ঘুমাতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে বোধ করি। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সারাদিনের ক্লান্তি ঘোচাতে যেকোনো মানুষ তার অতি প্রিয় বিছানা আর নরম বালিশেই গা এলিয়ে বিশ্রাম নেয়ার হাতছানি অনুভব করেন। যেই কিনা চাদর টেনে আরামদায়ক অবস্থানে কোল বালিশ জড়িয়ে চোখের পাতা বুজলেন, অমনি মনে হতে লাগলো শরীরটা কেমন জানি ছেড়ে দিচ্ছে, হয় কোনো পাহাড় বা সিঁড়ির উঁচু উঁচু ধাপ থেকে আপনি পড়ে যাচ্ছেন। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে করতে পুরো শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুমটাই ভেঙ্গে গেলো।
কিন্তু মেজাজটা গেলো ভীষণ খারাপ হয়ে। অনেকের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সহসাই ঘটে থাকে। একবার বা একদিন নয়, ঘনঘনও হতে পারে। ঘুম ভেঙে কারো কারো মনে থাকে স্বপ্নে কী ঘটেছিল, কেউ আবার ভুলে যান রাতে ঘুমের ঘোরে কী হয়েছে। সকলের সঙ্গে না ঘটলেও বিশ্বের ৬০-৭০ শতাংশ মানুষের সঙ্গেই একই রকম ঘটনা ঘটে থাকে। সব ক্ষেত্রে এটাই মিল যে, সবাই অনুভব করে থাকেন তারা যেন ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন- এমন কিছু।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঝাঁকুনিকে বলা হয় হিপনিক জার্ক (Hypnic jerk)। এই ঝাঁকুনির ভিন্ন ভিন্ন নামও রয়েছে। যেমন- স্লিপ স্টার্ট (Sleep Start), মাইওক্লোনিক জার্ক (Myoclonic Jerk), হিপ্নাগোগিক জার্ক (Hypnagogic Jerk) প্রভৃতি। আমাদের দেহ ঘুমিয়ে যাওয়ার আগেই যদি স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেয় তখন আমাদের মস্তিষ্কে এর অনুভূতি অনেকটা ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, যাকে বলে হিপ্নাগোগিক জার্ক।
শরীর ঘুমানোর পর একটা আরামদায়ক প্যারালাইজড বা স্থির অবস্থায় চলে গেলেও কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক তার কাজকর্ম থামিয়ে রাখে না। আমরা বহির্জগতের ঘটনাবলী বিস্মৃত হয়ে পড়ি ঠিকই, তবে আমাদের মাংসপেশীর উপর নিয়ন্ত্রণ থেমে থাকে না। আসলে ব্রেইন কিন্তু বিশ্রামহীন, দুটো পর্যায়ের মধ্যে তার যাওয়া আসা চলতে থাকে। ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের মনোজগতে দু’ধরনের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে এক মনোরম সামঞ্জস্য নিয়ে অবস্থান করে। পর্যায় দুটো হলো-
১) র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM)
২) নন-র্যাপিড আই মুভমেন্ট (NREM)
রেপিড আই মুভমেন্ট (REM)
মানুষের ঘুমের গভীরতম পর্যায় হলো এটি। এই সময় গভীর তন্দ্রামগ্নতায় ঘিরে ধরে স্বপ্নজগত।
নন রেপিড আই মুভমেন্ট (NREM)
এই পর্যায় আবার চার ভাগে বিভক্ত। এই পর্যায়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমের রক্ষণাবেক্ষণ চলে। শরীরের মাংসপেশী, টিস্যু, হাড়, তৈরী এবং মেরামতের কাজ চলতে থাকে এই পর্যায়ে। মোট কথা, শরীরের সামগ্রিক মেরামতের কাজ ঘুমের এই পর্বেই ঘটে থাকে।
একজন মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আগপর্যন্ত NREM এর চার স্তর এবং REM এর এক স্তর নিয়ে একটি চক্র বা সাইকেল তৈরী করার কাজ চলতে থাকে। এই ৫টি স্তর সম্পর্কে জেনে রাখা ভাল।
ধাপ ১
এই ধাপের শুরুতেই ঘুম মাত্র লেগে আসে চোখের পাতায়, আবার সহজেই ঘুম ভেঙ্গেও যেতে পারে। হিপনিক জার্ক বা পেশীর খিঁচুনি এই ধাপেই হতে পারে।
ধাপ ২
এই ধাপে শরীরের পেশী শিথিল হয়ে গভীর ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়। শরীরের তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে, সাথে সাথে হৃদস্পন্দন ধীর গতিতে হয়।
ধাপ ৩
এই ধাপে মস্তিষ্ক তরঙ্গ ধীর হয়ে যেতে থাকে। ঘুম ধীরে ধীরে স্বপ্নের গভীর পর্যায়ে চলে যেতে থাকে।
ধাপ ৪
এই ধাপ এতই গভীর যে তা থেকে উঠে আসা দুরূহ ব্যাপার হয়ে যায়।
ধাপ ৫ বা REM
মানুষের যখন ঘুমের মাঝে চোখের পাতার নড়াচড়া পরিলক্ষিত হয় তখন বুঝতে হবে যে সে এই ধাপেই আছে। এ পর্যায়ে হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক খুব কার্যকর হয়ে ওঠে। সারাদিনের বিশেষ কোনো ঘটনার প্রতিচ্ছবি বা ভালো লাগার অনুভূতি এক এক করে ফাইলবন্দী হতে থাকে! এই পর্যায়েই সেরাটোনিন হরমোন মজুদ হয়।
হিপনিক জার্কের কারণসমূহ
ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের হিপনিক জার্ক হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। যেমন-
- অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইন বা চা-কফি জাতীয় পানীয় গ্রহণ।
- অতিমাত্রায় শারীরিক ব্যায়াম।
- রাতে স্ট্রেসফুল কোনো কাজ করলে।
- রাত জেগে টিভি দেখা বা মোবাইল অথবা ইন্টারনেট ব্রাউজিং এর ফলে স্নায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনে শরীরে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে নারকোলেস্পি বলে।
- রোজ ঘুমানোর সময়ের অনিয়ম বা রাত জাগার বদভ্যাস, ওভার টায়ার্ডনেস বা অতিরিক্ত খাঁটুনীএই সমস্যাগুলো থেকেও হিপনিক জার্ক হতে পারে।
- অনেক সময় মদ্যপান করে ঘুমোলেও এমনটা হতে পারে।
- উঁচু কোনো স্থান বা পাহাড় চূড়া থেকে অথবা সিঁড়ি থেকেও পড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখার ফলে আমরা নড়েচড়ে উঠি ঘুমের মাঝে।
- অনেক সময় শরীরের কোনো স্থান, বিশেষ করে পা, একভাবে দীর্ঘক্ষণ অবস্থানের ফলে শরীরের মাংসপেশীতে ঝিঁঝি ধরে যেতে পারে। এই অবস্থায়ও হিপনিক জার্ক হতে পারে।
- সাধারণত ঘুম এসে গেলে হাত-পা বা দেহের অন্য কোনো অঙ্গ নড়ে উঠলে শরীর কেঁপে ওঠে।
- শরীরে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের অভাবেও স্বতঃস্ফূর্ত হিপনিক জার্ক হতে পারে।
- এছাড়া বাইরের জোরে কোনো শব্দ ও চড়া আলো চোখে এসে পড়লেও আমাদের পড়ে যাওয়া অনুভূতি টের হতে পারে। ঠিক তখনই মস্তিষ্ক শরীরকে ধরে রাখতে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এটাই হলো বিজ্ঞানের ভাষায়, হিপনিক জার্ক।
কেন এমনটা হয়ে থাকে?
মানুষের ঘুমের সময়টাতে হিপনিক জার্ক কেন এবং কখন হতে পারে এটা নিয়ে সঠিক কোনো কারণ বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত বলতে পারেন নি। তবে এই সম্পর্কে কিছু মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন, এর পিছনে আমাদের পূর্বপুরুষরা দায়ী। তার এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রাচীনকালে মানুষেরা গাছের ডালে বাসা বেঁধে নিরাপদে ঘুমানোর রীতি প্রচলন করে। ঘুমানোর আগে শরীরের অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বা বিপজ্জনক কিছুর অবস্থান আশেপাশে আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখতেই ঘুম আসার পূর্ব মুহূর্তে মস্তিষ্ককে জাগিয়ে দিয়ে খেয়াল করার চেষ্টা করতো। অর্থাৎ গভীর ঘুমের আগে মগজ শেষবারের মতো চারপাশ দেখে নিতে চায় যে সে আসলে নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে। তাই ঘুমের মধ্যেও তাদের মনোজগতে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকার চেষ্টা থাকতো, যার ফলে মাঝে মাঝেই সে আচমকা জেগে উঠে জানান দিতো আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার। এই প্রক্রিয়াটি এখনও মানুষ বয়ে নিচ্ছে।
এছাড়া বিবর্তন এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় দুটো থিওরি প্রচলিত। সেটা বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিকতম হিপনিক জার্কের ব্যাখ্যা। কিন্তু সেটাকেই ধ্রুব বা চূড়ান্ত বলে মনে করার উপায় নেই। ২০১২ সালে নিউরো সায়েন্স ম্যাগাজিনে বিজ্ঞানী ইয়ান অসওয়ার্ল্ড এর প্রকাশিত ‘Systematic restoration theory of sleep’ গবেষণাপত্রে এ সম্পর্কিত একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মূল বক্তব্য হলো, তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মস্তিষ্কে দুটো পরস্পর সাংঘর্ষিক প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একে আরেকটু বিশদভাবে বলা যায়।
সাংঘর্ষিক প্রক্রিয়া ১
মানব মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় এবং ভাঁজ পড়া অংশটি হচ্ছে সেরেব্রাল কর্টেক্স। এর নিচে অবস্থিত রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিষ্টেম। এই অংশটি যখন ক্রিয়াশীল থাকে তখন তা মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচেতন রাখতে সচেষ্ট থাকে। অর্থাৎ এই অংশটি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো মৌলিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদের জেগে থাকার অবস্থান সুনিশ্চিত করে।
সাংঘর্ষিক প্রক্রিয়া ২
প্রচলিত ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে ‘সুইচ স্লিপ’। ডাক্তারী ভাষায় যার নাম, ভেন্ট্রোল্যাটেরাল প্রিঅপটিক নিউক্লিয়াস বা Ventrolateral Preoptic Nucleus (VLPO)। এর অবস্থান অপটিক স্নায়ুর খুব কাছাকাছি। এই অংশটি ঘুমের চক্রকে প্রভাবিত করতে সহায়তা করে।
তন্দ্রামগ্ন হওয়ার সময়, রেটিকুলার অ্যাক্টিভেটিং সিস্টেমটি শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয় এবং ভেন্ট্রোল্যাটেরাল প্রি অপটিক নিউক্লিয়াস শরীরের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা অনুজ্জ্বল আলোর ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসার মতো ঘটনার সাথেই তুলনা চলে। তবে ব্যাপারটা সর্বদা স্বচ্ছন্দে বা নির্বিঘ্নে ঘটে না। আমাদের জেগে থাকা এবং ঘুমিয়ে পড়ার মাঝামাঝি মুহূর্তের অবশিষ্ট এনার্জিটুকু মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ঝাঁকুনির আকারে সবেগে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। তখনই অনুভূত হয় হিপনিক জার্ক।
হিপনিক জার্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়
হিপনিক জার্ক কোনো রোগ নয়। নিয়ম মেনে চললে বারবার এমন হওয়া থেকে অবশ্যই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হিপনিক জার্ক ঘটার সম্ভাবনা কমে যায়। হিপনিক জার্কের কোনো নির্দিষ্ট পথ্য নেই। তবে কারও বেলায় ঘন ঘন এই সমস্যা হতে থাকলে তাকে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়া প্রয়োজন। জীবনযাত্রা পরিবতন, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম ও চাপমুক্ত থেকে ব্যস্ততম সময়কে উপভোগ করতে পারলে খুব সহজেই হিপনিক জার্ক থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ফিচার ইমেজ: Cerita Medan