আড়াল করা হয়। এরকম আরও অনেক উপায় আছে পরিসংখ্যানকে একতরফাভাবে ব্যবহার করার। এ সবই কনফার্মেশন বায়াস।
বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াতেও কনফার্মেশন বায়াস গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়। কোনো বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গিয়ে গবেষকেরা মাঝেমধ্যে এ ধরনের বায়াসের শিকার হতে পারেন। তারা গবেষণা শুরু করার পূর্বেই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞান থেকে সে বিষয়টা সম্পর্কে মনে মনে একটা খসড়া ধারণা তৈরি করে রাখেন। সেই ধারণা তাদের গবেষণার প্রক্রিয়া ও ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে; তিনি যেভাবেই হোক, তার প্রাথমিক ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন।। সেজন্য যেকোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রক্রিয়া ও ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর সেটি সমপর্যায়ের অন্য গবেষকদের দ্বারা যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে যাচাই করার প্রয়োজন পড়ে। আবার অপবিজ্ঞান বা সিউডোসায়েন্সে কনফার্মেশন বায়াস সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়; একতরফা যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপন করে ভুল বা অনিশ্চিত কোনো বিষয়কেও বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। অনেকেই আছেন, যারা একতরফাভাবে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরোধিতা করে থাকেন, সে তত্ত্বের মধ্যে থাকা অসংগতি ও ত্রুটিগুলোকে বারবার সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু সে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দ্বারা যে অনেককিছুই সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, এ বিষয়টি অত্যন্ত সুকৌশলে তারা এড়িয়ে যান বা জোরপূর্বক অস্বীকার করতে চান। কেননা, সে তত্ত্বটি হয়তো তাদের কোনো ধারণা বা বিশ্বাসের সাথে অসংগতিপূর্ণ।
কনফার্মেশন বায়াস থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়
যেহেতু কনফার্মেশন বায়াস আমাদেরকে একতরফা চিন্তার দিকে ধাবিত করে, তাই এটি আমাদেরকে সঠিক ও শুদ্ধভাবে কোনো জ্ঞান অর্জন করতে কিংবা নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না। আপনার মধ্যে যদি কনফার্মেশন বায়াস অধিক মাত্রায় থেকে থাকে, তাহলে কিছু লক্ষণের মাধ্যমে সেটা ফুটে উঠবে-
- আপনি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট চিন্তাধারার কিছু মানুষের সাথে চলাফেরা করবেন। আপনার সাথে মতের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, এমন মানুষের সাথেও আপনাকে তেমন একটা চলাফেরা করতে দেখা যাবে না।
- আপনি যে ধারণা পোষণ করে অভ্যস্ত, সেটিকে আপনি অত্যন্ত জোরালো ও তীব্রভাবে রক্ষা করতে চান এবং এটি করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ করেন। আপনি মনে করেন, আপনার ধারণাকে কিছুতেই ভুল প্রমাণ করা যাবে না।
- আপনার ধারণার সাথে আবেগ ও ‘ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা’ জড়িত আছে।
- আপনি সর্বদাই আপনার ধারণা বা বিশ্বাসের স্বপক্ষে যুক্তি খোঁজেন, কিন্তু এর বিপক্ষে যায়, এমন যুক্তি খোঁজেন না, আর কোনোভাবে তা পেয়ে গেলেও সেটিকে ঘেঁটে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনাকে কেউ সংগত প্রশ্ন করলে সে প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত কোনো উত্তর না দিয়ে আপনি তাকেই পাল্টা প্রশ্ন করেন কিংবা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আলোচনার বিষয়বস্তুকে আপনার অনুকূল কোনো খাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
একজন মানুষ কনফার্মেশন বায়াস এবং এর থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানলেও তিনি যে এটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত, আমাদের সবার চিন্তাধারার মাঝেই কম-বেশি পক্ষপাতদুষ্টতা রয়েছে। তবে একে কমিয়ে আনা বা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা যায়:
- যেকোনোকিছুকে ‘সত্যিকার অর্থে’ জানার চেষ্টা করুন। নিজে যা জানেন, সেটাকে চূড়ান্ত ধরে নেবেন না এবং শুধুমাত্র সেটার পক্ষেই যায়, এমন প্রমাণ খুঁজবেন না। আপনার জ্ঞান বা ধারণার বিপরীতে ভালো যুক্তি ও প্রমাণ পেলে আপনার ধারণাকে পুনর্গঠন বা প্রয়োজনে পরিবর্তন করে নেওয়ার মানসিকতা রাখুন।
- অন্যের মতামতকে সম্মান করুন। সে মতামতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা ও যাচাই-বাছাই করুন। সহসাই অন্যের মতকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন না।
- কোনো একটা বিষয়ে মাত্র কয়েকজনের কথা বা মতামত শুনে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না; সে বিষয়টা নিয়ে যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক মানুষের মূল্যায়ন দেখুন ও যাচাই করুন।
- আপনার কোনো ধারণা বা বিশ্বাসকে যাচাই করতে চাইলে, সেটিকে ভুল প্রমাণ করার প্রবল চেষ্টা করুন। এটি করতে গিয়ে অনেককিছু জানতে ও শিখতে পারবেন। তবে এ কাজটি করতে হবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে; নিজেই নিজেকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে চলবে না।
- কোনো বিষয়কে যাচাই করার সময় আবেগকে দূরে ঠেলে দিন। যুক্তির দ্বারা যাচাই করুন, আবেগের দ্বারা নয়।
- শর্টকাট অবলম্বন করে বা অতি সংক্ষেপে কোনোকিছু জানার চেষ্টা করবেন না। কিছুটা সময় নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করুন।
- আপনার ধারণা নিয়ে এমন কারও সাথে আলোচনা করুন, যে যুক্তি প্রয়োগ করে আপনার ধারণার বিরোধিতা করতে পারবে। তার যুক্তি বা সমালোচনাগুলোকে আন্তরিকভাবে বোঝার চেষ্টা করুন।
- কোনো একটা বিষয়ে আপনার সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করলে, নিজেকে তার অবস্থানে কল্পনা করে আপনার মতামতকে মূল্যায়ন করুন। আপনার ধারণাকে অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করুন।
- আপনা চিন্তাধারা, মতাদর্শ বা বিশ্বাসের সাথে মেলে- এমন মানুষদের সাথে সর্বদা চলাফেরা না করে মাঝেমধ্যে ভিন্নমতাদর্শের বা ভিন্ন চিন্তার মানুষের সাথে মেলামেশা ও ভাব বিনিময় করুন।
- একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা ধারণা কীভাবে আপনার মধ্যে তৈরি হলো বা গড়ে উঠলো, সেটা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন। যদি সে ধারণাটি আপনি ভুলভাবে গঠন করে থাকেন, তাহলে আপনি সহজেই তা বের করে ফেলতে পারবেন।
কনফার্মেশন বায়াস কাটিয়ে উঠতে পারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় একটি সার্থকতা। আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে যেদিকে চালিত করতে চায়, সে পথটি সবসময় সঠিক না-ও হতে পারে। কনফার্মেশন বায়াস তেমনই একটি নেতিবাচক প্রবণতা। ভেবে দেখুন তো, আপনার চিন্তাধারায় কনফার্মেশন বায়াসের প্রভাব কতটা তীব্র?