বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। আগে যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কিনতে আমরা স্থানীয় বাজারে যেতাম, এখন সেখানে আমরা খোঁজ করি অনলাইনের কোনো মার্কেটপ্লেসে জিনিসটি পাওয়া যাবে কিনা। ঘরে বসেই চটপট ঝামেলাহীনভাবে বাজার করা যায় এসব অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে। ঘরে বসে পণ্য পছন্দ করুন, অর্ডার দিন। বাসায় পৌঁছে যাবে আপনার দরকারী পণ্য।
গোটা বিশ্বজুড়েই চালু হয়েছে এমন হাজার হাজার অনলাইন মার্কেটপ্লেস। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় এসব অনলাইন শপে। শুধু ক্রেতার ক্ষেত্রেই নয়। বিক্রেতাদের কাছেও এসব অনলাইনে শপগুলো হয়ে উঠছে অনেক প্রিয়। এসব অনলাইন শপের মাধ্যমে বিক্রেতারা পাচ্ছেন অনেক বেশি সংখ্যক ক্রেতা। তাদের পণ্যগুলো বিক্রি করতে পারছেন দেশের বাইরেও। চলুন এবার জেনে নেই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এমনই ৫টি অনলাইন মার্কেটপ্লেস সম্পর্কে।
১. আমাজন (Amazon)
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস হলো আমাজন। অনলাইন কেনাবেচার সাথে যুক্ত অথচ আমাজনের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই জেফ বেজোস এই অনলাইন মার্কেটপ্লেসটি প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলে এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
প্রথমদিকে অনলাইন বইয়ের দোকান হিসাবে যাত্রা শুরু করে আমাজন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্য থেকে শুরু করে খেলনা, খাবার, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি বিক্রি শুরু হয়। এখন বর্তমানে আমাজনে প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। শুধু এসবই না, আমাজন এখন বিভিন্ন ডিজিটাল পণ্য যেমন সফটওয়্যার, বিভিন্ন মাল্টিমিডিয়া পণ্য, ক্লাউড স্টোরেজ ইত্যাদিও বিক্রি করছে।
নিত্য প্রয়োজনীয় ও ডিজিটাল পণ্যের বাজার ছাড়াও আমাজনের রয়েছে আমাজন মিউজিক, আমাজন গেমস, আমাজন ভিডিও ইত্যাদি নানা ওয়েব সার্ভিস। ‘আমাজন আর্ট’ সেকশনে বিক্রি হয় নানা চিত্রশিল্পীর আঁকা সুন্দর সুন্দর চিত্র। আমাজনের তৈরি কিন্ডল ই-বুক রিডার গোটা বিশ্বেই ব্যাপক জনপ্রিয়। এছাড়াও আমাজনের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন ভিত্তিক ওয়েবসাইটে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বহু ফ্রিল্যান্সাররা উপার্জন করছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের দেশের বহু বেকার যুবকের অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছে এই আমাজন। বর্তমানে বিশ্বের ১৫টি দেশে চালু রয়েছে আমাজন এবং রয়েছে প্রায় ২,২২,০০০ এর বেশি কর্মচারী।
২. ইবে (eBay)
অনলাইন কেনাবেচার জগতে ইবে অনন্য একটি নাম। ‘World’s Online Marketplace’ নামে পরিচিত ইবে তুমুল জনপ্রিয় একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস। ইবের রয়েছে ১৯০টি আলাদা আলাদা অনলাইন বাজার এবং ১৬৭ মিলিয়নের বেশি সক্রিয় ক্রেতা। ‘অকশন ওয়েব’ নামে যাত্রা শুরু করা ইবেতে লিস্টেড সর্বপ্রথম পণ্য ছিল একটি পুরানো লেজার পয়েন্টার। এরপর ধীরে ধীরে নানা পণ্যের বিক্রি ও নিলাম শুরু হয় এখানে।
ইবেতে খুব সহজে কোনো পণ্য কেনার পাশাপাশি বিক্রিও করা যায়। বিক্রেতাদের জন্য এখানে আছে বিক্রেতা সেকশন। এছাড়াও এখানে নিলামের মাধ্যমে পণ্য কেনা বেচার ব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বের ৩০টি দেশে বর্তমানে ইবে চালু রয়েছে। ইবেতে প্রায় সব ধরণের পণ্যই পাওয়া যায়। আলাদা আলাদা পণ্যের জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ রয়েছে এখানে। আমাজনের মতো বিভিন্ন ডিজিটাল পণ্যও বিক্রি হয় ইবেতে। সফটওয়্যার, ভিডিও গেম ইত্যাদি খুব সহজে কেনাবেচা করা যায় ইবের মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে পিয়ের ওমিডিয়ার ইবে প্রতিষ্ঠা করেন। ইবের সদরদপ্তর অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোসেতে।
৩. এটসি (Etsy)
সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিভাবান কারুশিল্পীদের তৈরি নানা জিনিসের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস হলো এটসি। এখানে মূলত হাতে তৈরি জিনিস ও পুরানো জিনিস বেশি পাওয়া যায়। এসব জিনিসের মধ্যে রয়েছে শিল্পীর আঁকানো ছবি, কাপড়, খেলনা, নানা জুয়েলারি সামগ্রী, খাবার ইত্যাদি। ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও কারুশিল্পের জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে এটসি। নানা কুটিরশিল্পী ও কারুশিল্পী যারা তাদের তৈরি জিনিস থেকে কিছু অর্থ উপার্জন করতে চান তাদের সবচেয়ে প্রিয় মার্কেটপ্লেসে পরিণত হয়েছে এটি।
২০০৫ সালে নিউ ইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এই মার্কেটপ্লেসের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫৪ মিলিয়ন। এটসি এখনো পর্যন্ত ৪৫ মিলিয়নের বেশি পণ্য বিক্রি করেছে। এখানে রয়েছে ১.৭ মিলিয়নের বেশি সক্রিয় বিক্রেতা ও ২৮.৬ মিলিয়নের বেশি ক্রেতা।
অন্যান্য মার্কেটপ্লেসের মতো নানা চমকপ্রদ ডিজিটাল পণ্য এখানে পাওয়া না গেলেও এখানে আপনি পাবেন চমৎকার সব কারুশিল্প। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা দেশের কারুশিল্পীর নিপুণ যত্নে তৈরি এসব পণ্য আপনি বাড়ি বসেই কিনতে পারবেন এটসির মাধ্যমে। এ কারণেই এটসির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
৪. আলিবাবা (Alibaba)
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ই-কমার্স প্লাটফর্ম হলো আলিবাবা। চাইনিজ এই কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা, যিনি একসময় ছিলেন একজন ইংরেজি শিক্ষক। নিজের কঠিন পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার পর এখন তিনি বিশ্বের অন্যতম একজন ধনী ব্যক্তি, একজন মিলিয়নার।
৪২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ গত কয়েক বছরে আলিবাবা গ্রুপের ই-কমার্স সাইটগুলোতে পণ্য বিক্রি করে ৪৮৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানিটি ২৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ার বিক্রি করেছে যা জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকের থেকেও বেশি। বিশ্বে ১৯০টি দেশের বিক্রেতাদের পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ করে দিয়েছে আলিবাবা গ্রুপ। আলিবাবা গ্রুপের প্রধান ই-কমার্স সাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে টাওবাও, টিমল, আলি এক্সপ্রেস ইত্যাদি। প্রায় সব ধরনের পণ্যই পাওয়া যায় এসব ওয়েবসাইটে। তবে এই মার্কেটপ্লেসগুলোতে চীনের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। যদিও অন্যান্য দেশের পণ্যসামগ্রীর পরিমাণও এখানে কম নয়।
খুব সস্তায় রকমারি পণ্য পাওয়া যায় বলে আলিবাবা গ্রুপের মার্কেটপ্লেসগুলোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে আলি এক্সপ্রেস ই-কমার্স সাইটটির বহু ব্যবহারকারী আমাদের দেশেও রয়েছে। নিশ্চিত হোম ডেলিভারি ও সুলভ দামে বহু জিনিস পাওয়া যায় বলে আমাদের দেশের বহু ক্রেতা আলি এক্সপ্রেস থেকে তাদের পছন্দের পণ্য ক্রয় করে থাকেন।
৫. বোনানজা (Bonanza)
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই অনলাইন মার্কেটপ্লেসটি ২০১২ সালের মধ্যেই সেরা ই-কমার্স সাইট হিসেবে বহু পুরষ্কার জিতে নিয়েছে। জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস ইবের বিকল্প হিসেবে ধরা হয় বোনানজাকে। বিক্রেতা কেন্দ্রিক এই অনলাইন মার্কেটপ্লেসটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের খুব সহজে অনলাইনে নিজের দোকান তৈরি করে পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। কাপড়, গহনা সামগ্রী, বাসা ও বাগানের নানা প্রয়োজনীয় জিনিস, দুর্লভ বই, ডাকটিকিট, গান ও ভিডিওর সিডি-ডিভিডি, সংগ্রহ করার মতো নানা পুরনো জিনিস ইত্যাদি পাওয়া যায় এই মার্কেটপ্লেসটিতে।
বোনানজার সকল ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন উদ্যোক্তারা। এটি খুব সহজেই এসব উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের তাদের পণ্যের গ্রাহক খুঁজে পেতে সাহায্য করে। বোনানজাতে বর্তমানে ১৫ মিলিয়নের বেশি পণ্যসামগ্রী রয়েছে। এছাড়াও প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি উদ্যোক্তাকে তাদের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দিয়েছে এই মার্কেটপ্লেসটি।
ফিচার ইমেজ – technofaq.org