ইতিহাস থাকে সাহসীদের পক্ষে, ইতিহাসের নির্মাতাও থাকেন সাহসী মানুষেরাই। যান্ত্রিক তাঁত থেকে স্বপ্নের গাড়ি পর্যন্ত উদ্ভাবনের গল্প আমরা বলছিলাম এমন এক সাহসী মানুষকে নিয়ে, তিনি সুজুকি মোটর কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা মিচিও সুজুকি। সেই ১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই শুরু করেছিলেন মোটরচালিত যান তৈরির চিন্তাভাবনা এবং ১৯৩৭ সালে একটি গাড়ির প্রোটোটাইপও নির্মাণ করে ফেলেছিলেন, কিন্তু তখনও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি এর সাফল্য নিয়ে। তাই তাঁত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যানারেই এইসব উদ্ভাবনী কর্মযজ্ঞ চলছিল। আর এভাবেই কেটে যায় দেড় দশকেরও বেশি সময়।
১৯৫৪ সালে সুজুকি মোটর সাইকেল তৈরির ক্ষেত্রে বড় রকমের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং তখন তার প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে ৬,০০০ মোটরসাইকেল প্রস্তুত করতে শুরু করে। এরপর তিনি পাল্টে ফেলেন কোম্পানির নাম। ‘সুজুকি লুম ম্যানুফ্যাকচারিং’ পরিবর্তন করে নাম রাখেন ‘সুজুকি মোটর কর্পোরেশন লিমিটেড’।
মোটরযান নির্মাণের কঠিন এই রেসট্র্যাকে এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৫ সালে আরেক ব্যবসাসফল মোটরসাইকেল ‘কোলেডা’ বাজারে আনার পর সুজুকি মোটর হাত বাড়ায় আরও বড় কিছুর দিকে। ওই একই বছর তারা বাজারে আনে ‘সুজুলাইট’, যেটি কিনা জাপানে নির্মিত প্রথম লাইট অটোমোবাইল।
নতুনত্বকে বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে সুজুকি। মোটরসাইকেলের বাজারে যেমন প্রথম আগমনেই তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, সেই একই ধারা অব্যহত ছিল অটোমোবাইল শিল্পে প্রবেশের পরও। ‘সুজুলাইট’ অটোমোবাইলটিতে ছিল ফ্রন্ট হুইল ড্রাইভ আর চার হুইলের ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাসপেনশন। সেইসাথে ছিল র্যাক অ্যান্ড পিনিয়ন স্টিয়ারিং; এই ফিচারটি পরবর্তী অর্ধশতকেও বাজারের অন্যান্য অধিকাংশ অটোমোবাইলে পাওয়া যেত না।
‘সুজুলাইট’ এর অভাবনীয় সাফল্য সুজুকি মোটরকে অটোমোবাইলের বাজারে প্রবল পরাক্রমশালী করে তোলে। এই সাফল্যকে স্মরণীয় করে রাখতে তারা ইংরেজি ‘S’ অক্ষরটিকে তাদের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে তারা বাজারে আনে ৩৬০ সিসি ও দুই সাইকেলের ‘সুজুলাইট’। এর বছর দুয়েক বাদে তারা আইচিতে লাইটওয়েট ট্রাক নির্মাণের কারখানা স্থাপন করে এবং ‘সুজুলাইট ক্যারি’ নামে তাদের প্রথম লাইটওয়েট ট্রাক বাজারে আনে। এরপর থেকে তারা নিয়মিতই নতুন নতুন মডেলের বাণিজ্যিক যান (ট্রাক, পিক-আপ ভ্যান প্রভৃতি) বাজারজাত করতে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে সুজুকির পৃথক কোনো অটোমোবাইল প্ল্যান্ট ছিল না। প্রথম অটোমোবাইল বাজারজাতকরণের ১৫ বছর পর, ১৯৭০ সালে তারা শিজুকায় গড়ে তোলেন অটোমোবাইল কারখানা।
সুজুকি মোটরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, জিতসুজিরো সুজুকির ভাষায়, তাদের কোম্পানির লক্ষ্য হলো: ‘ভ্যালু প্যাকড প্রোডাক্টস’, যার মাধ্যমে ক্রেতারা সম্ভাব্য সর্বনিম্ন মূল্যে সেরা পণ্যের নাগাল পায়। তাদের গাড়ির উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এবং ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও উন্নয়নশীল দেশের ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে গাড়িগুলো উৎপাদন করায়, সুগম হয় সুজুকি মোটরের বিশ্বায়নের পথ।
১৯৬৩ সালে সুজুকি মোটর দেশের বাইরে তাদের প্রথম শাখা খোলে। লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রতিষ্ঠিত করে ইউএস সুজুকি মোটর কর্প। পরবর্তী দুই দশক ধরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সুজুকি বিস্তার লাভ করতে থাকে। ১৯৬৭ সালে থাইল্যান্ডে, ‘৭৩-এ কানাডায়, ‘৭৪-এ ইন্দোনেশিয়ায়, ‘৭৫-এ ফিলিপাইনে, ‘৭৯-তে যুক্তরাজ্যে, ‘৮০-তে অস্ট্রেলিয়ায়, ‘৮২-তে পাকিস্তানে, ‘৮৩-তে ভারতে, ‘৮৪-তে নিউজিল্যান্ডে, ‘৮৫-তে স্পেনে, ‘৮৭-তে কলম্বিয়ায়, ‘৯১-এ কোরিয়ায়, ‘৯৩-এ মিশরে, ‘৯৬-এ ভিয়েতনামে এবং ‘৯৮-এ চীনে যাত্রা শুরু করে সুজুকি মোটর।
১৯৮১ সালে সুজুকি প্রথমবারের মতো অন্য একাধিক যানবাহন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে জোটবদ্ধ হয়। তারা অংশীদারিত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মোটরস ও জাপানের ইসুজু মোটরস লিমিটেডের সাথে। ১৯৯০ সালে সুজুকি তাদের নামের শেষের লিমিটেড বাদ দিয়ে কেবল ‘সুজুকি মোটর কর্পোরেশন’-এ পরিণত হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে জেনারেল মোটরস তাদের ৯২.৩৬ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি করে দেয় এবং তাদের অংশীদারিত্ব মাত্র ৩ শতাংশে নামিয়ে আনে।
সুজুকি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভারতে তাদের ব্যবসা শুরু করার পর থেকে। ‘মারুতি সুজুকি ইন্ডিয়া লিমিটেড’ হয়ে উঠেছে ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানি। দেশটির যাত্রীবাহী গাড়ির পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন করে এই কোম্পানিই। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘মারুতি সুজুকি’ কোম্পানির ৫৬.৭১% মালিকানা ছিল জাপান ভিত্তিক সুজুকি মোটরের।
সুজুকি মোটরের ব্যবসায়িক দর্শনের সর্বাগ্রে রয়েছে ক্রেতার চাহিদা থাকায়, সেই চাহিদা মেটাতে তারা সবসময়ই সচেষ্ট রয়েছে। চলতি শতকের শুরুর দিকে জাপানে ছোট গাড়ির চাহিদা বাড়তে থাকায়, তারা জাপানের বাজারে আনে প্রথম হাইব্রিড গাড়ী ‘কেই কার’ (ছোট গাড়ি)। ভারতের বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা মাথায় রেখে তারা শুধু ভারতীয়দের জন্য বাজারে আনতে থাকে সব সময় ব্যবহার করা যায় এমন সাশ্রয়ী দামের গাড়ি। আবার রেসিংপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে তারা নির্মাণ করছে বিভিন্ন অ্যাডভান্সড স্ট্রিট, অফ-রোড ও চ্যাম্পিয়নশিপ রেসিং গাড়িও। এদের মধ্যে রয়েছে ‘সুইফট’, ‘জিমনি’, ‘বেলানো’, ‘ভিটারা’, ‘ইগনিস’ প্রভৃতি মডেলের গাড়ি।
উত্তর আমেরিকায় সুজুকি বাজারে আনে প্রথম চার হুইলের এটিভি- ‘কোয়াড রানার এলটি ১২৫’, প্রথম চার দরজার মিনি এসইউভি- ‘সুজুকি সাইডকিক’, এবং প্রথম কমপ্যাক্ট এসইউভি- ‘গ্র্যান্ড ভিটারা এক্সএল ৭’। এছাড়া ২০০২ সালে সুজুকি প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিয়ে আসে ‘আমেরিকা’স #১ ওয়ারেন্টি’, যেখানে ১,০০,০০০ মাইল/৭ বছর পাওয়ারট্রেইন লিমিটেড ওয়ারেন্টি দেয়া হয়। অন্যান্য গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানিও সুজুকি মোটরের দেখাদেখি দ্রুত এই আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে।
২০০৭ সালে উত্তর আমেরিকার বাজারের জন্য সুজুকি মোটর নিয়ে আসে একটি এক্সক্লুসিভ মডেল – ‘এক্সএল ৭’, যাতে বেশ কিছু বিলাসবহুল ফিচারের সংযোজন করা হয়। গাড়িটিতে ছিল ২৫২ হর্সপাওয়ারের ভি-৬ ইঞ্জিন। এছাড়াও ছিল সাতজন যাত্রী বসার উপযোগী আসন ব্যবস্থা, অল-হুইল ড্রাইভ, রিয়ার-সিট ডিভিডি সিস্টেম ও টাচ-স্ক্রিন নেভিগেশনের সুবিধা।
২০১৬ সালে ‘উৎপাদনের দিক থেকে’ সুজুকি মোটর বিশ্বের এগারতম শীর্ষ অটোমেকার কোম্পানি ছিল। এই মুহূর্তে এই কোম্পানিতে সব ধরনের পদ মিলিয়ে কর্মরত রয়েছেন ৪৫,০০০ জন কর্মী। ২৩টি দেশে কোম্পানিটির মোট ৩৫টি উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে, এবং ১৩৩টি ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে ১৯২টি দেশে সুজুকি মোটরের উৎপাদিত মোটরযান পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ‘বিক্রিত অটোমোবাইলের পরিমাণ অনুযায়ী’ সুজুকি মোটর বর্তমানে বিশ্বের দশম শীর্ষ অটোমেকার কোম্পানি, আর জাপানে তাদের অবস্থান তৃতীয়।
এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮ এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী সুজুকি মোটরের বিক্রিত অটোমোবাইলের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ ইউনিট। এবং এর মধ্যে ৫৫.১৯ শতাংশ বিক্রি হয়েছে ভারতে, আর জাপানে হয়েছে ২০ শতাংশ। গত অর্থবছর পর্যন্ত জাপানে সুজুকি মোটরের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ছিল ‘ওয়্যাগন আর’, ‘স্পেসিয়া’ ও ‘সুইফট’। অন্যদিকে, ভারতীয়দের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল ‘বেলানো’, ‘সুইফট’, ‘ডিজায়ার’ ও ‘ব্রেজা’।
অটোমোবাইল বিক্রির পরিমাণে সুজুকি এগিয়ে রয়েছে বিএমডব্লিউ আর মার্সিডিজের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোর থেকেও। চলতি দশকের শুরুর দিকে সুজুকি বছরে বিশ লক্ষাধিক অটোমোবাইল বিক্রি করত। সর্বশেষ ২০১৮ অর্থবছরের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ত্রিশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে!