সার্জিক্যাল ট্রের উপরে পড়ে রয়েছে একটি মুখ, জীবন্ত এক মানুষের মুখ। শূন্য দুটি চোখের কুঠুরি যেন কিছুই না বলে বলে চলেছে অজস্র ইতিহাস। খোলা ঠোঁট দুটো যেন বলছে, ‘ওহ!’। উনিশ শতকের ডেথ মাস্কের অনুরূপ এই ফেসটি বয়ে চলেছে বিস্ময়কর এক নিঃসঙ্গতার গল্প।
১৬ ঘণ্টার এক জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মুখটিকে খুলে আনা হয়েছে ৩১ বছর বয়সী এক নারীর মুখ থেকে, তিন বছর আগেই যাকে ক্লিনিক্যালি মৃত ঘোষণা করেছিলেন চিকিৎসকরা। মুখটি এখন অপেক্ষা করছে ২১ বছর বয়সী নারীর মুখে আশ্রয় নেয়ার জন্য, তিন বছর ধরে এই একটি মুখ বা চেহারার কারণে যে বলতে গেলে পার্থিব জগত থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন কাটাচ্ছে।
মুখে হাত বুলাতে গিয়ে এখনো অজস্র কাঁটা-ছেঁড়ার দগদগে অনুভূতি ছুঁয়ে যায় কেটি স্টাবলফিল্ডকে। ভয়াবহ আঘাতের কারণে ক্ষীণ হয়ে এসেছে তার দৃষ্টিশক্তি। তবে আঙুলের স্পর্শে এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কীভাবে তাকে নিয়ে লড়েছেন সার্জনরা। হাত দিলে টের পান মুখের কোন অংশ স্ফীত হয়ে কদাকার করে তুলেছিল তাকে। কোন জায়গাটুকু উড়ে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল, মনে করিয়ে দেয় আঙুলের ডগার এবড়ো-থেবড়ো ছোঁয়া।
২১ বছর বয়সী কেটির জীবনটা মোটেও এমন ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সী নাগরিক হিসেবে ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে ইতিহাস গড়েছে সে। গত বছর সংঘটিত হওয়া এই অস্ত্রোপচারের মূল উদ্দেশ্যই ছিল কেটিকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক জীবন দান করা। চিবানো, শ্বাস নেয়া, গলাধঃকরণ করার মতো প্রাত্যহিক এবং অবশ্য করণীয় কাজগুলো অন্তত যেন সে করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই জটিল এবং মারাত্মক অস্ত্রোপচারের কাজে হাত দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। আবেগের আতিশায্যে অষ্টাদশী কেটির নিজ মাথায় গুলি চালিয়ে দেয়ার ফলাফলই ভোগ করতে হচ্ছে কেটি এবং তার পরিবারকে।
ঐতিহাসিক এই সার্জারি সফল হয়েছে। কেটি এখন বুঝতে পেরেছেন আত্মহত্যা কখনোই কোনো সমাধান হতে পারে না। জীবনকে প্রায় হারিয়ে ফেলে তিনি বুঝতে পেরেছেন বেঁচে থাকার মর্ম। তার মতো ভুল যেন আর কেউ না করে সেই বার্তা ছড়ানোই হবে এখন তার মূলমন্ত্র। এ বছরের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের সেপ্টেম্বর ইস্যুর ফিচার কভার হতে যাচ্ছেন তিনি। এই প্রতিবেদনটির নাম তারা দিয়েছে ‘একটি মুখের গল্প’ (দ্য স্টোরি অফ এ ফেস)।
“আমি জীবনে ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টের নামও শুনিনি,” বলছিল কেটি। যে সময় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন একের পর এক আবেগীয় অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছিল তার। ক্রমবর্ধমান গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য টানা বেশ কয়েকবার শল্য চিকিৎসকের ছুরি-কাঁচির ভেতর দিয়ে দিন কাটাতে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কেও সম্মুখীন হন অনাকাঙ্ক্ষিত বিশ্বাসঘাতকতার। ঠিক সেই সময় কেটির মা অ্যালেসিয়ার স্কুলের চাকরিটাও চলে যায়। চাকরিচ্যুত হওয়ার কারণ হিসেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের সিদ্ধান্তের উপর অ্যালেসিয়া অযাচিতভাবে প্রশ্ন তুলেছে। এমন কথা শুনে পুরো পরিবারই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বলে সিএনএনকে দেয়া এক বিবৃতিতে জানান কেটির বাবা রব।
কাজেই একসাথে এতসব সমস্যা মোকাবিলা করার মতো মানসিক শক্তি অষ্টাদশী কেটির ছিল না, আলাদা করে তা বলাই বাহুল্য। ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ আচমকা এক গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় কেটির বড় ভাই রবার্ট স্টাবলফিল্ডের। ছুটে বোনের ঘরের ভেতরে ঢুকে বাথরুম থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রবার্ট। মিসিসিপির সেই বাসা থেকে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় হতভম্ব ভাই।
সেদিনের কথা খুব বেশি মনে নেই কেটির। নিজের চেহারা হারিয়ে ফেলার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াতে হলেও সেদিনের তেমন কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। শুধু সেদিন কেন, সে বছরের কথাই খুব একটা মনে নেই তার। মেম্ফিসের হাসপাতাল থেকে ফেরত দেয়ার পর অক্সফোর্ডের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথাও তেমন কিছু জানে না সে। সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ওহাইওর ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকে। এখানে বছর তিনেক পরে ঘটে তার ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন।
মেম্ফিসে থাকতেই রব আর অ্যালেসিয়ার বাবা-মা প্রথমবার ফেস ট্রানপ্ল্যান্টেশন কথাটির সাথে পরিচিত হন। “অভিজ্ঞ এক ট্রমা সার্জনের মুখে প্রথমবার শুনি এই শব্দটি। ভদ্রলোক কেটিকে দেখে বলেই ফেলেন এমন জঘন্য ক্ষতর সম্মুখীন তিনিও কখনো হননি। কেটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার এখন একটিমাত্র উপায় আছে, সেটা হলো চেহারা বদলে ফেলা,” বলেন রব। “আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, চেহারা বদলে ফেলা আবার কী জিনিস? এ কেমন কথা?” পরবর্তীতে কেটিকে যখন এ বিষয়ে জানানো হয়, সে-ও একই রকম অবাক হয়।
“আমি জীবনে কখনো শুনিনি এমন কোনো প্রযুক্তির কথা,” জানায় কেটি। “বাবা-মা যখন সবকিছু বুঝিয়ে বলে, আমি এককথায় আকাশ থেকে পড়লাম। আবার একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মুখ ফিরে পাবো, আরও একবার নতুন করে বাঁচতে শিখব, সেই স্বপ্নে বিভোর হতে খুব একটা দেরি হলো না।”
ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ক্ষেত্রে সামগ্রিক এবং আংশিক দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। দানকৃত টিস্যু থেকে শুরু করে ত্বক, হাড়, নার্ভ, রক্ত সবকিছু মিলিয়ে একেবারে ব্যক্তির মুখমণ্ডলে সম্পূর্ণ নতুন একটি মুখ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব এ পদ্ধতিতে। কেটির ক্ষেত্রে মাথার তালু, কপাল, চোখের পাপড়ি, অক্ষিকোটর, নাক, থুতনি, চোয়াল, দাঁতের পাটি, ফেসিয়াল নার্ভ, পেশি এবং ত্বক সহ মোটামুটি গোটা মুখটাই বদলে ফেলতে বাধ্য হয় ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনে অংশ নেয়া এক নারীও কেটির মতো বন্দুকের গুলিতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। কনি কাল্প নাম্নী সেই নারী ২২ ঘণ্টার এক জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে নতুন এক মুখের সাহায্যে ফিরে পান নতুন এক জীবন। সেবার অবশ্য আংশিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। সামগ্রিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ইতিহাস ২০১০ সালের, স্পেনের ভ্যাল ডেবর্ন ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অফ বার্সেলোনায় ঘটে অস্ত্রোপচারটি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক সুসান গোল্ডবার্গের ভাষ্যমতে, এখনো অবধি সারা পৃথিবীতে ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৪০টি।
“এ বছরে আমরা যতগুলো ঘটনা তুলে ধরেছি, তার মধ্যে কেটির গল্পটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা বিশ্বাস করি,” জানান তিনি। “কেবল চিকিৎসাশাস্ত্র কিংবা বিজ্ঞানের জয়যাত্রাই নয়, মানব সভ্যতার নির্মমতার সাথে লড়ছে এমন যেকোনো ব্যক্তির জন্য নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সহায়তা করবে। চেহারা নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখনো যে কত মানুষ কত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। যে চেহারাকে আমরা স্রষ্টার অবধারিত উপহার মনে করি, তা বদলে দেয়ার উপায়ও এখন আমাদের হাতে আছে”।
ফেস ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের আগে থ্রিডি প্রিন্টিং পদ্ধতিতে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের চিকিৎসকরা কেটির চোয়ালের নিম্নাংশের ৯০% ক্ষত সারিয়ে ফেলে। কেটির বড় বোন অলিভিয়া ম্যাককের চোয়ালের সিটি স্ক্যান করে, তার সাথে মিল রেখে পুনর্গঠন করা হয় কেটির চোয়াল। প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ড. ব্রায়ান গ্যাটসম্যান বলেন প্রথমবার কেটিকে দেখে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মেয়েটিকে আর বাঁচানো যাবে না। দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী পরিচালিত অস্ত্রোপচার শেষে ৩০ ঘণ্টা আইসিইউতে রাখা হয় কেটিকে। এ সময় তার চোখের পাতা সেলাই করে দেয়া হয় যাতে চোখের ভেতরে কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ঢুকে কেটির দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি না করে ফেলে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এখনো বেশ কিছুদিন তাদের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে কেটিকে। ২০১৬ সালে একটি মুখের প্রতীক্ষায় নাম লিখিয়ে প্রায় ১৪ মাস অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত অ্যাড্রিয়া শিন্ডারের মুখটি পায় কেটি, আর কিছুদিনের পর্যবেক্ষণ তার জন্য এখন আর খুব একটা কষ্টের নয়। অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে মারা যাওয়া অ্যাড্রিয়ার মুখটি নতুন করে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পেল কেটির কল্যাণে। আত্মহত্যার প্রবণতা যেন আর ফিরে না আসে সেই লক্ষ্যে বেশ কয়েক দফা কাউন্সেলিং করানো হয়েছে কেটিকে।
২০১৭ সালের মে মাসের ৪ তারিখে ৩১ ঘণ্টা ব্যাপী এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন ১১ জন সার্জন। “মুখে হাত দিলে স্বর্গীয় এক অনুভূতিতে মন ছেয়ে যায় এখন, বেঁচে থাকাটা যে এত সুন্দর আগে কখনো বুঝিনি”, স্পষ্টভাবে কথা বলতে এখনো কিছুটা সমস্যা হলেও মনের ভাব প্রকাশ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি কেটি। আর কোনো তরুণকে যেন তার মতো এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্তে পুরো পরিবার নিয়ে এভাবে ভুগতে না হয়, সেই প্রত্যাশা করেছে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা মেয়েটি।
ফিচার ইমেজ- nationalgeographic.com