ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াতে বসে কথা হচ্ছে একই বর্ষে পড়ুয়া তিন বান্ধবীর মধ্যে। আলোচনার বিষয় ক্লাসেরই কোনো একজন। আলোচনা-সমালোচনা, মন্তব্যের আদান-প্রদান চলতেই থাকে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে নিয়ে। আলোচনায় ভালো এবং খারাপ দুটি দিকই উঠে আসছে। আলোচনা চলছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি হয়তো জানেও না বা পরে হয়তো জানবে যে, তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে যাচ্ছে। কারও অনুপস্থিতিতে চলা এই ধরনের আলোচনাকে বলা হয় পরচর্চা বা পরনিন্দা। এই পরচর্চা বা পরনিন্দা কি শুধু মিথ্যাচার আর সময়ের অপচয়? নাকি রয়েছে কোনো ইতিবাচক ব্যাখ্যাও?
বিজ্ঞানীদের দেওয়া সংজ্ঞা
সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায়, গসিপ বা পরচর্চা হলো তৃতীয় কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার ব্যক্তিগত তথ্যাবলীর আদান-প্রদান। তবে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা বা সত্যের সাথে অসত্যের মিশ্রণে কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনাকে নয়, বিজ্ঞানীরা বরং অনুপস্থিত ব্যক্তির ভালো বা মন্দ মূল্যায়ন সম্পর্কিত আলোচনাকে পরচর্চা বলেছেন। পরচর্চার আরেক নাম গীবত, যেটিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গর্হিত কাজ হিসেবে দেখা হয়। আড্ডার আসরে, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের দলীয় আলাপচারিতায় বেশ বড় অংশ জুড়ে থাকা এই পরচর্চাকে শত্রুতাপরায়ণ মনোভাব এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর কিছু উপকারিতাও রয়েছে। যেমন- সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে, সামাজিক রীতিনীতিগুলো সকলের সামনে আরও খোলাসা হয় ইত্যাদি।
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে বেশ কড়া শাস্তির বিধান ছিল পরচর্চাকারীর জন্য। অমানবিক এই শাস্তিতে দোষীকে একধরনের লোহার কাঁটাযুক্ত ফ্রেম পরিয়ে দেয়া হতো। ফ্রেমটি পরালে ওই ব্যক্তি আর কথা বলতে পারতো না। তবে এখানে উল্লেখ্য, এই শাস্তির বিধান মূলত বেশি কথা বলা নারীদের জন্য ছিল। এখন যে পরচর্চাকে ইতিবাচক দেখা হয় তা কিন্তু নয়, তবে অমানবিক শাস্তির বিধান এখন নেই।
গুজব বনাম পরচর্চা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরচর্চার বিষয়বস্তুকে গুজবের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, বা আমরা গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু দুটি বিষয় আলাদা। এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এই ফারাকের মূলে রয়েছে বিষয়বস্তু, যা নিয়ে এই আলোচনা চলছে। গুজব ছড়ায় পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে। এখানে ‘পর্যাপ্ত’ বলতে অন্ততপক্ষে যতটুকু তথ্য পেলে একটি বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে, ততটুকুকে বোঝানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি থাকলে তো ভালো, কেননা সেক্ষেত্রে গুজব রটবে না এবং তিল থেকে তালও গজাবে না। গুজবের বিষয়বস্তু থাকে প্রাণহীন বস্তু বা কোনো একটি ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই গুজবের বিষয়বস্তু এখন ছেলে-বুড়ো সকলেরই গোচরে।
অপরদিকে পরচর্চার বিষয়বস্তু হলো ‘মানুষ’। এই ‘মানুষ’ শব্দটিকে আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হবে ‘তৃতীয় ব্যক্তি’। পরচর্চার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্যের উপস্থিতি আছে কী নেই, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। পরচর্চাকারীর উদ্দেশ্য থাকে ঐ তৃতীয় ব্যক্তির মূল্যায়ন, রটনা ঘটানো নয়।
তাহলে পরচর্চা কি রটে না?
“যা রটে তার কিছু তো সত্যও বটে”– এই অতি পরিচিত প্রবাদ বাক্যের সত্যতা সবক্ষেত্রে পাওয়া না গেলেও পরচর্চার ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। পরচর্চাকারী ব্যক্তি যদি ঐ আলোচ্য তৃতীয় ব্যক্তিটির সম্পর্কে স্বচ্ছভাবে জ্ঞান না রাখেন, তাহলে কথার মাঝে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে ব্যক্তিগত থেকে বস্তুগত, তথা ঘটনাগত আলোচনায় রূপ নেয় এবং ফলাফল হিসেবে গুজবের রটনা ঘটে। এরপর গুজব তার নিয়মানুযায়ী দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে চৌদ্দ এবং এভাবেই ছড়াতে থাকে এবং রটনাটি আসছে সেই পরচর্চা থেকেই। অর্থাৎ, পরচর্চা রটে, এবং এই রটনার কিছুটা তো বটেই!
কর্মক্ষেত্রে পরচর্চা এবং গবেষণা
পরচর্চা যে শুধু কিশোর-কিশোরী বা কমবয়সী ছেলেমেয়েরাই করে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। বরং মধ্যবয়সীদের মাঝে এর প্রভাবটা অনেকক্ষেত্রে বেশিই দেখা যায়। কর্মজীবী ব্যক্তিদের মাঝেও পরচর্চার প্রবণতা লক্ষণীয়। এ নিয়ে হয়েছে সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণাও। গবেষণায় পরচর্চাকারীদের আচরণ এবং উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, দেখা হয়েছে পরচর্চাকারী সম্পর্কে অন্যদের অনুধাবন।
২০১০ সালের একটি গবেষণা
বাল্টিমোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফারলে আরও দুজন গবেষকের সাথে তেমনই একটি গবেষণা চালান। গবেষণার বিষয়টি ছিল কফি পান করতে করতে বা ব্রেকের সময়ে নারীকর্মীদের পরচর্চা। বিষয়টি বেশ মজাদার এবং নাম শুনেই পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। তবে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এমন গবেষণা নিরপেক্ষভাবে কীভাবে করা সম্ভব? পর্যালোচনা করা হচ্ছে জানলে অবশ্যই গবেষণার ফলাফলে তার প্রভাব পড়বে। এই সবকিছু মাথায় রেখেই গবেষকগণ পরচর্চালোচনায় না ঢুকে ভিন্ন পন্থা হিসেবে অনলাইনে পূরণীয় ফর্ম আকারে স্কেল নির্মাণ করে ৫০০ জনকে পাঠান, যার মধ্যে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে মাত্র ১২৯টি ফেরত পান। অংশগ্রহণকারীদের নির্দেশনা ছিল এমন একজন মহিলাকে কল্পনা করে ফর্মটি পূরণ করা, যিনি কর্মক্ষেত্রে অন্যদের সাথে আলাপের সময় পরচর্চা করে থাকেন- মূলত নেতিবাচক। ছয়টি মাত্রাবিশিষ্ট এই স্কেলে পূরণকৃত তথ্যের মূল্যায়নের মাধ্যমে দেখা যায়, যারা অন্যকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান, তারাই বেশি এই পরচর্চা করে থাকেন।
এই ধরনের পরচর্চাকে অনেক গবেষকই কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের একটি পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া এর মাধ্যমে এমন অনেক বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, যেগুলো লিখিত দলিলাকারে পাওয়া যায় না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।
ভালো বনাম মন্দ
এতকিছুর পরেও গবেষকগণ এখনও নিশ্চিত নন যে এই পরচর্চা ভালো নাকি মন্দ। কেউ কেউ বলছেন পরচর্চার বিষয়বস্তু গোপনীয়, তাই এর আলোচনা নীতিবিরুদ্ধ। অপরদিকে কিছু গবেষণা বলছে এর ভালো দিকগুলোও। ২০০৬ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, নেতিবাচক পরচর্চা সামাজিক বন্ধন এবং অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি করে। আবার ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় ১২টি গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে যে এই পরচর্চার মাধ্যমে সামাজিক রীতিনীতি সুদৃঢ় হয়, সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়, দলগত অংশীদারিত্বের ধারণা স্পষ্ট হয়, এমনকি সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতা, নিজস্বতা ইত্যাদি সবকিছুই দৃশ্যত বৃদ্ধি পায়। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-তত্ত্ববিদ বায়ানকার মতে, পরচর্চা সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে কাজ করে।
হ্যাশট্যাগ ‘মি টু’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল আলোচিত বিষয় ‘#metoo’ সম্পর্কে অবগত নন এমন কাউকে বর্তমানে পাওয়া দুষ্কর। হ্যাঁ, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস নিয়ে শুরু হয়েছিল এই হ্যাশট্যাগ। বিষয়টিকে গুজব বলার কোনোই কারণ নেই, কেননা এটি সত্য। তবে এটি পরচর্চার সাথে সম্পর্কিত কি না, সে সম্পর্কেও রয়েছে মতবিরোধ। তবে একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, এই হ্যাশট্যাগের বিষয়ে আলোড়ন সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে ছোট ছোট দলে কোনো যৌন নিপীড়ন আলোচনাকারীকে নিয়ে কথোপকথনের মাধ্যমে। সেদিক থেকে হিসেব করলে, এখানে পরচর্চা ইতিবাচক দিকেই গিয়েছে বলা যায়।
সেলেব্রিটি-চর্চা
পরচর্চা মানেই চেনা-পরিচিত কাউকে নিয়েই যে হতে হবে, তা নয়। সেলিব্রিটিদের নিয়ে চর্চাও পরচর্চার মধ্যেই পড়ে। এই আলোচনাগুলো শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিত্ব এবং আচরণের বহিঃপ্রকাশও ঘটে বলে জানিয়েছেন এমানুয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অ্যান্ড্রিয়া ম্যাকডোনেল।
করবেন, নাকি করবেন না?
পরচর্চার ভালো-খারাপ নিয়ে বিস্তর আলোচনার শেষে এই সিদ্ধান্তে আসা জরুরি যে এরপর থেকে পরচর্চা করবেন, নাকি করবেন না? সমাজবিজ্ঞানী কোলের মতে, পরচর্চা করতেই পারেন, তাতে বাধা নেই। তবে চারটি নিয়ম মেনে:
১। পরচর্চার বিষয়টিকে গোপন রাখা
২। একে উপকারী করে তুলুন
৩। মিথ্যা ব্যবহার করবেন না, এবং
৪। শ্রোতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করুন।