আনাতোলি মস্কোভিন: মমিদের সম্রাট

আনাতোলির ঘরে এসব পুতুল আমরা আগেও দেখেছিলাম। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে এই পুতুলগুলো সত্যিকারের কোনো মানুষের হতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম বড় আকৃতির পুতুল সংগ্রহ করা ছিল তার নেশা। কতজনেরই তো এ ধরনের শখ থাকে। তাই আনাতোলির পুতুল সংগ্রহের বাতিককে আমাদের কাছে কখনোই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।

– আনাতোলি মস্কোভিনের মা

১.

আনাতোলি মস্কোভিন ইতিহাস ভালোবাসতেন। কথা বলতে পারতেন ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল তার প্রবল। রাশিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম শহর নিঝনি নোভগরদের একটি স্থানীয় কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি। এসবের পাশাপাশি আরকটি বিষয় তাকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করত। আর তা হলো কবরস্থান! কবরস্থান সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় ছিল তার নখদর্পনে। এমনকি অন্যের কাছে তিনি নিজেকে ‘কবর বিশারদ’ বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ইতিহাসের শিক্ষক মস্কোভিন তার পারদর্শীতাকে নেতিবাচক দিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। রচনা করেছিলেন মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের। ২০১১ সালে তার শোবার ঘর থেকে ২৯ জন তরুণীর মমি করা লাশ উদ্ধার করা হয়। সবগুলো লাশের বয়স ছিল ৩ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এই ঘটনার পর গ্রেফতার হন মস্কোভিন।  

আনাতোলি মস্কোভিন; Image Source: Daily Express

২.

নিঝনি নোভগরদ শহরে আনাতোলি ছিলেন কবরস্থান সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের, যেমন- কোন কবরস্থানের কোথায় কবর দেয়ার জন্য জায়গা ফাঁকা আছে, মৃতের জন্য কী ধরনের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে ইত্যাদির ওপর একজন নামকরা পণ্ডিত ব্যক্তি। তবে কবরস্থান নিয়ে তার যাবতীয় আগ্রহের শুরুটা হয় একটি ভীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই ঘটনাটি পরবর্তীতে মস্কোভিন একটি স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা “Necrologies”– এ বর্ণনা করেছিলেন।  

তিনি তখন ১৩ বছরের একজন বালক। একদিন স্কুল শেষে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। সেসময় স্থানীয় একটি কবরস্থানে নাতাশা পেত্রোভা নামক ১১ বছর বয়স্ক এক বালিকার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছিল। মস্কোভিন যখন সেই কবরস্থান অতিক্রম করছিলেন তখন সেখান থেকে একদল কালো স্যুট পরা মানুষ বেরিয়ে এসে তাকে নাতাশার কফিনের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে তারা মস্কোভিনকে বাধ্য করে নাতাশার লাশকে চুমু খেতে। এরপর সেখানে কান্নারত নাতাশার মা মস্কোভিনের আঙুলে একটি বিয়ের আংটি পরিয়ে দেয় এবং আরেকটি আংটি পরিয়ে দেয় মৃত নাতাশার আঙুলে। অর্থাৎ নাতাশা পেত্রোভার লাশের সাথে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছিল মস্কোভিনকে!

এই ঘটনার পর তার মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায়। মৃতের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে তার মধ্যে। একসময় এই আগ্রহ পরিণত হয় মুগ্ধতায়, যা পরবর্তী ৩০ বছর ধরে বজায় ছিল এবং তাকে করে তুলেছিল মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ এক মানুষে।

৩.

মৃত লাশকে চুমু খাবার অভিজ্ঞতা বালক মস্কোভিনের মাথায় থেকেই গেল। স্কুল ছুটি হলে তিনি সোজা চলে যেতেন কবরস্থানে। সেখানেই কেটে যেত তার অনেকটা সময়।

পরবর্তীতে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। ১৩টি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে নাম কুড়ান চারদিকে। তার বিভিন্ন লেখা অনেক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখনো মৃতদের প্রতি তার টান যে আগের মতোই ছিল তার প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন সেল্টিক সভ্যতার ওপর উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে, যে সভ্যতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মৃতদের নিয়ে ছিল প্রবল উৎসাহ।

স্থানীয় কবরস্থানগুলোতে প্রায়ই দেখা পাওয়া যেত মস্কোভিনের; Image Source: Express.co.uk

পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে চলছিল শহরের বিভিন্ন কবরস্থান চষে বেড়ানো। তিনি একটি লেখায় নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, “মৃতদের সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো জ্ঞান সম্ভবত এই শহরে আর কারোরই নেই”। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে তিনি নভোগরদ শহরের ৭৫২টি কবরস্থান ঘুরে ফেলেছিলেন। এজন্য তাকে প্রায় প্রতিদিন ২০ মাইলের মতো পায়ে হাঁটতে হতো। কোনো কোনো দিন তো তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন কবরস্থানেই।

বিভিন্ন কবরস্থানে ঘোরার ফলে তার যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছিল তা নিয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় “Great walks around cemeteries” এবং “What the dead said” নামে তিনি দুটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন। সেখান থেকে জানা যায়, তিনি একবার একটি সদ্য দাফনকৃত কফিনের ভিতরে সম্পূর্ণ একটি রাত কাটিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র কবরের মধ্যে মানুষের সময় কীভাবে কাটে তা জানার জন্য!

৪.

২০০৯ সালের দিকে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। নভোগরদ শহরের অনেকেই খেয়াল করলেন কবরস্থানে দাফনকৃত তাদের প্রিয় মানুষটির লাশ কবর থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে! অর্থাৎ কেউ একজন নিয়মিত লাশ চুরি করছে।

পরপর বেশ কয়েকটি একই ধরনের লাশ চুরির ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে পুলিশের। অপরাধীকে ধরতে অভিযানে নামে গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের ধারণা ছিল হয়তো কোনো চরমপন্থী গ্রুপের কাজ হবে এটি। এই ধারণাকে সামনে রেখে রাশিয়ার বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দা রাত-দিন এক করে রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালের পর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না তারা।

শহরের কবরস্থানগুলো থেকে একের পর এক লাশ চুরির ঘটনা ঘটতে থাকে; Image Source: baltimoresun.com 

অবশেষে ২০১১ সালের দিকে গোয়েন্দাদের হাতে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য এসে পৌঁছে। ঐ বছর রাশিয়ার দেমোদেদোভো (Domodedovo) বিমানবন্দরে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। সন্দেহের তীর ছিল মুসলিম চরমপন্থীদের দিকে। এই ঘটনার কিছুদিন পরে নভোগরদ শহরের কিছু কবরস্থানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কবর থেকে লাশ চুরির ঘটনা ঘটতে থাকে।

একদিন গোপন সূত্রের ভিত্তিতে পুলিশের একটি দল শহরের একটি কবরস্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তাদের কাছে তথ্য ছিল সন্দেহজনক এক ব্যক্তি ঐ কবরস্থানে অবস্থান করছে। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন একজন লোক ঐ কবরস্থানে শায়িত বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তির ছবি আঁকছে। সেখানে তার আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করে পুলিশ।

কবরস্থানের ওই ব্যক্তিটি ছিলেন মস্কোভিন। তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আটজন পুলিশের একটি দল যায় তার অ্যাপার্টমেন্টে অনুসন্ধান চালাতে। সেখানে গিয়ে তারা যা দেখলেন তাতে তাদের সবার আক্কেলগুড়ুম হবার যোগাড়!

৫.

৪৫ বছর বয়সী মস্কোভিন একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে তার মা-বাবার সাথে বসবাস করতেন। তার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। একাকিত্ব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। পুলিশ তার অ্যাপার্টমেন্টে হুবহু মানবাকৃতির অনেকগুলো পুতুল খুঁজে পেল।

পুতুলগুলো ছিল অনেকটা অ্যান্টিক ঘরানার। বেশ সুন্দর এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে সজ্জিত ছিল সেগুলো। কোনো কোনো পুতুলের পায়ে ছিল হাঁটুর সমান উঁচু জুতা। বেশিরভাগ পুতুলের মুখই অত্যধিক মেকআপে ঢাকা ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো সেগুলোর একটিও আসলে পুতুল ছিল না। সেগুলো ছিল মমি করা মেয়েদের লাশ!

মস্কোভিনের শোবার ঘরে থাকা একটি মেয়ের মমি; Image Source: dailystar.co.uk

মস্কোভিনের শোবার কক্ষে আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বিভিন্ন কবরস্থানের ম্যাপ, মমি করার নিয়ম-নীতি সম্বলিত প্রচুর বই, বিভিন্ন কবরের ছবি ইত্যাদি। এমনকি মস্কোভিন পুতুলরূপী মেয়েদের লাশগুলোকেও কবর দেয়ার সময় তাদের পরনে যে পোশাক ছিল সেই পোশাকই পরিয়ে রেখেছিল।

প্রতিটি মমির পেটের ভেতর থেকে মিউজিক প্লেয়ার পাওয়া গিয়েছিল। স্পর্শ করলেই যাতে সেগুলো থেকে গান বেজে ওঠে, সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন মস্কোভিন! এছাড়াও কিছু কিছু মমির ভেতর থেকে তাদের জীবিতাবস্থার বিভিন্ন স্মারক চিহ্ন উদ্ধার করা হয়েছিল। অনেকগুলো মমির চোখের কোটরে বোতাম জাতীয় কিছু একটা বসানো ছিল। তারা যেন মস্কোভিনের সাথে কার্টুন দেখতে পারে সেজন্যই নাকি এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল!

উদ্ধার করা একটি মমি; Image Source: Why so serial? – wordpress.com

৬.

এই ধরনের উদ্ভট কর্মকান্ড কেনই বা মস্কোভিনের মতো একজন সুশিক্ষিত মানুষ করে বসলো তা পুলিশের মতো গোটা রাশিয়াবাসীর কাছেই কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মস্কোভিন স্বীকার করেন, তিনি আসলে ভীষণ রকম একাকিত্বে ভুগতেন। পিতৃত্বের স্বাদ তার কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল। কিন্তু অবিবাহিত হওয়ায় দেশের আইনানুযায়ী তিনি কোনো সন্তানও দত্তক নিতে পারেননি। তার ওপর ছোটবেলা থেকেই মৃতদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাকে এই ধরনের উদ্ভট কর্মকান্ডে উৎসাহিত করেছিল।

Image Source: Foxnews.com

এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি জানান, কবরস্থান থেকে লাশ চুরি করার পেছনে তার অন্য আরেকটি উদ্দেশ্যও ছিল। মৃতকে কোনোভাবে জীবিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় কি না সে বিষয়ে তিনি টুকটাক গবেষণা শুরু করেছিলেন। ইতিমধ্যে লবণ এবং বেকিং সোডা দিয়ে লাশ সংরক্ষণ করার একটি সহজলভ্য উপায়ও তিনি বের করে ফেলেছিলেন। প্রতিবছর তিনি বেশ ঘটা করে নিজের মেয়ের মতো প্রতিটি মমির জন্মদিন পালন করতেন ।

উদ্ধার করা অপর একটি মমি; Image Source: All That’s Interesting

মস্কোভিনের কক্ষ থেকে সর্বমোট ২৯টি মমি উদ্ধার করা হয়। সবগুলোরই বয়স ছিল ৩ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। সেগুলোর মধ্যে একটি মমি মস্কোভিন প্রায় নয় বছর ধরে তার শোবার ঘরে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন!

৭.

পুলিশ তার বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি অভিযোগ গঠন করে। সবগুলোই ছিল লাশ চুরি এবং কবর অসম্মান সংক্রান্ত। রাশিয়ান মিডিয়া তাকে “The Lord of the mummies” এবং “The Perfumer” নামে ডাকতে শুরু করে।

গ্রেফতারের পর মস্কোভিন; Image Source: All that’s interesting

কোর্টে মস্কোভিন ৪৪টি কবর থেকে লাশ চুরি করার কথা স্বীকার করেন। তিনি সেসময় কোর্টে উপস্থিত সেসব মমি করা মেয়েদের মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন, “আপনারা আপনাদের মেয়েকে অন্ধকার কবরে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। আমি তাদেরকে সেখান থেকে তুলে এনেছি। নিজের মেয়ের মতো করে যত্ন করেছি। তাদেরকে সামান্য কষ্টটুকুও পেতে দেইনি।

নাতাশা কার্ডিমোভা (বামে) ও তার মমি করা দেহ (ডানে); Image Source: All That’s Interesting

কোর্টে প্রমাণিত হয় মস্কোভিন স্কিৎজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত। ফলে তাকে বড় কোনো শাস্তি না দিয়ে একটি জেল হাসপাতালের মানসিক বিভাগে রাখা হয় কয়েকবছর। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে কোর্ট তাকে নিজ বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অনুমতি দেন।

যদিও তার এই মুক্তিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার। মস্কোভিনের প্রথম শিকার নাটালিয়া কার্ডিমোভার মা মনে করেন, জেলখানার চার দেয়ালই তার জন্য উপযুক্ত স্থান। তিনি বলেন, “আমি ভাবতেও পারি না কীভাবে সে মুক্তি পেল। তার মুক্তি পাওয়ার পর থেকে আমি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছি না। আমি এবং আমার পরিবার তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দাবি করছি।

৮.

অবশ্য এত কিছুর পরও মস্কোভিনের বোধোদয় হবে বলে মনে হয় না। কারণ অভিযোগ আছে, তিনি কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, তারা যেন তার ‘মেয়েদেরকে’ খুব গভীরে কবর দিয়ে না দেয়। কারণ তিনি মুক্তি পাওয়া মাত্র তাদেরকে আবার কবর থেকে তুলে আনবেন এবং তার ঘরে এনে তাদের নিয়ে আগের মতো জীবন শুরু করবেন!

This article is in Bengali language. It is about the life and bizarre work done by a Russian historian - Anatoly Moskvin. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Featured Image: Crime Russia

Related Articles

Exit mobile version