সকালবেলার মিষ্টি রোদটা চোখে পড়ামাত্রই বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরে যাই। তারপর চুলার আগুনটা জ্বালিয়ে, পাতিলে দুই কাপ পানি মেপে চিনি-চা পাতা সহ সোজা চুলায় বসিয়ে দেই। এদিকে যখন পানির কল ছেড়ে হাত-মুখে পানি দিচ্ছি, তখনই নাকে এসে লাগে ফুটন্ত পানিতে চা পাতা সেদ্ধ হওয়ার মৃদু সুবাস।
বলছিলাম দুটি পাতা একটি কুঁড়ির মোহনীয় জাদুর গল্প। বাঙালির পছন্দের পানীয়ের তালিকা তৈরি করা হলে তাতে হয়তো এই চা পাতার অবস্থানই সবার প্রথমে হবে। কিন্তু বাঙালির এই প্রিয় পানিয়ের আবিষ্কার করার সৌভাগ্যটা তাদের নিজেদের হয়নি। এই ভারতবর্ষে চা পাতার পরিচিতি ইংরেজদের হাত ধরে শুরু হলেও উপমহাদেশের মানুষ দেশ থেকে ইংরেজদের সাথে সাথে চা পাতাকে তাড়িয়ে দেয়নি। বরং চুলার পাশের আনাজের তাকে চায়ের পটের জায়গা করে দিয়েছে। কিন্তু এই ছোট জায়গাটা করে নিতেও চা পাতাকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন প্রথম চায়ের প্রচলন করে তখন বাঙালিরা কিন্তু বিষয়টা ভালভাবে নেয়নি। দুষ্কৃতিকারী ইংরেজদের নতুন চক্রান্ত হিসেবে চা পান করাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বাইরে যদি বসন্ত থাকে তবে হাজারো চেষ্টা করেও তার ঘরে আসা বুঝি থামানো যায় না। তেমনি পচন ধরা সমাজের চোখরাঙানি সত্ত্বেও চা পাতা ঢুকে পড়ে বাঙালীর অন্দরমহলে। কোম্পানির লাটসাহেবদের বিকেলের আড্ডাতে নিমন্ত্রিত বাঙালীরা প্রথমদিকে দূরে থেকে সাহেবেদের চা পান করাকে দেখতেন। ক্রমে সাহেবদের বাড়ির চা-চক্র হয়ে ওঠে বাঙালী জীবনের অনুষঙ্গ।
১৮৪০ এর দিকে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা পাতার চাষ করতে শুরু করে। কিছুদিনের মাঝেই ভারতের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীরা এতে যুক্ত হয়ে ওঠেন। এমনকি কথিত আছে জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ির লোকজন ও এই ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মালনীছড়া চা বাগানকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম চা বাগান।
চা চাষের জন্য মূলত ঢালু জমি অপরিহার্য। কারণ চা গাছের প্রয়োজন অধিক বৃষ্টিপাত। তাই এই ঢালু জমি বৃষ্টির পানি গাছের গোড়ায় জমতে দেয় না। চিরহরিৎ এই গাছের সরাসরি সূর্যালোক তেমন পছন্দ না। এ কারণে বাগানে গাছের মাঝে মাঝে সারি বেধে লাগানো হয় ইউক্যালিপটাস জাতীয় ছায়াদানকারী গাছ।
বছরে সাধারণত তিন থেকে চারবার চা গাছ থেকে নারীরা সংগ্রহ করেন দুটি পাতা একটি কুঁড়ি। প্রতিটি গাছ থেকে নারীরা নিজেদের হাতের সাহায্যে সংগ্রহ করেন এই চা পাতাগুলো। একবার ভাবুন তো, প্রতিটি গাছের এমন হাজার হাজার কুঁড়ি সংগ্রহ করা কী পরিমাণ শ্রম, মনোযোগ আর ধৈর্য্যের কাজ। আমি বা আপনি হলে আমরা হয়তো কুঁড়ির বদলে পুরো গাছসহ তুলে আনতাম!
এই তুলে আনা পাতাগুলো নারীরা বাগানের কর্মীদের হাতে তুলে দেন, আর প্রত্যেকের সংগ্রহ করা পাতার ওজন অনুযায়ী টাকার পরিমাণ নিয়ে বাড়িতে ফিরে যান। এখনও এই সাধারণ চা গাছের পাতাগুলোর রান্নাঘরের তাকে রাখা কালচে দানাদার চা হয়ে উঠতে অনেকটা সময় বাকি।
সবার প্রথমে সবুজ পাতাগুলোকে একটা খোলা জায়গায় বিছিয়ে রেখে ফ্যান দিয়ে পাতাগুলো থেকে অতিরিক্ত পানি (প্রায় ৬০ শতাংশ) শুকিয়ে ফেলা হয়।
এরপর পাতাগুলো একটা রোলার মেশিনের ওপর বিছিয়ে ভালমতো রোল করা হয়। আর এই ধাপেই পাতাগুলো কুঁকড়ে গিয়ে দানাদার আকার নেয়।
পরবর্তীতে দানাদার চা পাতাগুলো একটা অটোমেটিক ছাঁকনির মাধ্যমে ছেঁকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। মূলত উৎপাদন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করেই এই ভাগগুলো করা হয়ে থাকে। চা উৎপাদন পদ্ধতির প্রধান দুটি ভাগ হলো অর্থোডক্স এবং সি.টি.সি (C.T.C = Curl, Tear & Crush)।
বাংলাদেশে মূলত সি.টি.সি পদ্ধতিতে BOP (Broken Orage Pekoe) এবং OF (Orange Fanning) গ্রেডের চা উৎপাদিত হয়। অনেক সময় চায়ের প্যাকেটে আমরা বিভিন্ন রকম B, F, G লেখা অক্ষর দেখতে পাই। এই লেখাগুলোই মূলত প্যাকেটের চায়ের গ্রেড নির্দেশ করে। চা পাতার এই গ্রেডিং দিয়ে বোঝা যায় চায়ের গন্ধ আর স্বাদ কেমন হবে। আবার আমরা সবাই জানি, ছোট দানার পাতায় কড়া স্বাদের চা আর বড় দানায় হয় সুগন্ধ।
সুতরাং এখনই বসে পড়ুন হাতে এককাপ চা নিয়ে আর ভাবতে থাকুন এই সামান্য চা পাতা কী করে আপনার জন্য হয়ে ওঠে অসামান্য। আর চাইলে একবার সময় করে চায়ের শহর সিলেটও ঘুরে আসতে পারেন। চা বাগানের নিসর্গ, চা-শ্রমিকদের বিচিত্র জীবনধারা কিছুটা সময় হলেও মনকে করবে শান্ত শীতল।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চা-শ্রমিক
২) চা বাগানের বিচিত্র জীবন