“ভবিষ্যতে রোবটরা আপনার চাকরিকে নিয়ে নেবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার মস্তিষ্ককে হ্যাক করে ফেলবে- এবং এই ভবিষ্যতটাও খুব দূরে নয়”, বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি এমনটাই বলছেন তার নতুন বই ‘টুয়েন্টি ওয়ান লেসন্স ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’-তে।
কিন্তু আপনি কেন তাকে বিশ্বাস করবেন? কারণ তিনি তার পুরো ক্যারিয়ারই গড়ে তুলেছেন ইতিহাসকে পড়ে, মানুষ নিয়ে গবেষণা করে। হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেমের এই ইতিহাসের প্রফেসর ইতোমধ্যে তিন-তিনটি আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার বই লিখে ফেলেছেন শুধু মানুষকে নিয়েই। তিনি তার প্রথম বই ‘সেপিয়েন্স’-এ দুনিয়া কাঁপিয়েছেন মানবজাতির ইতিহাসকে সহজ ভাষায় লিপিবদ্ধ করে, তার পরের বই ‘হোমো ডিউস’-এ তিনি লিখেছেন আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে, এবং তার এই বইটি কথা বলছে বর্তমান নিয়ে, কী হচ্ছে এই বর্তমানে এবং তা আমাদের জন্য কী অর্থ বহন করে।
তার মতে, প্রযুক্তির নতুনত্ত্ব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতটাই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে, এর দূরপাল্লার ফলাফল কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। (১৫ বছর আগে ফেসবুক বলে কিছু ছিলই না, সেই ফেসবুকই এখন সরাসরি প্রভাব ফেলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে, ঘটিয়ে ফেলছে আরব বসন্তের মতো ঐতিহাসিক বিপ্লব। ভেবে দেখুন, আরও ১৫ বছর পরে এই ফেসবুকের প্রভাব কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে।) তিনি বলছেন, অটোমেশনের মুখে আমরা আমাদের বর্তমান চাকরিকে একসময় হারিয়ে ফেলবো। তারপর যে চাকরিই নেই না কেন, অটোমেশন সেই চাকরি একসময় কেড়ে নিবেই। একসময় আমাদের জীবনের সম্পূর্ণটাই নিয়ন্ত্রণ করবে অ্যালগরিদম, আমাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বা সত্ত্বাই হারিয়ে যাবে।
আর এসব হুমকির মুখে আমাদের কী কী দক্ষতা প্রয়োজন? দরকার এমন মানসিক নমনীয়তা এবং সংস্কারহীনতা, যাতে প্রতি দশকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি নিজেদেরকে। আরও দরকার নিজেকে এমনভাবে জানা যে, প্রযুক্তি আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে।
এসব নিয়েই ইউভাল নোয়াহ হারারি কথা বলেছিলেন ‘জিকিউ’ ম্যাগাজিনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে।
আপনার লেখায় আপনি বলছেন, বর্তমান পৃথিবীর ভবিষ্যত সম্পর্কে একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার হচ্ছে এটি অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তার প্রভাব আমাদের উপর কেমন হতে পারে?
আপনি যদি খুব বেশি বৃদ্ধ না হয়ে থাকেন, এটা খুবই সম্ভাব্য যে আপনার পরবর্তী দশকগুলোতে নিজেকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে, পেশা পরিবর্তন করতে হবে বেশ কয়েকবার।
অনেকে ভাবেন, দুনিয়া হয়তো একবারই পরিবর্তন হবে, বড়সড় বিপ্লব হয়ে যাবে কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে। ধরুন, সেটা ২০২৫, যেখানে আমরা দেখবো রোবটরা আমাদের ৬০% চাকরি নিয়ে নিয়েছে। তারপর কয়েকবছর আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে, তারপর দেখবো আবার নতুন নতুন চাকরি তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে, একসময় অর্থনীতি একটি নতুন ধরনের সাম্যাবস্থায় চলে আসবে।
কিন্তু এই চিন্তার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে, এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছে যাবে ২০২৫ এই। তারপরও যে পরিবর্তন হতে পারে, সেটা ভাবা হচ্ছে না। হ্যাঁ, ২০২৫ সালে গিয়ে আমরা দেখবো অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ২০৩৫ সালের পরিবর্তন হবে তার থেকেও বড়, ২০৪৫ সালেরটা তার থেকেও, আর মানুষকে এই প্রত্যেকটি পরিবর্তনের সাথে নিজেকে সমন্বিত করে নিতে হবে।
একে মোকাবেলা করা জন্য আপনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আসলে এ ধরনের সমস্যার সামনে আমাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। আপনি যদি অনেক বিত্তবান হন, তখন হয়তো আপনার এসব সমস্যার প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে অনেক পুঁজি আছে, সম্পদ আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আসলে এক্ষেত্রে অনেক সাহায্যের দরকার। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে হচ্ছে পর্যাপ্ত ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এবং মানসিক ভারসাম্য, কারণ সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো এক্ষেত্রে হবে মনস্তাত্ত্বিক।
রোবটদের কাছে চাকরি হারিয়ে আপনি যদি নতুন চাকরিও পান, কিংবা সরকারই আপনাকে ভরণপোষণ করে, তখনও এ ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে আপনার প্রচুর মানসিক শক্তি থাকতে হবে। কৈশোরে বা তারুণ্যে পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা ভালো থাকে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর, অর্থাৎ যখন আপনার বয়স ৪০ বা ৫০, তখন কিন্তু পরিবর্তন আপনার জন্য বেশ পীড়াদায়ক হবে। এ সময় আপনার মানসিক শক্তি যদি সাথে থাকে, তবেই আপনি পারবেন ৩০, ৪০ বা ৫০ বছর বয়স পেরোবার সময় প্রতিবারই নতুন একটি পৃথিবীর মুখোমুখি হতে। এখন মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ আসলে কোনো নির্দিষ্ট দক্ষতা নয়, কম্পিউটার কোডিং পারা বা ম্যান্দারিন ভাষায় দক্ষ হওয়ার চেয়ে মানসিকভাবে নমনীয় হওয়া এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তনের প্রতি স্বচ্ছন্দ করে তোলা অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এখন।
কিন্তু এরকম মনস্তত্ত্ব একজন মানুষ কীভাবে তৈরি করতে পারেন?
আমি ধ্যান করি, বিপাস্যনা (একধরনের বৌদ্ধিক ধ্যান) করি। আমি প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে ধ্যান করে থাকি। আমি প্রায়ই প্রশান্তির জন্য নিভৃতে চলে যাই, প্রতি বছরে ৬০ দিন আমার ধরা থাকে এর জন্য। আমার জন্য এ ব্যাপারটি কাজ করে। তবে আমার জন্য কাজ করে বলেই সবার জন্য কাজ করবে ব্যাপারটি সেরকম নয়। একেকজনের জন্য কার্যকরী হবে একেকটি প্রক্রিয়া। কেউ কেউ থেরাপি নেন, কেউ শিল্পে মনোনিবেশ করেন, কেউ খেলাধুলায়। এমনও হতে পারে আপনি এক সপ্তাহ পাহাড়ে হাইকিং করলেন এবং এতেই মনে হলো আপনার মন অনেক নমনীয় হয়েছে আগের থেকে। সুতরাং এই ব্যাপারটি পুরোই ব্যক্তিসাপেক্ষ, আমার মনে হয় না সার্বজনীন কোনো উত্তর আছে এখানে।
তবে আমাদের সবসময়ই এগুলোর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেদের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে- আমরা আমাদেরকে নিজেদেরকে আরো ভালো করে জানার চেষ্টা করছি এবং মানসিক নমনীয়তা অর্জনের চেষ্টা করছি। এটা আমাদের কোনো শখ হিসেবে না, জীবনের অন্যতম একটি মূল কাজ হিসেবেই করা উচিত। আগামী দশকগুলোতে এই দক্ষতাই আপনার জন্য হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
এখানে একটি বাস্তবিক উদাহরণ আমি যদি না দেই তবে এই কথাগুলো শুনতে খুব বেশি তাত্ত্বিক শোনাতে পারে। ধরুন, আপনি একটি ব্যাংকে কাজ করেন এবং বেশ সফল ক্যারিয়ারও গড়ে ফেলেছেন আপনি ইতোমধ্যে। কিন্তু আজ থেকে ১০ বছর পর আপনি দেখলেন আপনার কাজগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আপনার থেকে বেশি পাকা হয়ে গিয়েছে। আপনি স্টক এক্সচেঞ্জের হিসাব নিকাশ করতেন, কিন্তু অ্যালগরিদম সেই হিসাব এখনো আরো নিখুঁতভাবে কম সময়ে করতে পারে এবং তাকে কোনো বেতনও দেয়া লাগে না। সুতরাং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাার কাছে আপনি আপনার চাকরি হারিয়ে ফেললেন। তখন আপনার অন্য কোনো চাকরিতে যেতে গেলে গত ১০ বছরে যা কিছু অর্জন করেছেন সব ভুলে গিয়ে নতুন করে অনেক কিছু শিখতে হবে। শুধু দক্ষতার দিক দিয়েই না, আপনাকে পিছনে ফিরে যেতে হবে আরো অনেক অনেক দিক থেকে। এমন অবস্থাও দাঁড়াতে পারে যে আপনি যা শিখেছেন এবং অর্জন করেছেন তা ত্যাগ করলেও হচ্ছে না, আপনার নিজের প্রতি নিজের যে ধারণা ছিল, তাও বদলাতে হচ্ছে। আপনি তখন আর জানেন না আপনি আসলে কী করেন, সমাজে আপনার পরিচয় কী। তাই এসব পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য আপনার প্রচুর মানসিক নমনীয়তা এবং ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স দরকার।
আপনার কাজ প্রযুক্তির সাথে আপনার সম্পর্ককে কীভাবে পরিবর্তিত করেছে?
আমি কোনো স্মার্টফোন ব্যবহার করি না। আমার মনোযোগ আমার কাছে আমার অন্যতম বড় একটি সম্পদ এবং সেই মনোযোগকে আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকে কেড়ে নেবার জন্য এই স্মার্টফোনটি সবসময় মুখিয়ে থাকে। সবসময়ই সেখানে নতুন কিছু না কিছু আসছে।
আমি প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ব্যবহারের উদ্দেশ্য কি আমি নিজে ঠিক করছি নাকি প্রযুক্তিই ঠিক করে দিচ্ছে সে ব্যাপারটি সবসময় খেয়াল করি। প্রযুক্তি কিন্তু প্রায়ই ঠিক করে দেয় আমরা কী উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করছি। ধরুন, আপনার একটু অবসর আছে, ইউটিউব খুললেন, দু’ঘন্টা পর দেখা যাবে আপনি এখনো ইউটিউবেই পড়ে আছেন, দেখছেন ফানি ভিডিও বা গাড়ির এক্সিডেন্ট বা এ ধরনের কিছু। আপনি কিন্তু কখনোই সিদ্ধান্ত নেননি যে পরবর্তী দু’ঘন্টা আপনি এসব ভিডিও দেখে কাটাবেন, প্রযুক্তিই আপনার হয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে দিয়েছে। আপনার মনোযোগকে তারা এত নিপুণভাবে কেড়ে নিয়েছে যে আপনি টেরই পাননি।
এই মনোযোগ কেড়ে নেয়া প্রযুক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাটা আপনার জীবনমানকে কীভাবে বদলে দিয়েছে?
আমার জীবনে এখন অনেক সময়। এবং সেই সময়টা শান্তিপূর্ণও বটে। আসলে এটা তো গোপন কোনো ব্যাপার নয়। প্রযুক্তি তো কোনো শান্তিপূর্ণ আবেগ দিয়ে আপনার মনোযোগ কাড়তে পারবে না, তারা এটা করবে আপনাকে উত্তেজিত করে, আপনার মনে ভয়, ঘৃণা বা ক্রোধের উদ্রেক করার মাধ্যমে, কিংবা আপনার লোভকে ইন্ধন দেবার মাধ্যমে। ধরুন, কেউ যদি ইমিগ্র্যান্টদের মনে মনে ভয় পায় বা ঘৃণা করে, প্রযুক্তির অ্যালগরিদম ইমিগ্র্যান্টদের নেতিবাচক দিক নিয়ে একের পর এক ভিডিও দেখাতে থাকবে। আবার, কেউ ধরুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একদমই পছন্দ করে না, তারা প্রযুক্তির বশবর্তী হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাম্পের খারাপ কাজের ভিডিও দেখবে এবং তার ক্রোধ বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। এবং এই খবরগুলো যে সত্য হওয়া লাগবে এমনও না- একজন যদি হেডলাইন দেখে যে “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন পৃথিবী সমতল”, তারা সেই নিউজে বা ভিডিওতে ক্লিক করবেই।
এসব আপনার মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য, কারণ মানুষ হিসেবে এখানেই আপনার দুর্বলতা। কিন্তু আপনি যদি আপনার দুর্বলতার কাছে হেরে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা এগুলোই পড়ে বা দেখে কাটিয়ে দেন তবে প্রকৃতপক্ষে আপনি নিজেই নিজেকে রাগান্বিত এবং ঘৃণাপূর্ণ করে তুলছেন। আর এই ব্যাপারটা আরো ভয়ংকর হয় তখনই যখন আপনি যেসব ভিডিও দেখছেন বা খবর পড়ছেন এগুলো যদি বেশিরভাগই সত্য না হয়। কিন্তু এটাই বাস্তবতা, সামাজিক মাধ্যমে যেসব খবর আপনি পাচ্ছেন তার অনেকটুকুই সত্য নয়, বানোয়াট। অথচ আপনি শুধু শুধুই কয়েক ঘন্টা ধরে নিজের মাঝে ঘৃণা এবং রাগের উদ্রেক করেছেন।
লোভের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একইরকম। আপনি যদি খুব করে একটা কিছু চান, একটি আলিশান বাড়ি বা সুন্দর গাড়ি, তখন আপনি এগুলো নিয়ে বানানো ভিডিও দেখবেন এবং সেগুলোকে আরো বেশি করে চাবেন। কিন্তু আপনার যেহেতু সেসব থাকবে না, আপনার নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতা আরো বাড়তে থাকে যে আপনার এরকম বাড়ি নেই, এরকম গাড়ি নেই। সুতরাং দেখা যাবে আপনি আপনার লোভকে এক ঘন্টা কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে আরো বাড়ালেন, যে ব্যাপারটি আপনার জন্য মোটেও ভালো হলো না।
আপনি নিজেকে যতটা ভালো করে জানবেন, প্রযুক্তির এই ভয়াল থাবা থেকে নিজেকে ততটা নিরাপদ রাখতে পারবেন আপনি। আপনি যদি জানেন যে আপনার কী কী দুর্বলতা আছে, কী কী লোভ আছে, এই রাগ ঘৃণা লোভের বশবর্তী অবশ্যই তুলনামূলকভাবে কম হবেন আপনি। অ্যালকোহলিক বা ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে যেমন নেশামুক্ত হবার প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের কাছে স্বীকার করা যে, “আমি ধূমপায়ী বা অ্যালকোহলিক এবং এটা আমার জন্য খারাপ”, এ ব্যাপারটিও অনেক তেমনই।
তাহলে আপনি খবর পান কোথা থেকে?
প্রতিদিনের নিউজ আমি খুব কমই অনুসরণ করি। আমি বরং নিজেদের পছন্দের জায়গাগুলো নিয়ে বড় বড় বই পড়ে থাকি। চীনা অর্থনীতি সম্পর্কে ১০০টা ছোট ছোট খবর পড়ার থেকে আমার কাছে চীনা অর্থনীতি সম্পর্কে লেখা একটি বড় বই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলাকে বেশি ভালো মনে হয়। সেক্ষেত্রে আমি হয়তো প্রতিদিনের খবরে থাকা অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেইল মিস করবো, কিন্তু আমি তো কোনো রাজনীতিবিদ নই, সাংবাদিকও নই, তাই অতটুকু মিস করাটা আমার কাছে তেমন বড় সমস্যা বলে মনে হয় না।
কিন্তু আমরা কেন আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করতে এতটা অপারগ বলে আপনি মনে করেন? প্রশ্নটা করতে গিয়ে সম্প্রতি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে প্রকাশিত হওয়া নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের একটি ইস্যুর কথা মনে পড়লো আমার। ১৯৮০ সালেই আমরা জানতাম আজকে পৃথিবী এই অবস্থায় আসবে, কিন্তু আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি, আজ আমরাই ভুক্তভোগী হচ্ছি। আমার কাছে বর্তমান সময়টাও অনেকটা একই বলে মনে হচ্ছে, আমরা জানি প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জন্য অনেক সমস্যা নিয়ে আসবে, তারপরও আমরা এর থেকে নিজেদের নিরস্ত করতে পারছি না।
একটা কারণ হচ্ছে আর্টিফিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেক অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনা। যদি পুরো ব্যাপারটাই খারাপ হতো, তবে তো আর এর উপর গবেষণার পেছনে এত এত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হতো না। সত্য ঘটনা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন আমাদের মানবজাতিকে বেকার করে দিতে পারে, উদ্দেশ্যহীন করে দিতে পারে, তেমনি অনেক সুবিধাজনক ব্যাপারও নিয়ে আসতে পারে।
যেমন ধরুন, সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির কথা। এ ব্যাপারটি কিন্তু প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। বর্তমানে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং এগুলোর প্রায় পুরোটাই মানবিক ভুলের কারণে, যেসব ভুল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করবে না। তাই এই যে লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ, এ ব্যাপারটা সুন্দর। কিন্তু এটা করতে গেলে আপনার মানুষের আচার-আচরণ এবং আবেগকে হ্যাক করতে হবে। রাস্তার মাথায় নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিতে অ্যালগরিদম সহজেই পারবে, সেটা তেমন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু একটা বাচ্চা যদি কোনো বল ধরার জন্য হঠাৎ গাড়ির সামনে লাফ দেয়, সেক্ষেত্রে বাচ্চাটাকে বাঁচাবে কোন অ্যালগরিদম?
সুতরাং সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির আইডিয়াকে সম্পূর্ণ বাস্তব করতে হলে আমাদের এমন গাড়ি তৈরি করতে হবে যা একটা বাচ্চার অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনাকে বুঝতে পারে। অর্থাৎ মানুষের আচরণকে, তার কাজকর্মের প্যাটার্নকে হ্যাক করতে হবে, তাই না? সোশ্যাল মিডিয়াই বর্তমানে এই প্রযুক্তির উদাহরণ, যেখানে তারা আমাদের আবেগকে হ্যাক করে ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের বসিয়ে রাখতে পারে তাদের সামনে। সুতরাং যেই প্রযুক্তি আমাদের মনোযোগকে কেড়ে নিয়ে আমাদের জীবনকে অসুখী করে তুলছে, যে প্রযুক্তিই আবার বছরে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বাঁচাতে পারে। তাই “শুধু সমস্যাই আসবে” এরকমটা এত সহজে বলা যায় না।
হ্যাঁ, মুদ্রার তো দুটি পিঠ থাকবেই। আচ্ছা ভবিষ্যত প্রযুক্তির শুধু ভালোগুলোকে গ্রহণ করে খারাপগুলোকে প্রতিহত করে রাখার কি কোনো উপায় আছে?
আশা করি কার্যকর সরকারী আইন, মানুষের নিজেকে জানা, যারা অ্যালগরিদম তৈরি করছে তাদের অভিপ্রায়গুলো ঠিক থাকা, এগুলো সব মিলিয়েই ভবিষ্যত হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যারা প্রযুক্তিতে কাজ করছে- প্রকৌশলীরা, বিজ্ঞানীরা- তাদের কারোরই আসলে অভিপ্রায় খারাপ নয়। হয়তো কারো কারো খারাপ থাকতে পারে, কিন্তু কেউই তো আর মানবজাতির ধ্বংস ডেকে আনতে চাচ্ছে না। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে, বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি তৈরি করতে পটু হলেও সম্পূর্ণ মানবজাতির জন্য তাদের কাজের ফলাফল কী হতে পারে, তা বুঝতে খুবই অপটু। সুতরাং আমরা যদি প্রযুক্তি মানবজাতির জন্য কেমন ভবিষ্যত আনতে পারে, তা নিয়ে আরো কথা বলি, সচেতনতা তৈরি করি, এই প্রযুক্তিগত উন্নতিকে আমরা ঠিকঠাক দিকে হয়তো রাখতে পারবো।
আমার কাছে আমার বইটি কিন্তু কোনো ভবিষ্যদ্বাণীর বই নয় যে, হ্যাঁ, আমাদের ধ্বংস আসছেই এবং এখানে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। যদি কিছুই করার না থাকে, তবে এই বই লেখারই তো কোনো সার্থকতা নেই। আমার আইডিয়াটা হচ্ছে মানুষকে জানানো, এসব নিয়ে কথা বলতে শেখানো। প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চাকরির বাজারকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, আমাদের মনস্তত্ত্বের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, আমাদের সম্পর্কগুলোকে কীভাবে বদলে দিতে পারে- এসব নিয়ে অবশ্যই আমাদেরকে কথা বলতে হবে। যেমন আমেরিকায় মিডটার্ম ইলেকশন হবে কিছুদিনের মধ্যেই, আপনি যদি এমন কাউকে দেখেন যে কংগ্রেসের জন্য নির্বাচিত হতে চাচ্ছে, অবশ্যই তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জব মার্কেটের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনি মনে করেন? প্রযুক্তির তৈরি জগত শিশুদের মনস্তত্ত্বকে কীভাবে বদলে দিচ্ছে বলে আপনি মনে করেন? আপনাকে যদি আমরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করি, এগুলোর জন্য আপনি কী কী পদক্ষেপ নিবেন?”
আপনার “সেপিয়েন্স” বইটাতে আপনি একটি আইডিয়া দিয়েছিলেন যে আমরা মানুষেরা আমাদের প্রয়োজনে সংঘবদ্ধভাবে অনেক কল্পনাপ্রসূত গল্পে বিশ্বাস করে আসছি, এই বইটিতেও সে কথা এসেছে। বর্তমান সময়ে আমাদের বিশ্বাস করা সবচেয়ে বিপদজনক কল্পনাপ্রসূত গল্প বলে আপনার কোনগুলোকে মনে হয়?
এরকম বিপদজনক গল্প এখন আছে দুটো, একটি আরেকটির বিপরীত। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। সব দেশেই আমরা দেখছি, অতীতকে উপজীব্য করে অনেক অনেক নেতা উঠে আসছেন। তারা ভবিষ্যত নিয়ে কথা না বলে বলছেন অতীত নিয়ে, “আমাকে যদি তোমরা ভোট দাও, আমি তোমাদের দেশে সোনালী যুগ ফিরিয়ে আনবো।” যা অসম্ভব, সব সোনালী যুগই আসলে আমাদের তৈরি ফ্যান্টাসি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর অবস্থান একটি নির্দিষ্ট ঘরানার ইতিহাসবিদের বইতে, অথচ আসল চিত্রটা যেখানে পুরোই আলাদা। যেখানে তাদের কথা বলার কথা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে, প্রযুক্তির সামনে আমাদের পদক্ষেপ নিয়ে, সেখানে অতীত নিয়ে কথা বলে তারা ভোট বাগিয়ে নিচ্ছে, আর আমরাও আমাদের নস্টালজিয়ার বশবর্তী হয়ে তাদের বিশ্বাস করছি।
এটা খুবই বিপদজনক, কারণ নতুন সমস্যাগুলোর সমাধান না ভেবে অতীতকে টেনে আনতে গেলে এই নেতারা সবাই ব্যর্থ হবে। এই নেতারা সেসব ব্যর্থতার ভার কখনোই নিজেরা নিবেন না, অন্যদের উপর দোষ চাপাবেন। কিন্তু প্রযুক্তি এগোতে এগোতে আমরা হঠাৎ ভয়ংকর অর্থনৈতিক ধ্বসের সামনে পড়ব বা সম্পূর্ণ মানবজাতি উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু তখন দেখা যাবে আমরা সেসব সমস্যা নিয়ে ভাবিইনি। ইতিহাসে এরকম হতে আমরা আগেও দেখেছি।
আরেকটি, এর বিপরীত গল্পটি হচ্ছে, “ভবিষ্যত নিজের থেকেই ভারসাম্যে চলে আসবে। আমাদের শুধু একের পর এক নতুন প্রযুক্তি বানাতে হবে তাতেই আমরা পৃথিবীতে স্বর্গ তৈরি করতে পারবো।” এই গল্পে প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের অসুখী করে তুলতে পারে বা চাকরিহারা করতে পারে তা ভাবা হচ্ছে না। আমাদের এসব গল্পের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)