“তোমার মতো কালো মানুষের ভালো জায়গায় বিয়ে কী করে হবে?”
“তোমার চেহারা আরেকটু ফর্সা করা দরকার, ভালো দেখাবে”
“তোমার সাথে এরকম কালো মানুষের চলাফেরা মানায় না”
এরকম উদ্ভট কিছু কথা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনারা কখনো না কখনো অবশ্যই শুনেছেন। ফর্সা চেহারার অধিকারী হওয়াটা যেন একটি কলা বা পটুতা, যেকোনো বাধাই যেন চুরমার হয়ে যাবে ফর্সা চেহারার অধিকারী হলেই। অনেকটা এমনটাই দাবি হয়তো রঙ ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রয়কারী অধিকাংশ কোম্পানির। এরকম ভ্রান্ত ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। এই রঙ ফর্সাকারী ক্রিম আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে কিভাবে মুনাফা লুটে নিচ্ছে, তা নিয়েই আমাদের আজকের এই আলোচনা।
আদিকাল থেকেই মানুষের সাদা জিনিসের প্রতি আলাদা আকর্ষণ কাজ করতো। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজকীয় পরিবারের নারীরা এই সাদা চামড়ার পেছনে ছুটেই মুক্তার নির্যাস চামড়ায় লাগাতেন। ১৯১৯ সালে ইএস পাটানওয়ালা নামক এক ব্যবসায়ী আফগান স্নো নামে সর্বপ্রথম রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ভারতীয় উপমহাদেশে বিক্রয় করা শুরু করেন।
তবে এসব ক্রিম তখনও ব্লিচিং ক্রিম নামেই আখ্যা পেয়েছিল। ১৯৭৫ সালে হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ নামে নিয়ে আসে এমন এক রঙ ফর্সাকারী ক্রিম, যা ত্বকের উপরে নরম আবরণ সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের স্বপ্নের উপরে ভর করে এই ক্রিম তার প্রচারণা শুরু করে। ধীরে ধীরে অনেক কোম্পানি বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায়।
২০০৫ সালের আগে এসব ক্রিম শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য তৈরি করা হলেও ছেলেদের জন্য ইমামি কোম্পানি নিয়ে আসে ‘ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম’। এক্ষেত্রেও বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয় ছেলেরা ফর্সা হলে চাকরির বাজারে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পাবে।
সাধারণ জনগণের মধ্যে এই রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের ধারণা পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করে গিয়েছেন অনেক তারকাই।
অনেক সময় দেখা যায়, এসব বিজ্ঞাপনে এমনও বলা হয় যে, ক্রিম অল্প কিছুদিন ব্যবহারেই তাদের ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। এ ব্যাপারে ডাক্তার সুনিতা মুর বলেন, আপনার ত্বক কিছুটা হয়তো এসকল ক্রিম ব্যবহারের কারণে উজ্জ্বল হতে পারে। তবে খুব দ্রুত ফলাফলের ক্ষেত্রে লাভের তুলনায় ক্ষতি হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
যখন অতিবেগুনী সূর্যালোক আমাদের ত্বক আঘাত করে, তখন তা আমাদের প্রত্যেককে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ত্বকের রঙের উপর নির্ভর করে একজন ব্যক্তির ত্বক সূর্যের প্রভাবে গোলাপী হতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগতে পারে, আবার অন্য একজনের ত্বকে সামান্য পরিবর্তন করার জন্য ঘন্টাখানেক প্রয়োজন। এই পার্থক্যের কারণ কী এবং কীভাবে আমাদের ত্বক অনেক বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করা শুরু করলো?
রঙ যা-ই হোক না কেন, আমাদের ত্বক মানুষের নিরপেক্ষতা এবং অভিযোজন যোগ্যতার একটি গল্প বলে, যার সবটুকুই যেন মেলানিনকে কেন্দ্র করে। মেলানিন এমন এক রঞ্জক উপাদান, যা চামড়া এবং চুলকে রঙ প্রদান করে। এই উপাদান মেলানোসাইট নামে চামড়া কোষ থেকে উৎপন্ন হয় এবং দুটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি ইউমেলানিন, যা বিভিন্ন রকমের বাদামি, কালো ত্বক এবং গাঢ় চুলের জন্য দায়ী। দ্বিতীয়টি ফিওমেলানিন, যা লালচে বাদামী এবং লাল চুলের জন্য দায়ী।
কিন্তু মানুষ সবসময় এরকম ছিল না। সৌরশক্তি চালিত বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার কারণে আমাদের একেকজনের চামড়ার রঙ একেক রকম হয়। আদিম মানব, যারা বিষুবরেখার নিকটে বসবাস করতেন, তারা অধিক পরিমাণে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির সংস্পর্শে থাকতেন। ত্বক যখন অতিবেগুনী রশ্মির সাথে অধিক সময় সংস্পর্শে আসে, তা আমাদের ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। যদি এই ক্ষতি যথেষ্ট গুরুতর হয়, কোষের পরিব্যক্তি বা মিউটেশন ঘটে মেলানোমা সৃষ্ট হতে পারে, যা একটি মারাত্মক ক্যান্সার।
তাহলে কী করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা অতিবেগুনী রশ্মির এই আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন? বেঁচে থাকার চাবিকাঠি ছিল তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত সানস্ক্রিন মেলানিন, যা তৈরি হয় ত্বকের নিচে। আপনার ত্বকে মেলানিনের ধরন এবং পরিমাণ নির্ধারণ করে সূর্য থেকে আপনার কী পরিমাণে সুরক্ষা প্রয়োজন। সূর্যরশ্মি আপনার ত্বকে কী পরিমাণে সংবেদন সৃষ্টি করে তার উপর ভিত্তি করে মেলানিন তৈরি হয় দেহে। যখন ত্বক অতিবেগুনী আলোর মুখোমুখি হয় তা রোডোপসিন নামক বিশেষ আলোক সংবেদনশীল রিসেপটরকে ট্রিগার করে, যা মেলানিন উৎপাদন করে কোষগুলোর ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
আমাদের চামড়ার বহির্ভাগ দেখতে কেমন হবে তা নির্ভর করে আমাদের জিনের উপর এবং এই সিদ্ধান্তটি দেহ নিয়ে থাকে ত্বকের সর্ববহিঃস্থ স্তরে উপস্থিত মেলানোসোম বা মেলানিন সম্বলিত কিছু থলির সংখ্যা, আকার এবং বিন্যাসের উপরে। তাছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মানসিক চাপের পরিমাণ এবং খাবারও মেলানিনের পরিমাণের উপরে প্রভাব ফেলে। নিচের ছবিতে দেখুন কৃষ্ণতর চামড়ায় কাল কিছু দানাদার পদার্থ অধিক মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এগুলোই মেলানিন, যা ফর্সা মানুষদের ত্বকে কম পরিমাণে থাকে। এই মেলানিন ত্বকের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকে। এই ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমগুলো ত্বকের উপরে এমনভাবে প্রভাব ফেলে যাতে হয় মেলানিনের উৎপাদন হ্রাস পায়, নতুবা উপরের স্তরের ত্বকের ক্ষয় হয়।
ফেয়ারনেস ক্রিমের স্বাস্থ্যঝুঁকি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ডাক্তার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিকদারের মতে,
“ক্রিমগুলোর বিজ্ঞাপন আকর্ষণীয়। তবে এই ক্রিমগুলো ত্বক সাদা করার পরিবর্তে ত্বকের ক্ষতিই করছে। রঙ ফর্সাকারী এই ক্রিমগুলো দাগ, অ্যালার্জি, খোস-পাঁচড়ার মতো বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এমনকি ত্বকে ইনফেকশনও তৈরি করতে পারে। তাছাড়া এখন বিভিন্ন বিউটি পার্লারে হারবাল বিউটি প্রোডাক্ট বিক্রয় করা হয়। যারা এসকল কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা খুব কম ক্ষেত্রে এসব মিশ্রণ এবং তৈরি সম্পর্কে জানেন। অনেক সময় এসব ব্যবহারের ফলে খারাপ প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয়।”
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বা কোম্পানির মিরাকেল উপাদানের মাধ্যমে ত্বক সাদা করে ফেলে এরকম অনেক দাবি করা হয়ে থাকলেও এসব রং ফর্সাকারী ক্রিম তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় অনেক ক্ষতিকারক উপাদান। নয়াদিল্লির এক এনজিও ‘The Center for Science and Environment’ বাজারে প্রচলিত বেশ কিছু ফেয়ারনেস ক্রিম নিয়ে পরীক্ষা করে এবং ফলাফলে যে সকল ক্ষতিকারক উপাদান উঠে আসে তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি এখানে দেখানো হলো-
- হাইড্রোকুইনোন: হাইড্রোকুইনোন হলো সারা পৃথিবীতে ত্বক উজ্জ্বলকারী পণ্যগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত উপাদানগুলোর একটি। হাইড্রোকুইনোনের সাথে ক্রিমগুলো সাধারণত ত্বকের চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়, তবে প্রায় ৫ শতাংশ শক্তির হয়ে থাকে। হাইড্রোকুইনোন এমন কিছু উপাদান তৈরিতে বাধা দেওয়ার কাজ করে, যা মেলানিন তৈরিতে ত্বককে সাহায্য করে। তবে এটি আপনার আলোক-সংবেদনশীলতা হ্রাস করতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহারে আপনাকে চামড়ার ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- স্টেরয়েড: স্টেরয়েডের উপস্থিতি চামড়ার বহিঃস্তরের ক্ষতি সাধন করে। তাছাড়া মুখের ব্রণ এবং লোমের বৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে বলে ধারণা করছেন গবেষকেরা।
- পারদ: পারদ বেশিরভাগ ত্বক উজ্জ্বলকারী পণ্যে পাওয়া যায়। কারণ এটি ম্যালেনিন রঞ্জক কোষের গঠনকে বাধা দেয়। তবে পারদ শরীর দ্বারা দ্রুত শোষিত হয় এবং বিভিন্ন মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সেন্টার অব সায়েন্স এন্ড এনভায়রনমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাজারে যে সকল রঙ ফর্সাকারী ক্রিম পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশেই পারদের উপস্থিতি রয়েছে।
- ক্রোমিয়াম: রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ছিল অনুমোদিত মাত্রা থেকে প্রায় ১০-১৫ গুণ বেশি। এই ত্বক ফর্সাকারী উপাদানকে ক্যান্সারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া এটি ত্বককে করে তোলে শুষ্ক এবং ভঙ্গুর।
২০১৪ সালে মিস আমেরিকা হয়েছিলেন নিনা দুভালারি। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই খবর শোনার পরে ভারতের এক পত্রিকার সম্পাদক তাচ্ছিল্য করে বলে বসেন, উনি যদি ভারতে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে এসব সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা তো দূরে থাক, উনার বড় হবার সময় প্রতিনিয়ত অপমানজনক মন্তব্য শুনতে হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের মানসিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে কসমেটিক ব্যবসায়ীরা মানুষের ক্ষতি করেও নিজেরা লাভ করে যাচ্ছেন। কেননা প্রচারকারীরা এমন কোনো জায়গায় নতুন চাহিদা তৈরি করতে পারেন না, যেখানে সে চাহিদা আগে থেকে না থাকে। সামাজিক চাপে পড়ে শ্যামবর্ণের ছেলে বা মেয়েদের ফর্সা হবার মানসিক চাপই যেন তৈরি করেছে অযৌক্তিক এক চাহিদার।
২০০৯ সালে এই চাহিদার বিপরীতে চেন্নাই এর একটি এনজিও ‘Women of worth’ শুরু করেন একটি প্রচারণার- ‘Dark is beautiful’। এই প্রচার অভিযানটি ভারতে চামড়ার রঙের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে। বিবাহ, কর্মসংস্থান, সাধারণ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও যেন এই বৈষম্য কাজ করে। এই প্রচারণার মুখপাত্র অভিনেত্রী এবং পরিচালক নন্দিতা দাস বলেন, “এই বৈষম্যের শিকার অসংখ্য মহিলার মেইল আমার কাছে এসেছিল। তাদের মধ্যে এমন অনেকেও ছিলেন যারা ফর্সা হতে পারেননি দেখে আত্মহত্যা করার চিন্তা পর্যন্ত করেছিলেন।”
২০১৭ সালে বিভিন্ন রঙ ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪,৮০০ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য বাজার গড়ে তুলেছে বলে ধারণা করা হয়। এই ধারা বজায় রাখার জন্য তারা প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন মাধ্যমে খরচ করেই যাচ্ছেন। যার ফলে বর্তমানে অনেকের মধ্যেই একটি ধারণা ওতপ্রোতভাবে জন্ম দিয়েছে যে ফর্সা ত্বক থাকলেই সফল হওয়া যায়। এই ধারণা আমাদের সমাজের মধ্যেও বিদ্যমান।
যার প্রমাণ হিসেবে বলা যায় আপনি যখন একজন মানুষের সাথে প্রথমবার দেখা হয় তার প্রথম ইম্প্রেশনটাই আপনার কাছে অনেকদিন ধরে বজায় থাকে। এই ত্বকের রঙ নিয়ে রাজনীতির রয়েছে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব। আমাদের সকলেই স্বাধীন দেশের বাসিন্দা, তবে এই রঙের বৈষম্যে যেন সবাই আবদ্ধ। আর এই বৈষম্যের চিন্তা নিশ্চয়ই নিজে নিজে ঠিক হয়ে যাবে না। তার জন্য আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নিজেই ভেবে দেখুন না হয় আপনি আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী শিক্ষা রেখে যেতে চাচ্ছেন।
ফিচার ইমেজ: Humanae project