প্রতিটি সম্পর্কের ভিত্তি হলো ভালোবাসা আর একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস- টিভির পর্দা থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমরা এই কথাটি শুনেছি। কথাটি যে সত্য এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খুব কম মানুষের জীবনেই এমন বিশ্বস্ত, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষ আসে। প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্কে ঝগড়া, মন-কষাকষি একটু হয়েই থাকে। ‘মানিয়ে’ চলতে শেখো’- এটি হচ্ছে আরেকটি ‘বেদবাক্য’, যা প্রায়ই বিরূপ সম্পর্কে পড়ে যাওয়া মানুষদের জন্য ব্যবহার করা হয়। সমস্যা, মনোমালিন্য যেকোনো সম্পর্কের মধ্যেই থাকতে পারে। কিন্তু সব মনোমালিন্যের সাথে মানিয়ে নেয়া কি সম্ভব?
কী করবেন আপনার সঙ্গী যদি হন একজন সাইকোপ্যাথ? সিনেমা, টিভি সিরিজের এই যুগে সাইকোপ্যাথিকে এমন এক ‘অলৌকিক’ মাত্রা দেয়া হয়েছে, পর্দায় সাইকোপ্যাথদের এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, তারা যে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ সেটা আমরা প্রায় সময় খেয়ালই করি না। মানতে কষ্ট হলেও অনেক সাইকোপ্যাথ আমাদেরই সাথে, আমাদের আশেপাশে আপাত সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন পার করছেন। তাদের মধ্যে কেউ হতে পারে আপনার ভাই, আপনার বোন, আপনার বন্ধু বা আপনার ভালোবাসার মানুষটি।
ঘাবড়াবেন না। সাইকোপ্যাথ হওয়া মানেই ক্রিমিনাল বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত এমন ব্যক্তি নন। একজন মানুষ তার জীবনে কোনো আইন বহির্ভূত কাজ না করেও দিব্যি একজন সাইকোপ্যাথের তকমা পেয়ে যেতে পারেন। সাইকোপ্যাথি একধরনের ব্যক্তিত্ব-বৈকল্যজনিত (পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার) রোগ। অর্থাৎ ব্যাপারটি সম্পূর্ণই মানসিক। এটি পারিবারিক, বংশগত ও পরিবেশের প্রভাবেও হতে পারে।
যারা আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বিবেক দ্বারা পরিচালিত হন না, তাদেরকে সাধারণত সাইকোপ্যাথ বলা হয়। ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে যে অন্যদেরকে সম্মান করার, ভালোবাসার, অন্যের কষ্টে দুঃখিত আর সুখে খুশি হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় তা সাইকোপ্যাথদের বেলায় খাটে না। সোজা কথায়, তারা তাদের আবেগকে খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গবেষণায় পাওয়া গেছে, সাইকোপ্যাথদের আছে সহানুভূতির সুইচ, যা তারা স্বেচ্ছায় অন-অফ করতে পারেন! এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন রোর বাংলার এই লেখাটি।
ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা এই আবেগগুলোকে সম্পর্কের ভিত্তি বলা হয়। কিন্তু সাইকোপ্যাথরা এসব আবেগ থেকে মুক্ত। আরো ভালোভাবে বললে, তাদের চোখে এসব আবেগ শুধুই স্বার্থ হাসিলের পথ ছাড়া কিছুই না। তারা কোনো আবেগ অনুভব করেন না, কারো মন বুঝতে চেষ্টা করেন না। তেমন একজন মানুষের সাথে প্রেম বা বিয়ের মতো এত অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?
সত্যি বলতে, আপনার সঙ্গী সাইকোপ্যাথ কি না তা জানার জন্য নির্দিষ্ট কোনো উপায় নেই। এটি অনেকটা আপনাকে নিজে বুঝে নিতে হবে, আবার সাইকোপ্যাথি একেকজনের মধ্যে একেকভাবে দেখা দেয়। যা-ই হোক, তা-ও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে, যা প্রায় সব সাইকোপ্যাথের মধ্যে কমবেশি দেখা যায়। আলোচনার স্বার্থে মনে করুন, রাসেল ও রিয়া নামের দুজন সম্প্রতি প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, কিন্তু রাসেলের আচরণের কিছু বিষয় ধীরে ধীরে রিয়াকে ভাবিয়ে তুলছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, যদিও পুরুষের উদাহরণ দেয়া হচ্ছে , তবে একজন সাইকোপ্যাথ নারী-পুরুষ উভয়ই হতে পারে।
সাইকোপ্যাথরা সম্পর্কের শুরুতে অনেক আকর্ষণীয় থাকেন
রাসেল ও রিয়ার পরিচয়ের পর থেকেই দেখা গেল, রাসেল এই সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। রিয়াকে খুশি করা, তার কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় ও ‘আলাদা’ হিসেবে তুলে ধরার কোনো চেষ্টাই রাসেল বাদ দেয়নি। অর্থাৎ, আপনার সঙ্গী যদি একেবারে শুরুর দিকে আপনার মন জয়ের জন্য একেবারে আদা-জল খেয়ে লাগে, তাহলে এই ব্যাপারে একটু সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো।
তারা সময় নষ্ট করতে চান না একেবারেই
দুই সপ্তাহের পরিচয়ের পর রাসেল রিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সম্পর্কটা অনেক দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় বলে জানায়। অনেক সময় আপনি এমন মানুষের দেখাও পাবেন, যারা ১-২ দিনের পরিচয়ের পরই আপনার সাথে আজীবন কাটানোর পরিকল্পনা করে ফেলে।
তারা যা বলেন তা-ই করতে বাধ্য করেন
একবার যখন বিয়ের জন্য রাসেল রিয়াকে কোনো রকমে রাজি করে ফেলে, তখন বিয়ের পর ধীরে ধীরে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো। রাসেল ভাবে, সে সবকিছুতেই রিয়া থেকে এগিয়ে এবং সে যা ভালো বুঝবে তা-ই রিয়াকে করতে হবে। এটি খুব স্বাভাবিক যে, সাইকোপ্যাথরা আপনাকে একবার আবেগাপ্লুত করে ফেলতে পারলে আপনার কাজকর্ম, এমনকি চিন্তাধারাও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তারা সবসময় এটা বোঝানোর চেষ্টা করে যে, এই সম্পর্কে তারা হচ্ছে ‘উত্তম’, আর আপনি ‘নিকৃষ্ট’।
তারা আপনার বৈশিষ্ট্যগুলো বদলানোর চেষ্টা করবে। যেমন- রিয়ার হয়তো বিয়ের আগে লাল জামা পরতে ভালো লাগতো, কিন্তু রাসেলের লাল রঙ পছন্দ না। সে জোর করে রিয়াকে লাল জামা পরা থেকে বিরত রাখবে। এছাড়াও রিয়ার শখ-আহ্লাদ, যে বৈশিষ্ট্যগুলো রিয়াকে ‘রিয়া’ বানিয়েছে, তার সব মুছে রাসেল তার নিজের পছন্দে রিয়াকে গড়ে তুলতে চাইবে।
সঙ্গীর জন্য আমরা অনেকেই আমাদের অভ্যাস কিছুটা বদলাতে পারি, সেটা দোষের নয়। কিন্তু যদি আপনার সামান্যতম মতামতের কোনো গুরুত্ব না দিয়ে আপনাকে আপাদমস্তক বদলে ফেলতে চাওয়া হয়, তখন এটি সাইকোপ্যাথিক সম্পর্কের একটি বড় নিদর্শন।
সাইকোপ্যাথরা সঙ্গীকে ভোলানোর চেষ্টা করে
আপনি ভাবতেই পারেন যে, রাসেলের মতো কেউ যদি আপনাকে আপনার পছন্দের রঙের জামা পরতে নিষেধ করে, তবে আপনি শুনবেন না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একজন সাইকোপ্যাথের সাথে সম্পর্ক থাকলে আপনি তাদের কথা শুনবেন। যেমনটা রিয়াও শুনেছিল। সে লাল রঙের জামা পরে না আর। এটা হয়, কারণ সাইকোপ্যাথরা তাদের সঙ্গীকে এমনভাবে মগজধোলাই করে, যাতে রিয়ার মতো আপনার মনে হবে, “হুম, লাল রঙে আমাকে আসলেই ভালো মানায় না। রাসেল ঠিকই বলেছে।”
কখনো মায়াকাড়া চোখ দিয়ে, কখনো হালকা অভিমান বা কখনো একেবারে গায়ে হাত তুলেও সাইকোপ্যাথরা নিজের সঙ্গীর মগজধোলাই করে।
তারা আপনাকে ভালোবাসা ও গুরুত্ব দেবে। আপনার বিশ্বাস জয় করবে। আর একবার যখন আপনি তাদের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন, তখন তারা আপনাকে প্রায়ই ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাবে। আর সঙ্গীর প্রতি এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন আপনি যে, সে ভয়ে আপনি সব মেনে নেবেন। এটিই সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত মগজধোলাই কৌশল।
তাদের নেই কোনো দায়িত্ববোধ বা অনুতাপ
রিয়াকে বদলে ফেলার এই চেষ্টায় অনেকবার তাদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি, কথা-কাটাকাটি হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই রাসেল তার দোষ স্বীকার করেনি। বরং বারবার রিয়ার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে এবং রিয়াকেই প্রতিবার ক্ষমা চাইতে হয়েছে। যদি আপনার সঙ্গীর সাথেও আপনার এমন সম্পর্ক থাকে, তাহলে আশা করি বুঝতেই পারছেন যে, এটি একটি অসুস্থ সম্পর্ক।
তারা এই আছে তো এই নেই
রাসেল আর রিয়ার সম্পর্কে যখনই মনোমালিন্য দেখা দিয়েছে, রাসেল সব সময়ই সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। কিছুদিন পর আবার সে-ই রিয়ার সাথে আবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। যদি আপনার সঙ্গী আপনার সাথে ‘আজ আছি তো কাল নেই’- এমন ধরনের সম্পর্ক রাখে, তাহলে ভালো হবে তাদের ব্যাপারে নতুন করে ভাবা।
তাদের সম্পর্কের চালিকা শক্তি হলো যৌন চাহিদা
প্রকৃতিগতভাবেই আমরা যাদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্কে জড়াই, তাদের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করি। কিন্তু সাইকোপ্যাথের সাথে যদি আপনার সম্পর্ক থাকে, তাহলে আপনার প্রতি তার আকর্ষণ শুধু যৌনতাকে ঘিরেই থাকবে। যখন সে আপনার মনের চেয়ে বেশি আপনার শারীরিক সৌন্দর্যে বেশি মজে যাবে, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারেন এটি একটি অস্বাভাবিক সম্পর্কে রুপ নিয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে ভালোভাবে জেনেবুঝেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এটি একান্তই আপনার আর আপনার সঙ্গীর ব্যক্তিগত ব্যাপার। সমস্যা সমাধানের বাইরে চলে গেলেই বরং একে অস্বাভাবিক বলা যায়।
সাইকোপ্যাথের আত্মরক্ষা কৌশল হলো শারীরিক নির্যাতন
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাইকোপ্যাথিক সম্পর্কে কোনো না কোনো সময় আপনার সঙ্গী আপনার উপর শারীরিক নির্যাতন চালাবেই। যেমন ধরি, শুরুতে রাসেল হয়তো রিয়াকে শুধু বকাঝকা করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রিয়ার গায়ে হাত তোলার চেষ্টাও শুরু করেছে এবং বাধা পেয়ে এখন সে আগের চেয়ে বেশি হিংস্রভাবে শারীরিক নির্যাতন করছে।
শারীরিক নির্যাতন একটি অসুস্থ সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাইকোপ্যাথিক হোক না হোক, এটি কখনোই মেনে নেয়া উচিত না, সেই সম্পর্ক থেকে দ্রুত বেড়িয়ে আসা উচিত। তবে অনেক সাইকোপ্যাথ আছে, যারা হয়তো ইচ্ছা করে তাদের সঙ্গীকে অত্যাচার করে না বরং পরিস্থিতির কারণে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে কেউ কেউ আবার খুব পরিকল্পনামাফিক তাদের সঙ্গীদের উপর নির্যাতন করে। যেভাবেই হোক, শারীরিক নির্যাতন যেকোনো সম্পর্কে দাড়ি লাগানোর জন্য যথেষ্ট।