‘দ্যা ট্রাকিস্কি কালাইদঝি’ বা ‘দ্যা টিন্সমিথস অব থ্রেস’ হল ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো ঐতিহ্য অনুসরণকারী এক জনগোষ্ঠীর নাম। তারা এখনও বলতে গেলে যাযাবর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাসের বদলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নিজেদের আবাস গড়ে তোলাতেই তাদের আনন্দ।
এই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি পরিচিতি যে কারণে, তা হল তাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ ‘ব্রাইড মার্কেট’ এর জন্যে। মার্কেট কেন বলছি? জানলে আপনিও অবাক হবেন। নির্মম হলেও সত্যি, এই জনগোষ্ঠীর বাবা-মায়েরা তাদের বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিক্রি করেন এই মেলায়, দাঁড়িয়ে থেকে মেলায় মেয়ের জন্য দর হাঁকেন। কিন্তু শর্ত, কুমারিত্ব নষ্ট হলে মেলায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বুলগেরিয়ার এই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে যে মেলা জড়িয়ে আছে তা বড়ই অদ্ভুত! তাদের বিবাহ ইচ্ছুক কুমার-কুমারীরা নিজেদের জনগোষ্ঠীর বাইরে অন্য কাউকে বিয়ে করার নিয়ম নেই। এমনকি বিয়ের আগে ছেলে-মেয়েরা বাইরে কোথাও দেখা করতেও যেতে পারে না। অল্প বয়সেই মেয়েদের বাইরে যাওয়া এমনকি পড়াশুনা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়ে থাকে। তাই সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মেয়ে থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা এ মেলায় অংশ নেন স্রেফ জীবনসঙ্গীকে খুঁজে বের করতে। শুধুমাত্র এই ব্রাইড মার্কেটে যদি তাদের জীবন সঙ্গী মেলে তবেই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পান।
আসলে বুলগেরিয়ার স্তারা জাগোরা নামে এই অঞ্চলের রোমা জনগোষ্ঠীর মহিলারা এভাবেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বুলগেরিয়াতে এদেরকে অনেকে কালাইদঝি বলেও ডাকে। তারা মূলত তামার বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে থাকে। এটাই এদের রুজি-রুটি। দারিদ্র্য আর অনটন এদের নিত্যসঙ্গী। ফলে, বিবাহের মতো ব্যয়বহুল আনুষ্ঠানের আড়ম্বর এদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই, এ জনগোষ্ঠীর জন্য এই মেলাই হচ্ছে জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পাওয়ার একমাত্র জায়গা।
মেলাটি অনুষ্ঠিত হয় শহরের বাইরে বিশাল এক মাঠে, যেখানে পুরাতন এবং নতুন ফ্যাশানের সাজে উপস্থিত হয় তরুণীরা। কালাইদঝি তরুণীরা ব্রাইডের বেশে চুলকে সজ্জিত করে, লং ভেলভেট স্কার্ট আর রং-বেরঙের হেড স্কার্ফ সাথে গা ভর্তি গয়না দিয়ে সাজিয়ে তোলে নিজেদের।
মোটকথা, মেয়েদের সাজ-সজ্জায় থাকে জাঁকজমকপূর্ণ মেক আপ, টাইট ও চটকদার ড্রেস যেন দেখতে একদম একজন মডার্ন বুলগেরিয়ান তরুণীর মতই মনে হয়। কারণ, কোন পাত্রী কেমন দর পাবেন, তা নির্ভর করে তাঁর সৌন্দর্য থেকে শুরু করে সাজপোশাক, আচার ব্যবহারের উপরে। পাত্রীর সাজে মেলায় আসা মহিলাদের শুধু পছন্দ করলেই হবে না, পুরুষদের এর জন্য খসাতে হয় ট্যাঁকের কড়িও। কারণ, যে পুরুষের যে মহিলাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পছন্দ হবে, তার জন্য তাকে যথার্থ দাম দিতে হয়। কয়েক লক্ষ টাকা পর্যন্ত দর ওঠে মেলায় পাত্রী হিসাবে যোগ দেওয়া নারীদের।
মেলায় এসবের পাশাপাশি আরও যুক্ত হয় অন্যান্য সামাজিকতা। খাবারের দোকানের ও কমতি পড়ে না বটে। খাবারের দোকানগুলোতে পশরা সাজিয়ে বসে গ্রিল করা মাংস এবং বিয়ার। তবে এসব দোকান তখনই জমজমাট হয় যদি তরুণীর পরিবার বিশেষ করে তার পিতা, পাত্রপক্ষের সাথে একমত হতে পারেন। তরুণ-তরুণীর পছন্দের পাশাপাশি টাকা-কড়ির ব্যাপারটাই মুখ্য। এখানে নাবালক দম্পতি দণ্ডণীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না। ফলে, ১৩ বছরের মেয়ের সমবয়সি পুরুষসঙ্গী এখানে একেবারেই বিরল নয়। এমনও দেখা গিয়েছে, বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েকে অল্প বয়সেই এই মেলায় অংশগ্রহণের জন্য নিয়ে এসেছে। কারণ, তাদের ধারণা, বেশি দেরি করলে হয়তো ছেলে-মেয়েকে সারা জীবন চিরকুমার বা চিরকুমারী হয়েই কাটাতে হবে। বছরে চার বার এই মেলা বসে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বসন্তের মেলা।
ভাসিলকা টডরভা নামে এক কৌতূহল বশত হয়ে এই মেলা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, এই ঐতিহ্য কালাইদঝি জনগোষ্ঠীদের আরও পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি মোটেও এই ব্রাইডাল বেচা-কেনার পক্ষে নন। তিনি আরও বলেন যে, কালাইদঝিরা তাদের মেয়েদের মার্কেটে নিয়ে গিয়ে এমন ভাবে দর হাঁকেন যেন তারা মেলায় ঘোড়া বিক্রি করতে এসছেন। ভাসিলকা-র মনে হয়েছে, মেলাটি ঠিক একটা পশু বিক্রির হাটের মতন। শুধু পার্থক্য হল, এখানে ক্রেতারা কেবল ‘ওর দাম কত?’ এই কথাটাই উহ্য রাখেন।
মেলার নিয়ম অনুসারে, মেয়েরা যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন অথবা মেলার জন্য প্রস্তুত মঞ্চেও নিজেদের পাত্রী হিসাবে তুলে ধরতে পারেন। মঞ্চে ওঠা মেয়েদের জন্য নিলামের মতো দরও হাঁকাহাঁকি করা হয়। আবার পুরুষরা মঞ্চে থাকা মহিলাদের সঙ্গে সেখানে নাচ-গানেও অংশ নিতে পারেন যাচাই করার লক্ষ্যে। এর পর পরই পছন্দের মহিলার জন্য দরাদরি করতে পারেন তিনি।
একজন বুলগেরিয়ান নৃতত্ত্ববিদ ভেল্কো ক্রুস্টেভ এই মেলা সম্পর্কে বলেন, এই মেলায় ম্যাচমেকিং এর মূলমন্ত্র হল ‘অর্থ’। এটা ঠিক এমন মনে হয় না যে পুরুষরা তাদের পছন্দের পাত্রী খুঁজছেন তাদের স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্যে। ব্রাইডের দাম মূলত নির্ধারণ হয়, ‘ব্লাড ফর দ্যা ফাদার’ মূলমন্ত্রে। অর্থাৎ কুমারীর পিতাদের মূলত গ্যারান্টি দিতে হয় যে তার কন্যা আসলেই ভার্জিন। এর পেছনে আসলে যে কারণ দাঁড়ায় তাতে করে এটাই বলতে হয়, বিবাহ ইচ্ছুক পুরুষেরা এতে করে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সন্তানেরা সত্যিই একমাত্র তারই সন্তান।
ক্রুস্টেভ আরও বলেন যে এই বেচা কেনার মাধ্যমে আসলে পুরুষরা ব্রাইড কেনা অপেক্ষা তরুণীর সম্মানটুকুই কিনে নেন বলেই তার মনে হয়েছে। আর সাথে সাথে তরুণীর স্বামীর পরিবার তাদের অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরের দাবিটুকুন কিনে নেন তাদের পুত্রবধূর কাছ থেকেই।
বেচা কেনার ডিল আসলে মেলাতেই পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়ে যায় না। এরকম অসংখ্য সামাজিকতায় আবিষ্ট আলাপচারিতা দু’পক্ষের মাঝেই চলতে থাকে মাসের পর মাস। ক্রুস্টেভ বলেন, তরুণীর পরিবার আসলে বিক্রির দাম ‘অর্থ’ হিসেবে পায় না। তা পরবর্তীতে গিফট বা আর্থিক সহায়তায় পরিণত হয়। এক্ষেত্রে তরুণীর পরিবারের উচ্চমানে হাঁকা দাম আসলে এটাই প্রমাণ করে যে, তার হবু জামাতা ঐ পরিমাণ আর্থিক সাহায্য দিতে আসলেই সমর্থ কিনা।
এইভাবে চলমান ব্রাইড মেলার আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়। ব্রাইড মেলায় অংশগ্রহণকারী এক ব্যাচেলর পেটকো কলেভ। তিনি খুব সম্ভবত ১০ বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে। বিশ্বজনীন আর্থিক সংকট সন্ধিক্ষণ বুলগেরিয়াতে প্রভাব ফেললেও কিন্তু তরুণীদের পরিবারের প্রত্যাশাতে ভাটা পড়েনি একেবারেই। দিনকে দিন তাদের দাম দর বেড়েই চলেছে হু হু করে। এই নিয়ম বহু তরুণ পরিবারকে দরিদ্র্য করে দিলেও, তরুণী পরিবারের দাম হাঁকার প্রতিযোগিতার ধাঁচের দর পতন ঘটেনি মোটেও। গড়পড়তা বুলগেরিয়ান তরুণীদের দাম সর্বনিম্ন শুরু হয় সাত হাজার ডলার থেকে। তরুণী যদি অসাধারণ সুন্দরী হন, তবে এই দাম গিয়ে ঠেকে বিশ হাজার ডলারের কোঠায়।
বুলগেরিয়ান বিবাহযোগ্য তরুণ কোলেভ বলেন, তিনি চাইলেই এইসব বাজে নিয়ম শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে বাইরের কোনও তরুনীকে জীবন সঙ্গিনী করে নিতে পারতেন। কিন্তু তাতে তার পরিবারের লোকজন, পিতামাতা কষ্ট পাবেন। একমাত্র এ জন্যই তাকে এই ঐতিহ্যের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। তিনি চান না তার পিতা মাতাকে আঘাত দিতে। কারণ এটি অনেক পুরনো সংস্কৃতি। আর তারা তাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক প্রত্যাশা নিয়েই কষ্ট করে মানুষ করেছেন। তাদের মন ভেঙে যায় এমন কোনও কাজ তাই তিনি করতে পারবেন না। কোলেভ এও বলেন যে, তিনি কোনো অসাধারণ সুন্দরীর খোঁজ করছেন না, তিনি আসলে এমন কাউকে খুঁজছেন যে মনের দিক থেকেই অসাধারণ সুন্দরী, যিনি অন্তরাত্মার সৌন্দর্যের আলোয় উদ্ভাসিত।
নৃতাত্ত্বিক ভেল্কো ক্রুস্টেভ বলেন, কালাইদঝি জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ এই রীতিনীতিতে বিশ্বাসী হলেও ইদানিং তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীরা তাদের পছন্দে বিয়ে করতে শুরু করেছেন যা আগের ট্রেডিশানের ছেলে মেয়েরা করতেই পারত না। এখনকার জনগোষ্ঠীর তরুণ সমাজ পরিবারের মত অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ে উভয়ের পছন্দ মত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। এটা একটা বিশাল পরিবর্তন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রাইড দর-দাম এখন একটা সিমবলিক ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে মাত্র।
আসলে এই ব্যাপক পরিবর্তনের মূলে রয়েছে প্রযুক্তির প্রভাব। এই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সাথে মিশতে শুরু করেছে। সাথে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব। কিন্তু তারপরও আগের যুগের সংস্কৃতিমনা কালাইদঝি জনগোষ্ঠীর লোকেরা এটিকে সহজভাবে গ্রহন করতে পারছেন না। তারা মনে করেন, এতে তাদের সংস্কৃতির বিনাশ ও বিলুপ্তি ঘটবে।