লেখাটির শুরুতেই কিছু কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলো, কোনো সেলিব্রেটি হোক কিংবা যে কারো ক্ষেত্রেই হোক, বিবাহ-বিচ্ছেদ তো একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে কাটাছেঁড়া বা বিশ্লেষণ করা মানে কি কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনধিকারচর্চা নয়?
আসলে সেলিব্রেটি বা তারকারা আমাদের সমাজে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন, বিশেষত বিনোদন জগতের তারকারা। সমাজের তরুণরা তাদের স্রেফ একেকজন অভিনেতা বা গায়ক কিংবা পারফর্মার হিসেবে দেখেন না। তরুণ-তরুণীদের মনোজগতে তাদের অবস্থান এসবের অনেক উর্ধ্বে।
সমাজের লাখো তরুণ-তরুণীর চোখে তারা স্টাইল আইকন; সচেতনভাবে কিংবা নিজেদের অজান্তেই তাদেরকে অনুকরণ করেন অনেকে। তাদের জাঁকজমকপূর্ণ লাইফস্টাইল সাধারণদের ফ্যান্টাসির খোরাক যোগায়। তাই তাদের পর্দার জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও সাধারণ বিনোদনগ্রহীতা তথা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে কৌতূহলের অন্ত নেই।
তারকা দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের খবর আজকের যুগে খুব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রবণতা কাজ করছে হলিউড-বলিউড তো বটেই, বাংলাদেশের বিনোদনপাড়াতেও।
তারকাদের এই সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার বিষয়টি নিয়ে তাদের ভক্তকুলের মধ্যে ভীষণ কৌতূহল কাজ করে। আর এই কৌতূহলের সুযোগ নিয়ে প্রায়শই নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ তাদের চরিত্র নিয়েও অবান্তর প্রশ্ন তোলে, যেটি তারকাদের জন্যও মোটেই সুখকর কোনো বিষয় নয়। আর এই কারণেই লেখাটির সূত্রপাত।
আমরা বোঝার চেষ্টা করবো যে, সেলিব্রেটিদের মধ্যেই এই প্রবণতাটি কেন এত বেশি কাজ করে বলে মনে হয়, কী কী বিষয়গুলো তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদে ভূমিকা রাখতে পারে। এই আলোচনাটি মোটেও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ আলোচনা নয়। বেশ কিছুদিন আগে বিখ্যাত সাধারণ জ্ঞানের কমিউনিটি ওয়েবসাইট ‘কোরা’তে একজন এই প্রশ্নটি করেছিলেন। সেখানে আলোচনায় উঠে আসা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট তুলে ধরা হলো আজকের লেখায়।
প্রথমে একটি প্রচলিত ধারণা নিয়ে আলাপ করা যাক, যেটি সঠিক হবার চেয়ে ভুল হবারই সম্ভাবনা বেশি। অনেকের মধ্যেই একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, সেলিব্রেটিরা প্রায়ই প্রচারণা পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ার বা ভাঙনের গুজব ছড়ান। কিন্তু এটি আসলে একটি মনগড়া কিন্তু জনপ্রিয় একটি ধারণা। মানবিক গুণাবলী ও সুকুমার বৃত্তিসম্পন্ন তারকাদের ক্ষেত্রে এমন একটি ধারণা অত্যন্ত সাধারণীকৃত চিন্তা, একে একধরনের ‘মিথ’ই বলা চলে।
এবার চলুন দেখি কী কী কারণে সেলিব্রেটিদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার এত বেশি হতে পারে।
সম্পর্কে জড়ালেই কেবল বাস্তবতার দেখা মেলে
তারকাদের আমরা যেভাবে চিনি, তা অনেকটা অন্ধের হাতি দেখার গল্পের মতো। তাদের সম্পর্কে টিভি বা পত্রিকার মারফতে পাওয়া খবর, সাক্ষাৎকার বা তাদের কাজ দেখে তাদের একটি ইমেজ আমাদের মনে গড়ে উঠে। এমনকি তারকাদের নিজেদের মধ্যেও মিডিয়ার সৃষ্টি করা এমন ইমেজের কারণে একে অপরের প্রতি ভালোলাগার সৃষ্টি হতে পারে।
কিন্তু সম্পর্কে জড়ানোর পর হয়তো দেখা মেলে আসল মানুষটির। সেলিব্রেটি ইমেজ দূর হয়ে পরিচয় হয় সাধারণ মানুষটির সাথে। হয়তো দেখা যাবে, একজনের মনে থাকা সেই আকর্ষণীয় ইমেজের অন্য মানুষটির হাজার গণ্ডা বদঅভ্যাস আছে। হতে পারে, খুব ছোটখাটো কোনো বিষয়ই একজন সেলিব্রেটিকে অন্যজনের কাছে অনেক প্রিয় করে তুলেছিল, কিন্তু বাস্তবে তিনি তেমন নন। হয়তো পর্দার সেই সাহসী মানুষটি মাকড়সা দেখলে কুঁকড়ে যায়, কিংবা একজনের মনে থাকা মিস্টার পারফেক্ট নায়ক ঘুমের ঘোরে নাক ডেকে তার ঘুম হারাম করে দেয়, কিংবা এতদিনের জানা সবচেয়ে রোমান্টিক মানুষটির মধ্যে রোমান্টিসিজমের লেশমাত্র নেই অথবা সে মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ।
বেশিরভাগ সময় এভাবেই তারকাদের সম্পর্কে প্রথম ধাক্কাটা আসে। তারকা হিসেবে যে ছবি তাদের মনে আঁকা ছিল, তার সাথে বাস্তবের মানুষটার মিল থাকে হয়তো সামান্যই। আর এটিই অনেকসময় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে।
ব্যস্ত শিডিউল
অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক বা পরিচালকদের প্রচুর পরিমাণ সময় ভ্রমণে কাটাতে হয়। প্রায়ই মাসের পর মাস থাকতে হয় বাড়ির বাইরে। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর একজন তারকা হলে হয়তো অন্যজন তার সাথে ভ্রমণ করে কাটাতে পারে। কিন্তু তা-ও সম্ভব হয় না সবসময়। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারও নিজস্ব কাজ থাকে। আর দুজনই তারকা হলে তো সমস্যা আরো বেশি বড় হয়ে ওঠে। দেখা যাবে, একজন হয়তো আমেরিকায় কোনো কনসার্টে ব্যস্ত। অন্যজনের শ্যুটিং চলছে প্যারিসে। এই ব্যস্ত সময়ের কারণে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সঙ্গীকে কাছে না পাওয়া, খারাপ সময়গুলোতে মানসিক সমর্থন না পাওয়া, যৌনসম্পর্ক কমে যাওয়া- এসবের ফলে তারা যেন বিবাহিত থেকেও ব্যাচেলরের মতো জীবন যাপন করেন। আর সেই দম্পতির সন্তান থাকলে, ঝামেলার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়, দুজনেরই ব্যস্ত সময়ের মাঝে কে সন্তানের দেখভাল করবে, সেটিও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
তারকাদের ক্ষেত্রে প্রলোভন বেশি থাকে
একজন সাধারণ চাকুরীজিবি নারী বা পুরুষকে কখনোই তার চাকরির জন্য কাউকে চুমু খেতে হয় না বা গভীর ভালোবাসার অভিনয় করতে হয় না। কিন্তু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তা করতে হয়। গায়কদের অন্যদের সাথে স্টেজ পারফর্ম করতে হয়। এভাবে কাজের ক্ষেত্রে শারিরীকভাবে কাছাকাছি আসার প্রভাব কখনো কখনো বাস্তবেও পড়তে দেখা যায়। পর্দার রসায়ন বাস্তবেও তাদের কাছাকাছি নিয়ে আসে অনেক সময়।
এখন সেই অভিনেতা অভিনেত্রীরা যদি বিবাহিত হয়েও থাকেন, আর তাদের বিবাহিত জীবন যদি সমস্যাগ্রস্থ হয় বা বৈবাহিক সম্পর্কের গভীরতা হারিয়ে যায়, তবে এই কাজের খাতিরে অন্যদের কাছাকাছি আসাটা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে। আর এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তারকাদের প্রেমপ্রার্থীর অভাব হয় না কখনোই, তাই তাদের জন্য এসবে প্ররোচিত হওয়াটাও অনেক সহজ।
নার্সিসিজম
যখন লক্ষ লক্ষ লোক প্রতিনিয়ত আপনার প্রশংসা করছে, আপনার একটু দেখা পাওয়ার জন্য জান বাজি রাখছে, আপনার একটু ছোঁয়া পেলে জীবনকে ধন্য মনে করছে, এ অবস্থায় আপনার মধ্যে নার্সিসিজম চলে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। আপনার হয়তো মনে হবে, আপনি সত্যি সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে অনন্য একজন মানুষ। এই অবস্থায় সঙ্গীর সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপস করার প্রবণতা না-ও থাকতে পারে। সঙ্গীকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার প্রবণতাও আপনার মাঝ থেকে দূর হয়ে যেতে পারে।
আর সবার এত প্রশংসার বিপরীতে আপনার সঙ্গী যখন আপনাকে সাধারণ মানুষ হিসেবে ধরে নিয়ে আচরণ করবে, তখন হয়তো আপনার মনে হতেই পারে যে, আপনার সঙ্গী আসলে আপনাকে উপযুক্ত সম্মান দিচ্ছে না। এটি আসলে সব তারকাদের ক্ষেত্রে হয় না। পরিণত তারকাদের অধিকাংশই এ সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারেন। তবে উঠতি তারকাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা বাঁধার সুযোগ থাকে বেশি।
পেশাগত ঈর্ষা
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তারকা হলে, যদি একজনের ক্যারিয়ারের গতি উপরের দিকে উঠতে থাকে, আর অন্যজনের ক্যারিয়ার নামতে থাকে নিচের দিকে, তবে সেখানে পেশাগত ঈর্ষা অস্বাভাবিক কিছু না। আর ঈর্ষার ক্ষমতা যে কতটা হতে পারে, সেটি আমাদের অজানা নয়।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
এটি শুধু সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে নয়, সকল ধনী ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একজন সাধারণ মানুষ ডিভোর্স নেওয়ার আগে ভাববে তার একলা জীবনের কথা, ডিভোর্সের ফলে খরচার কথা, পরে নিজের একার আয়ে সংসার চালাতে পারবো কিনা সেসব কথা। ভালোবাসার মতো কাউকে কি আবার খুঁজে পাবে কিনা, সেটিও বড় একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এসব প্রশ্নগুলো তাকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আরো পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করে।
অন্যদিকে তারকাদের জন্য এসব প্রশ্ন অন্য মানুষের মতো অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা অধিকাংশেরই যথেষ্ট পরিমান আর্থিক সচ্ছলতা আছে। তাছাড়া অনেক আকর্ষণীয় মানুষের সাথেই তাদের ওঠাবসা হয়, যাদের মধ্যে তাদের গুণমুগ্ধ ব্যক্তির সংখ্যাও কম থাকে না। তাই পুনরায় ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়াটাও তাদের কাছে অতোটা কঠিন মনে হয় না।
তাছাড়া অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো বিবাহিত জীবন হলো জীবনের অনেকগুলো দিকের একটি মাত্র। এটি ছাড়াও হয়তো তাদের ব্যস্ত থাকার, ভালো থাকার অনেক উপকরণ আছে জীবনে। এর সবকিছুই একজন সাধারণ মানুষের থাকে না। এসব কারণে ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা নেওয়াটা হয়তো সহজ হয় তাদের জন্য।
যা-ই হোক, সব তারকার বৈবাহিক সম্পর্কই যে সমস্যাগ্রস্ত, তা কিন্তু নয়। বরং তারকাদের অধিকাংশই রয়েছেন গভীর পরিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু পত্রিকার জন্য সেগুলো ঠিক ‘গরম খবর’ না হওয়ায়, আমরা কেবল নেতিবাচক খবরগুলোই সামনে পাই। তাই তাদের সম্পর্কে আমাদের মনে একটি বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। তারকা বলেই কি মানুষের সম্পর্কের মতো জটিল একটি বিষয় নিয়ে কারো ব্যাপারে গড়পড়তা কোনো ধারণা পোষণ করা উচিত? প্রশ্নটি ভাবা দরকার সব শ্রেণীর মানুষেরই।