কোয়ারেন্টিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যকরী ব্যবহার

করোনাভাইরাসের আকস্মিক প্রকোপের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সীমিত আকারে চালু রয়েছে অন্য সকল কর্মক্ষেত্র। লকডাউনের দীর্ঘ ও বন্দিদশায় অনেকে হয়তো ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করছেন, কেউ বিভিন্ন অনলাইন কোর্স করে নিজের দক্ষতা বাড়াচ্ছেন, আবার কেউ কেউবা হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিতান্তই অলস সময় কাটাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সচরাচর ব্যবহারের পাশাপাশি চাইলে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন উদ্দেশ্যেও এদের ব্যবহার করা যায়। যা একইসাথে আপনার সক্ষমতা, দক্ষতা ও নেটওয়াকিং বহুগুণে বাড়িয়ে তুলতে পারে। আজ আমরা জানব এমনই কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কথা, যাদের কাজে লাগিয়ে আমরা কোয়ারেন্টিনের এই অলস সময়কে ভবিষ্যতের জন্যে অর্থবহ করে তুলতে পারব।

কোয়ারেন্টিনে পরিচিত হতে পারেন নতুন নতুন মাধ্যমের সাথে; Image Source: Econsultancy

লিংকড ইন

পেশাভিত্তিক কর্মক্ষেত্রের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। লিংকড–ইনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা মানুষদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানো। ২০১৯ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী, লিংকড–ইনে যুক্ত আছেন ৬৩ কোটির বেশি সদস্য। অন্য সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে লিংকড ইনের মূল পার্থক্য হচ্ছে, এই মাধ্যমটি বিশেষভাবে প্রফেশনাল কাজের জন্যে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ইন্টার্নশিপ, স্কলারশিপ বা চাকরি ইত্যাদিতে প্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম এই লিংকড ইন।

লিংকড ইনের সদস্যরা তাদের সহকর্মী, শিক্ষক, বন্ধু, বিভিন্ন ব্যবসা বা উদ্যোক্তা ইত্যাদি নানাবিধ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সবাই একে অপরের সঙ্গে এবং এর বাইরেও নিজের দক্ষতা বা পছন্দের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এর ফলে আপনি যেভাবে অপরের অগ্রগতি ও সাফল্যের খবর জানা জানতে পারবেন, একইভাবে নিজের সাফল্যগুলো তুলে ধরার জন্যও এটি একটি বড় জায়গা। তাই কোয়ারেন্টিনের সময়ে একটু গুছিয়ে নিতে পারেন আপনার লিংকড ইন অ্যাকাউন্টটি।

শুরুতেই লিংকড ইনে সাইন আপ করে নিজের ছবি ও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য উল্লেখ করে নিজের প্রোফাইলটি তৈরি করতে হবে। প্রোফাইল তৈরি করা শেষে এবারে আপনার মূল কাজ শুরু! লিংকড ইন অ্যাকাউন্ট মূলত ভার্চুয়াল সিভি হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই সেটি মাথায় রেখেই একাউন্ট আপডেট করতে হবে। সে কারণে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারের মতো ক্যাজুয়াল কোনো ছবি না দিয়ে সেমি-ফর্মাল একটি ছবি প্রোফাইলে যোগ করা উচিত। ছবি যোগ করার পর ডেসক্রিপশন বক্সে নিজের সম্পর্কে কয়েক লাইনের একটি বর্ণনা যোগ করতে হয়। এই ডেসক্রিপশনটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু টু দ্য পয়েন্ট হতে হবে। কারণ, যারা আপনার সাথে যোগাযোগ করবে, তারা এই তথ্যগুলো থেকেই আপনার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাবে। 

পেশাভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হল লিংকড ইন; Image: Search Engine Journal

ছবি ও ডেসক্রিপশন যোগ করার পরে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, প্রজেক্ট, প্রতিষ্ঠান, অর্জন ইত্যাদি বিভিন্ন সেগমেন্ট নির্ধারিতভাবে যুক্ত করে ফেলুন। মনে রাখতে হবে, সিভি ও লিংকড ইনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সিভিতে আপনি এক থেকে দুই পৃষ্ঠার মধ্যে আপনার যাবতীয় অর্জন দক্ষতা ইত্যাদি যোগ করতে হয় বিধায় আপনার অনেক ছোটখাটো অর্জন বা অভিজ্ঞতাকে বাদ দিতে হয়, কিন্তু লিংকড ইনে আপনি চাইলে ‘অ্যাক্টিভিটি’ অংশে ফেসবুক পোস্টের মতো করেই নিয়মিত আপনার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আপডেট জানাতে পারেন। 

পাশাপাশি, বর্তমানে যে কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং আগে যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, সেখানে বিভিন্ন সময়ে তোলা বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ, স্মারক ইত্যাদির ছবিও যুক্ত করতে পারেন। এছাড়াও ব্যক্তিগত দক্ষতা যুক্ত করার সময় সে ক্ষেত্রগুলোতে যদি কোনো সার্টিফিকেট বা পুরস্কারের ছবি থেকে থাকে, অবশ্যই তা যুক্ত করে দেবেন। এতে করে যিনি আপনার প্রোফাইলটি দেখবেন, তিনি ছবি দেখে আপনার সম্পর্কিত তথ্যগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন।

প্রোফাইল মোটামুটি প্রস্তুত হলে গেলে এবারে মনোযোগ দিতে হবে নেটওয়ার্কিংয়ের দিকে। লিংকড ইনের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে এর নেটওয়ার্ক। আপনি প্রোফাইলটি তৈরি করার পরে আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বর্তমান বা পুরনো কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের লিংকড ইন অ্যাকাউন্টটি আপনি সাজেশনে দেখতে পবেন। পাশাপাশি সম্ভাব্য অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রোফাইলও আপনাকে অটোমেটিক্যালি দেখানো হবে, যেখান থেকে আপনি অনেক জায়গায় সংযুক্ত হতে পারেন। এভাবে চাইলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই গড়ে তুলতে পারেন আপনার লিংকড ইন অ্যাকাউন্ট।

ফেসবুক পেজ 

ফেসবুকে প্রতিনিয়ত আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করি শুধুমাত্র নিউজফিড স্ক্রল করে। ফেসবুকের বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন ছবি গল্প ইত্যাদি শেয়ার করা, সবার সাথে যোগাযোগ রাখা, অবসরের বিনোদন হিসেবে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। ফেসবুককে মোটামুটি ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও, ফেসবুকে চাইলে প্রফেশনাল পরিচয় তৈরি করাও সম্ভব! কোয়ারেন্টিনে তাই নিজের একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করা গেলে খারাপ হয় না।

প্রথমত আমাদের ফেসবুক প্রোফাইল আর পেজের মূল পার্থক্যটা বুঝতে হবে। ফেসবুক প্রোফাইল সাধারণত অনেকটা ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কিত হয়ে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি ইত্যাদি যাবতীয় দৈনন্দিন ঘটনাই মূলত ফেসবুক প্রোফাইলে আমরা শেয়ার করে থাকি। ফেসবুক প্রোফাইলে আমার পরিচিতদেরকে বন্ধু হিসেবে সংযুক্ত করতে পারার সুযোগ থাকে, বিধায় সবার সাথে বেশ স্বাভাবিক যোগাযোগ থাকে এখানটায়। এদিকে খানিকটা ব্যতিক্রম ফেসবুক পেজ। ফেসবুক পেজ একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়। সাধারণত বড় বড় কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিদের নামে ফেসবুক পেজ থেকে থাকে। তা বলে নিজের নামে পেজ খোলা যাবে না, এমনটা নয়। যে কেউই নিজের নামে পেজ খুলতে ও পরিচালনা করতে পারবেন। আর তা করার জন্যে কোয়ারেন্টিনের চেয়ে ভালো সময় আর হয় না।

ফেসবুক পেজে নিয়মিত আপডেট দিন; Image Source: Quartz

আপনার ফেসবুক প্রোফাইলের ‘ক্রিয়েট পেজ’ অপশন থেকে নিজের নাম বা প্রতিষ্ঠানের নামে ঝটপট একটি পেজ খুলে ফেলতে পারবেন। এতে সাধারণত ফর্মাল ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবিশেষ শেয়ার করা হয়ে থাকে। নিজের জন্যে পেজ খুলতে সেখানে আপনার পূর্ণ নাম ব্যবহার করুন। পেজে আপনি নিয়মিত আপনার বিভিন্ন নিজস্ব আর্টিকেল, চিত্রকর্ম, অর্জন, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে প্রাপ্ত পুরস্কার গ্রহণের ছবি ইত্যাদি শেয়ার করতে পারেন। পেজ পরিচালনা করা তুলনামূলকভাবে সহজ, কারণ ফেসবুকের প্রোফাইল থেকেই পেজে ঢোকা যেতে পারে। আপনার সম্পর্কিত যেকোনো ফর্মাল তথ্যই আপনি চাইলে আপনার পেজে শেয়ার করতে পারেন। এতে করে আপনার আপনার ফেসবুক ব্যবহার খানিকটা আনুষ্ঠানিক গুরুত্ব পাবে বৈকি।

ইউটিউব চ্যানেল

আমাদের মাঝে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ভিডিও অ্যানিমেশন, কন্টেন্ট ক্রিয়েট, ওয়ার্কশপ সেশনসহ বিভিন্ন কাজে মোটামুটি ধারণা রাখি। কিন্তু আমাদের এ দক্ষতাগুলো অন্যদের সাথে শেয়ার করার সুযোগ বা সময় হয়তোবা আমাদের হয়ে ওঠেনি। কোয়ারেন্টিনের এই দীর্ঘ সময়ে চাইলে খুলে ফেলা যায় ব্যক্তিগত একটি ইউটিউব চ্যানেল!। অন্যদের সাথে নিজের আইডিয়া ও দক্ষতাগুলো শেয়ার করার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আয়েরও একটি উৎস হতে পারে এই ইউটিউব চ্যানেলটি। ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলে আপনি চাইলে আপনার বিভিন্ন গান, নাচ, আবৃত্তি ইত্যাদির ভিডিও আপলোড করে রাখতে পারেন। তাছাড়াও, নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে নিয়ে ইউটিউব পরিচালনা সাপেক্ষে চাইলে শুধুমাত্র সে উদ্দেশ্যভিত্তিক কন্টেন্ট আপলোড করতে পারেন। এতে করে আপনাকে খুঁজে পেতে আপনার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের পক্ষে অনেকটাই সহজ হবে।

তবে লক্ষ রাখতে হবে, আপনি যদি ব্যক্তিগত ব্যবহারের চাইতে একজন নিয়মিত ইউটিউবার হওয়ার জন্যে বেশি আগ্রহী হয়ে থাকেন, তবে ভিডিও কন্টেন্ট ঠিক করার সময় আপনি কোন জিনিসটা ভালো পারেন, সেটা আগে দেখে নেবেন। যদি আপনি গান গাইতে পারেন, তাহলে গান গেয়ে সেটা আপলোড দিতে পারেন। যদি আপনি মানুষকে হাসাতে পারেন, তাহলে সে অনুযায়ী ভিডিও বানাতে পারেন। আর যদি অন্য কিছু পারেন, তাহলে সেটাই করে ইউটিউবয়ে আপলোড দেবেন। এভাবে আপনার চ্যানেলের বিশেষত্ব ও মৌলিকত্ব বজায় রাখা সম্ভব। 

ভিডিও বানিয়ে ফেলুন পছন্দের কন্টেটের ওপর; Image Source: Udemy

টুইটার

টুইটারের সাথে সাধারণভাবে মানুষ খুব বেশি পরিচিত না হলেও বাংলাদেশের বাইরে টুইটারের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। নামীদামী ব্যক্তিসমূহ থেকে শুরু করে অধিকাংশ মানুষ অনেকক্ষেত্রেই ফেসবুক থেকে টুইটারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। টুইটারের ব্যবহারের মাধ্যমে খুব ছোট আকারে বন্ধুদের বা ফলোয়ারদের সাথে বিভিন্ন টুইট করা যায়। আমাদের মাঝে অনেকে যারা ফেসবুকে অত্যধিক আসক্ত, তারা চাইলে টুইটারে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলতে পারেন। কারণ ভবিষ্যতে হয়তোবা আপনাকে দেশের বাইরে কোথাও যেতে হলে সেখানে গিয়ে দেখবেন, অধিকাংশ মানুষ টুইটার ব্যবহারেই বেশি অভ্যস্ত। এছাড়াও বিভিন্ন সেলেব্রেটি, পলিটিক্যাল লিডার, খেলোয়াড়, ফ্যাশন আইকন, অভিনেতা-অভিনেত্রী সাধারণত টুইটারে নিয়মিত তাদের আপডেট দিয়ে থাকেন। তাই টুইটারের সাথে পরিচিত হলে আপনি মোটামুটি ভিন্ন ঘরানার একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে পরিচিত হতে পারবেন।

নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হতে ক্ষতি কী? Image Source: Reuters

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শেষে কবে আবার পৃথিবী স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তাই এই দীর্ঘ সময়ে কার্যকর উপায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিনোদনের পাশাপাশি প্রফেশনাল ক্ষেত্রেও বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকা সম্ভব।  

This is a Bengali language article. It is about the advanceuse of social medias like LinkedIn, Facebook, Youtube & Twitter. This article says how we can utilize out quarantine period in a better way by using these media.        

References are hyperlinked in the article.

Featured photo: Career Addict

Related Articles

Exit mobile version