কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি কোনো কাজ করতে চাচ্ছেন না, অথচ শুধু ‘না’ না বলতে পারার কারণে ঠিক সেই অপছন্দের কাজটিই করতে হচ্ছে আপনাকে? ঠিক একই ব্যাপার খাওয়ার ক্ষেত্রেও সত্য। এমন কোনো ঘটনা কি আছে আপনার জীবনে যেখানে আপনার পেট ভরে গিয়েছে, আপনি আর খেতে পারছেন না। এমন সময় কেবল ‘না’ বলেননি দেখে আবার এক পাহাড় সমান খাবার নিয়ে বসতে হয়েছে আপনাকে? ঘটনাগুলো খুব স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমাদের জন্য তো বটেই।
ছোটবেলাতেই আমরা ভ্রদ্রতার তাগিদে ‘না’ বলার অভ্যাস হারিয়ে ফেলি। মনের মধ্যে দ্বিধা কাজ করে। যার পরিপূর্ণতা পায় বড় হওয়ার পর। আমরা আর শিখিই না ‘না’ বলা। ভাবছেন, ‘না’ বলা কি কোনো শেখার জিনিস? হ্যাঁ! ‘না’ বলতে শিখতে হয়। কোনো মানুষের চোখে চোখ রেখে সরাসরি ‘না’ বলতে পারাটাও একটি অর্জন। এখন প্রশ্ন হল, কেন আমরা ‘না’ বলতে পারি না? কেন এত সহজ একটি শব্দ বলতে এত সমস্যা হয় আমাদের?
আমরা কেন ‘না’ বলতে পারি না?
প্রশ্নটির নানারকম উত্তর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আমরা ‘না’ বলতে পারি না কারণ আমরা মনে করি, বর্তমানে আমরা হয়তো সময় বের করতে পারবো না কোনো কাজের জন্য, হয়তো আমাদের অনেক সমস্যা আছে। তবে ভবিষ্যতে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেই ভবিষ্যতও বর্তমান সময়ে রূপ নেয় আর আমরা আবার হয়ে পড়ি ব্যস্ত। আর সেই সময় কেন আমরা ‘না’ বলতে পারি না, কেন ‘না’ বলিনি ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে থাকি। কাজটা বর্তমানে করে নিলেই কি সবচাইতে ভালো নয়? ভাবনা বাদ দিয়ে বাস্তবে, বর্তমানেই ‘না’ বলে দেখাটাই কি শ্রেয় নয়? তবে কেবল এই একটি ব্যাপারই নয়।
আমরা কেন ‘না’ বলতে পারি না তার আছে আরো অনেক কারণ। আমাদের পরিবার আমাদেরকে অনেকসময় চুপচাপ হতে শেখায়। কিছু আদবকায়দা শেখায় যেটা পরবর্তীতে এই ধরনের সমস্যাগুলোর জন্ম দেয়। আমরা সবসময় শুনি যে, বড়দের কথায় কথা বলতে নেই। তারা যা বলবে সেটাই ঠিক। তাই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোনো বিষয় ভালো না লাগে তবুও আমরা ঢেঁকি গিলে ফেলি আর ‘না’ না বলে সেই বিষয় নিয়েই পড়ি, সেই কাজই শুরু করে দিই। কিছু ব্যাপার, যেমন খাবার বা কোনোকিছু পাওয়ার প্রত্যাশা আছে যেখানে সেগুলোকে ‘না’ বলার পেছনে আমাদের মস্তিষ্ক বেশ ভালোভাবে কাজ করে। আমরা হয়তো চাই না, তবুও আমাদের মস্তিষ্ক কোনো পুরষ্কার পাওয়ার অনুভূতি থেকে সিদ্ধান্ত নেয়।
ফলে আমরা মন থেকে কিছু না চাইলেও ‘না’ বলতে পারি না। বিশেষ করে, খাবারের ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া বেশি সহজ। আপনার পেট ভর্তি থাকার পরও কেউ আপনাকে এক টুকরো কেক খেতে বললে আপনি ‘না’ বলতে পারবেন না। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। হতে পারে মানসিকভাবে আপনি নিজের উপরে তত বেশি শক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না বলে। হতে পারে আপনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নন। ফলে নিজের সিদ্ধান্ত ঠিক হবে কিনা দ্বিধায় ভোগেন বলে ‘না’ বলতে পারেন না আপনার অপছন্দের ব্যাপারেও।
আপনার ছোটবেলা কেমন ছিল সেটা সমস্যার অন্তরালের কারণও হতে পারে। হতে পারে আপনার মস্তিষ্ক পেট ভরা জানার পরও আবার কিছু পাওয়ার আশা করছে। আপনি দ্বিধান্বিত হচ্ছেন। ‘না’ বলতে পারছেন না। অনেক সময় শুধু ভয় কিংবা সম্মানের জায়গা থেকেও কাউকে ‘না’ বলাটা সম্ভব হয় না। এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে ‘না’ বলা সম্ভব?
‘না’ বলবেন কীভাবে?
আপনাকে কেউ ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এই দুটোর মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে এবং আপনার সেই কাজটি করতে ইচ্ছে না হলে সেখানে মোট ৩টি পথ খোলা থাকে আপনার সামনে। প্রথমটি হল, অপছন্দের ব্যাপার হলেও ‘হ্যাঁ’ বলে দেওয়া এবং পরবর্তীতে সমস্যায় পড়া; দ্বিতীয়ত, ‘না’ বলে দেওয়া এবং এটি বলার জন্য মানসিকভাবে সমস্যায় পড়া এবং তৃতীয়ত, ‘না’ বলে দেওয়া এবং এই ব্যাপারে কোনো মানসিক সমস্যায় না ভোগা। তিন নম্বরটি আমাদের সবার জন্যই খুব ভালো কিছু মনে হলেও বেশিরভাগ মানুষ সেটা করতে পারেন না। কাউকে বা কোনোকিছুকে ‘না’ বলে দেওয়া কোনো খুব বড় ধরনের ব্যাপার নয়। ঠিক একই সময়ে এটি খুব একটা সহজ কাজও নয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক ‘না’ বলার কিছু সহজ কৌশল।
সরাসরি বলে দিন
আপনি কাউকে ‘না’ বলার আগে কি আরো কিছুক্ষণ ভাবতে চাইছেন? আপনি কি নিশ্চিত জানেন যে, আপনার কাজটি করতে ভালো লাগছে না বা লাগবে না? তাহলে বেশি না ভেবে কিংবা কিছুদিন না দেখে দ্রুত ‘না’ বলে দিন। আর তাকেই বলুন যাকে বলাটা দরকার। অন্যথায়, ব্যাপারটি মানসিকভাবে আপনাকে আরো সমস্যায় ফেলে দেবে। দেখবেন, খুব হালকা লাগবে।
‘না’ বলুন সঠিকভাবে
‘না’ বলার বেশ কিছু উপায় আছে। হতে পারে আপনি অপর পক্ষকে বলে দিলেন যে, আপনি কাজটি করতে পারছেন না। আবার আপনি তাকে এটাও বলতে পারেন যে, আপনি এখন কাজটি করতে পারছেন না। তবে ভবিষ্যতে সেটা করার চেষ্টা করবেন। তবে এতে আপনি নিজেকে খুব বেশি নেতিবাচক কিংবা নিজের উপরে বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে ফেলার মতো কাজ করে ফেলবেন। সহজভাবে বলে দিন যে, আপনি তার কাজটি করতে আগ্রহী ছিলেন এবং আপনার খুব ভালো লাগছে যে, তিনি আপনার কাছ থেকে উপকৃত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনার কাছে এখন কাজটি করার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই। এতে আপনিও নেতিবাচক হবেন না এবং আপনার উপরে কোনো বাড়তি দায়িত্বও থাকবে না।
সতর্ক থাকুন
রাস্তায়, দোকানে কিংবা বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে যে, কেউ আপনাকে কাজের জন্য অনেক টাকা দিয়েছে কিংবা কিছু কেনার ক্ষেত্রে, আরো অনেকে সেই দোকান থেকে পোশাক কিনেছে বলে মানসিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হলো। এতে আপনার উপর মানসিক চাপ পড়বে সেই পোশাকটি কেনার কিংবা কিছু টাকা নেওয়ার। তাই সতর্ক থাকুন এবং নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিন।
আবেগী হবেন না
অনেক সময় বন্ধু কিংবা আত্মীয়কে ‘না’ বলতে পারি না আমরা অনেকে। ফলে দিন শেষে সমস্যা আমাদেরই হয়। তাই সম্পর্ককে সম্পর্কের জায়গায় রেখে সিদ্ধান্ত নিন। এই ব্যাপারে আবেগী হবেন না।
কোমল এবং কঠোর হন
কাউকে ‘না’ বলার সময় একইসাথে কোমল এবং কঠোর হতে শিখুন। তাকে কোমলভাবে ‘না’ বলুন। তবে সেইসাথে কঠোরভাবেও বলুন, যাতে আপনাকে দুর্বল ভেবে আবার প্রশ্ন করার সুযোগ না পায় পাশের মানুষটি।
স্বার্থপর হয়ে উঠুন
মানুষ হিসেবে মাঝেমধ্যে আমাদের উচিত স্বার্থপর হয়ে ওঠা। যে কাজটি আপনার পছন্দ নয় সেটিকে ‘না’ বলার সময়েও স্বার্থপর হয়ে উঠুন। অন্যের নয়, বরং নিজের স্বার্থকে এগিয়ে রাখুন। না হলে দিনশেষে ভুগতে হবে আপনাকেই!
ফিচার ইমেজ: While I’m Waiting