জীবনের ব্যর্থতা, দুঃখ, গ্লানি আর দুর্দশা; এসব যে চিরস্থায়ী নয়, সেটা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই। কষ্টের মুহূর্ত কাটিয়ে উঠে একসময় যে সুখের দেখা পাওয়া যাবে, সেকথা মেনে নিতে যেন অনেক সময় আমরা কার্পণ্য করি। আর যারা সেই কার্পণ্যকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়, তারা হয়তো নিয়ে ফেলে জীবন নিয়ে ভয়ঙ্কর কোনো সিদ্ধান্ত, হতে পারে সেটা আত্মহত্যার মতো দুর্ভাগ্যজনক কোনো ঘটনা। কিন্তু এই পৃথিবী এবং যা কিছু এর মধ্যে আছে সবই নশ্বর এবং ধ্বংসশীল, এ কথা তো আমরা মেনে নিয়েছি বিজ্ঞান দিয়েই। তাহলে আমাদের দুখ-কষ্টও যে একসময় শেষ হবে তা কেন আমরা মেনে নিতে পারি না?
এতসব চিরন্তন সত্য মেনে নিয়েও কেন আমরা আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাই? কারণ আমরা বর্তমানময় খুব ছোট্ট জানালা দিয়ে খুব ছোট প্রেক্ষাপটে বিরাট জীবনকে দেখতে চেষ্টা করি এবং মাপতে চাই। এভাবে দেখতে ও মাপতে চাওয়ার চেষ্টাটাই ভবিষ্যৎ যে কতটা সুন্দর হতে পারে সেই উপলব্ধির উপর আত্মহত্যা করার মতো জঘন্য প্রলেপ ছড়িয়ে দেয়।
স্টিভ জবসের কানেক্টিং ডট থিওরি আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়, অতীতে যা কিছু হয়, তা ভালোর জন্যই হয়। এই অতীত যে শুধু সুখ দিয়েই নির্মিত না, সেখানে দুঃখও থাকে। আজ এমন কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলব, যারা জীবনের একটা সময়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফিরে এসেছেন সে ইচ্ছে থেকে। এরপর পৃথিবীকে তারা দিয়েছেন অনেক কিছু, প্রমাণ করেছেন- তাদের অকাল আত্মহনন পৃথিবীর জন্য দুর্ভাগ্যজনকই হতো।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
‘I have a dream’ খ্যাত বিশ্বনেতা, মানবাধিকার কর্মী, শান্তিতে নোবেলজয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র পৃথিবীর অসংখ্য সংগ্রামী মানুষের মনের উজ্জ্বল অনুসরণীয় এক ব্যক্তি। আফ্রো-আমেরিকান এই মানবাধিকার কর্মী প্রথম আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিয়ে গর্জন তুলেছিলেন। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন ও অহিংস পন্থার আদলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। আমেরিকার ইতিহাসে যে চার জনকে ন্যাশনাল হলিডে দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে মার্টিন লুথার কিং অন্যতম।
এমন সফল একজন মানবাধিকার কর্মী, বক্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা শুনলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
মার্টিন লুথার কিং যখন বারো বছর বয়সী ছিলেন, তখন একদিন বাইরে গিয়েছিলেন প্যারেড অনুষ্ঠান দেখতে। বাবা-মা কঠিনভাবে বারণ করেছিলেন প্যারেডে না যেতে, তবুও তিনি গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার দাদীমা মারা গেছেন। তার কিশোর মনে এতটাই অনুশোচনা হয়েছিল যে, তিনি তাদের বাড়ির দোতলার জানালা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। যদি মার্টিন লুথার কিং ১২ বছর বয়সেই মারা যেতেন, তাহলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার মতো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হওয়া তো দূরে থাক, কৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের মৌলিক অধিকারই পেত না এত দিনে। সর্বোপরি বিশ্বও পেত না এমন এক সাহসী নেতাকে।
এমিনেম
অস্কারজয়ী এই র্যাপার ১৫ বার গ্র্যামি এওয়ার্ডস, ১৭ বার বিলবোর্ড মিউজিক এওয়ার্ডস, ১২ বার এমটিভি ভিডিও মিউজিক এওয়ার্ডস ছাড়াও কত কত পুরস্কার যে পেয়েছেন! প্রায় ৭৯৮টি পুরস্কার এবং ৯০৪ বার পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন তার ক্যারিয়ারের ঝুলিতে আছে। গত দশকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তার অ্যালবাম। তাই তাকে বলা হয় The Artist of the Decade।
অথচ এমিনেমের জীবন ছিল খুবই বেদনাময়। শিশু বয়সেই তার বাবা পরিবার ফেলে চলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। বড় হয়েছেন বন্ধু বিবর্জিত, বিচ্ছিন্ন পরিবারের এক নির্মম পরিবেশে। এগারো বছর বয়সে তার চাচা ‘রুনি’ নেলসনের কাছ থেকে একটি মিউজিক অ্যালব্যাম উপহার পাবার পর তিনি সঙ্গীতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম একক অ্যালবাম Infinite বের করলে বাজার চলেনি সেটি। তার গার্লফ্রেন্ড কিম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাদের একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে চলে যান। স্ত্রীর চলে যাওয়া, সন্তানকে দেখতে না পাওয়া, গানের অ্যালবামের বাজারে কাটতি না হওয়া, একাকী জীবনযাপন ইত্যাদি বিষয় ভুলতে পেইনকিলার অতিরিক্ত গ্রহণ করতে করতে আত্মহত্যার দিকে হেলে যান এমিনেম। যদি এমিনেম আত্মহননের পথ বেছে নিতেন সত্যিই, তাহলে তিনিই বরং নিজের জীবনের কাছে হেরে যেতেন। গানের জন্য অসংখ্য মানুষের এমন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা তবে আর কে পেত!
ওয়াল্ট ডিজনি
যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া লোকটি কে? তিনি হলেন ওয়াল্ট ডিজনি। ২৬ বার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন তিনি। মিকি মাউসের স্রষ্টা, পৃথিবীর প্রথম এনিমেশন প্রোগ্রামার ওয়াল্ট ডিজনির প্রথম জীবনটা ছিল ব্যর্থতায় ভরা। তিনি একটি পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছিলেন কার্টুনিস্ট হিসেবে। সেই পত্রিকার অফিস থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কল্পনাশক্তি না থাকা আর মৌলিক আইডিয়া না থাকার অভিযোগে!। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। অ্যালকোহলের সাথে ড্রাগ মিশিয়ে পান করতেন ডিজনি, যদিও আত্মহত্যার চেষ্টার কথা তিনি কোথাও স্বীকার করে যাননি। যদি ওয়াল্ট ডিজনি আত্মহত্যা করে বসতেন, তাহলে থিমপার্কের ধারণা হয়তো এখনো আবিস্কার হতো না। হয়তোবা বিশ্বে অ্যানিমেশন আজকের এই অবস্থানে পৌঁছুতে পারত না।
অপরাহ উইনফ্রে
অপরাহ উইনফ্রে একজন জনপ্রিয় মার্কিন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। টক শো উপস্থাপক, অভিনেত্রী, প্রযোজক ইত্যাদি পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি একজন সমাজসেবী। টক শো ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো’-এর জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত। এই টক শো তাকে ১৫ বার এমি অ্যাওয়ার্ড এনে দিয়েছে।
তার শো টেলিভিশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত বলে গণ্য করা হয়। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ধনী আফ্রো-আমেরিকান তিনি। একইসাথে সর্বকালের সেরা আফ্রিকান-আমেরিকান দাতা ও সমাজসেবক বলা হয় তাকে। পরপর তিন বছর তিনি বিশ্বের অনন্য কৃষ্ণাঙ্গ কোটিপতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। অস্কারজয়ী এই ব্যক্তিত্ব পাঁচবার ফোর্বস কর্তৃক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ জন সর্বোচ্চ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় অপরাহ উইনফ্রে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি টানা আটবার নির্বাচিত হয়েছেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচবার করে।
অথচ অপরাহর প্রথম জীবন ছিল খুবই যন্ত্রণাপূর্ণ। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এক দরিদ্র কিশোরী মায়ের গর্ভে। প্রথম থেকেই তার বাবা-মা আলাদা ছিলেন। ফলে তার শৈশব ছিল দারিদ্র্যপূর্ণ ও পিতৃস্নেহ বিবর্জিত। ৯ বছর থেকে ১৩ বছর বয়সে কয়েকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনি। চৌদ্দ বছর বয়সে পুত্রসন্তান গর্ভে এসে পড়লে তিনি ডিটার্জেন্ট পাউডার গিলে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন ১৯৮১ সালে, যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, তার ভালোবাসার মানুষটি নিজের স্ত্রী এবং সন্তানকে গোপন রেখে তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে তাকে ধোঁকা দিয়েছে। যদি অপরাহ জীবনের সেই ছোট প্রেক্ষাপটকে বিচার করে নিজের জীবনকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিতেন, তবে আজকের দিনের এত শত নারীর বাস্তব প্রেরণা কে হতেন!
উপরোল্লিখিত ব্যক্তিদের আমরা প্রায় সবাই চিনি। তবে এমন অনেক প্রসিদ্ধ ও অপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি আছেন সমাজে, যারা আত্মহত্যা করতে চেয়েও ফিরে এসেছেন। তারা পরবর্তীতে অনেক সফল হয়েছেন ও বিশ্বকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তারা যদি সেদিনের ছোট জানালা দিয়ে নিজের বিরাট জীবনকে বিবেচনা করে আত্মহত্যা করে বসতেন, তাহলে আজকের এই পৃথিবীটা এতো দূর হয়তো এগিয়ে আসতে পারত না। তাদের জীবনের ব্যর্থতা, দুঃখ, গ্লানি আর দুর্দশার পরশেই তারা হয়ে উঠেছেন বিশ্ববরেণ্য এবং বিশ্ব গেছে সামনের দিকে এগিয়ে। তাই আমাদের ব্যর্থতা, কষ্ট ও দুর্দশাই হোক এমন অবস্থা থেকে আমাদের উঠে আসার প্রেরণা।