‘মা দিবস’ সম্পর্কে কে না শুনেছে? প্রতি বছর আমরা অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে নানা রকম স্ট্যাটাস ও মায়ের ছবি শেয়ার দিয়ে মা দিবস উদযাপন করি। কেউ কেউ মাকে সারপ্রাইজ গিফট দেই, কেউ আবার মায়ের জন্য দিনটিকে আরও বেশি স্মৃতিমধুর করে তুলতে করি নানা আয়োজন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় সব দেশেই এ দিনটিকে ঘটা করে উদযাপন করা হয়। তবে বাবা দিবসটি নিয়ে এত মাতামাতি খুব কমই দেখা যায় হয়তো।
আজকের এই সময়েও মা দিবসের তুলনায় বাবাদের স্মরণে উৎসর্গিত এ উপলক্ষ উদযাপনে দেখা যায় না খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন।
বাবা দিবস কবে?
মা দিবসের মতো বিশ্ব জুড়ে বাবাদের প্রতি ভালোবাসা উদযাপনেও রয়েছে বিশেষ একটি দিন। সাধারণত জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাবা দিবস পালন করা হয়। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় বাবা দিবস পালন করা হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার।
এছাড়া কিছু ঐতিহ্যপূর্ণ ক্যাথলিক দেশ; যেমন- স্পেন, পর্তুগালে ১৯ মার্চ, ‘সেন্ট জোসেফ ডে’-তে বাবা দিবস পালন করা হয়। তাইওয়ানিজরা বাবা দিবস পালন করে থাকে আগস্ট মাসের আট তারিখে, যা কি না বছরের অষ্টম মাসের অষ্টম দিন। কারণ, তাদের মতে মান্দারিন ভাষায় সংখ্যা ‘আট’-এর উচ্চারণ কিছুটা বাবাকে আদর করে ডাকা ‘পাপা’ শব্দের কাছাকাছি। এছাড়াও থাইল্যান্ডে প্রয়াত রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের জন্মদিন ৫ ডিসেম্বরে বাবা দিবস পালন করা হয়। ২০২০ সালে বাবা দিবস পালিত হবে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার, ২১ জুন।
কীভাবে শুরু হয় বাবা দিবসের প্রচলন?
পৃথিবীতে প্রায় সব ঘটনা নিয়েই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন মতবাদ ও গল্পের প্রচলন। তেমনই বাবা দিবস নিয়েও রয়েছে বেশ কিছু গল্প।
কথিত আছে, গ্রেস গোল্ডেন ক্লাইটন নামের এক নারী সর্বপ্রথম বাবাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টে একটি দিন পালন করেন। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে, গ্রেস তার বাবার মৃত্যুতে শোকাহত ছিলেন। তার বাবা মনোনগাহতে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক কয়লা খনির বিস্ফোরণ দুর্ঘটনায় মারা যান। এক ধর্মযাজকের সাথে আলোচনা করে, গ্রেস তখন ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই তার বাবার জন্মদিনে সে সকল পিতার স্মরণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে সেই বিস্ফোরণ দুর্ঘটনায় নিহত সকল বাবার স্মৃতিচারণা করা হয়।
কিন্তু, বিভিন্ন কারণে গ্রেসের এ অনুষ্ঠানের খবর ফেয়ারমন্টের বাইরে খুব বেশি আলোচিত না হওয়ায় অধিকাংশ মানুষই দিনটির কথা ভুলে যায়। ফলে পরবর্তী বছরগুলাতে আর এ দিনটি উদযাপন করা হয়নি।
তবে বাবা দিবসের সূচনা নিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গল্পটি একটু আলাদা। নিজের বাবার প্রতি ভালোবাসা থেকে বিশ্বব্যাপী বাবা দিবসকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে সচেষ্ট মেয়েটির নাম ছিল সোনোরা।
সোনোরা স্মার্ট ডোডের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্কানসাসে। তার মা, অ্যালেন, নিজের ষষ্ঠ সন্তান জন্মদানের সময় মৃত্যুবরণ করেন। সেই থেকে নিজের ছয় সন্তানের লালন-পালনের ভারটা একাই নিজের কাঁধে তুলে নেন সোনোরার বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট। গৃহযুদ্ধের সাবেক সৈনিক উইলিয়াম তখন সংসারের ভরণপোষণ জোটাতে একটি ছোট খামারে কৃষিকাজ শুরু করেন।
১৯০৯ সালে সোনোরার বয়স তখন ২৭ বছর। একদিন গির্জার একটি অনুষ্ঠানে মা দিবস সম্পর্কে বক্তৃতা শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই তার উপলব্ধি হয় যে, তার বিপত্নীক বাবা নিজের জীবনের সব সুখ ত্যাগ করে শুধুমাত্র তাদের ছয় ভাই-বোনকে বড় করতে কতটা কষ্ট করেছেন। বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকেই সোনোরা ভাবলেন, যদি প্রতি বছর মায়েদের স্মরণে মা দিবস পালন করা যেতে পারে, তাহলে বাবা দিবস কেন পালন করা যাবে না?
যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। সোনোরা তার এই ভাবনা স্থানীয় কয়েকজন ধর্মযাজককে জানালেন। যদিও তার ইচ্ছা ছিল, বাবা দিবস পালন করা হবে তার বাবার জন্মদিন, ৫ জুনে; কিন্তু ধর্মযাজকদের প্রস্তুতি না থাকায় তা পরিবর্তন করে নেয়া হয় জুন মাসের তৃতীয় রবিবারে। অতঃপর, ১৯১০ সালের ১৯ জুন ওয়াশিংটনের স্পোকান শহরে সোনোরা প্রথমবারের মতো বাবা দিবস পালন করেন। যদিও তাতে খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।
কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে এ দিনটি নিয়ে কারোরই কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সোনোরা নিজেও তখন শিকাগোতে লেখাপড়ায় ব্যস্ত। ১৯৩০ সালে, নিজের শহর স্পোকানে ফিরে আসেন ডোড। এসেই আবারও বাবা দিবস পালনের জন্য সবাইকে উৎসাহ যোগানো শুরু করেন তিনি। বাবা দিবস পালনের জন্য তার এই দৌড়াদৌড়ি দেখে গণমাধ্যমের অনেকেই হাসি-তামাশা করে তখন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। নিজের ইচ্ছাকে প্রতিজ্ঞায় রূপ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন অবিরাম। কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা ও ইয়াং ম্যান খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় বাবা দিবসের প্রচারণা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। প্রথমদিকে খুব বেশি অগ্রগতি দেখা না গেলেও, ধীরে ধীরে তার এ প্রচারণা জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে, গোটা আমেরিকা জুড়ে দিনটি পালন করা শুরু হয়।
১৯১৩ সালে এ দিনটিকে জাতীয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য কনগ্রেসে প্রথম বিল উত্থাপন করা হলো। ১৯১৬ সালে স্পোকান শহরের এক বাবা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে কনগ্রেস।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ সালে আবারও আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কেলভিন কোররিজ বাবা দিবস উদযাপনের প্রতি সম্মতি দেন। অবশেষে, ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন তার এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে জাতীয় বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেন। ছয় বছর পর, ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একে আইনে পরিণত করেন।
সেই থেকে আজ অবধি প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বব্যাপী বাবা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
আপনি বাবাকে কী বলে ডাকেন?
বিশ্বজুড়ে ‘বাবা’ ডাকটির রয়েছে বিভিন্ন রূপ। বাংলাদেশে কেউ ডাকে বাবা, কেউ ডাকে আব্বু, কেউ আবার ডাকে আব্বা। কেউ বা পাশ্চাত্যের টানে পাপা বা ড্যাডি বলেও ডাকে। রাশিয়ান, হিন্দি, স্প্যানিশ ভাষায়ও ‘পাপা’ ব্যবহৃত হয়। জার্মানে সাধারণত বাবাকে সম্বোধন করা হয় ‘পাপি’ বলে। আইসল্যান্ডিক ভাষায় বাবাকে ডাকা হয় ‘পাব্বি’। সুইডিশ ভাষায় বাবা হলো ‘পাপ্পা’। এছাড়াও তুর্কি, গ্রিক, সোয়াহিলি, মালয় ভাষাসহ আরো অনেক ভাষায় ব্যবহৃত হয় ‘বাবা’। কিন্তু এতসব ডাকের উদ্ভব কোথা থেকে, কখনো ভেবে দেখেছেন?
শিশুরা যখন নতুন নতুন কথা বলতে শেখে, তখন তারা মুখে ভাঙা ভাঙা অনেক শব্দ করে থাকে। ধারণা করা হয়, প্রথম কথা বলতে শেখার সময় শিশুরা ম, ব, দ, ত- এই ব্যঞ্জনবর্ণগুলো সহজে উচ্চারণ করতে পারে। আর তাই বাবা শব্দটা উচ্চারণ করাও সহজ হয়ে যায়। আর এজন্য অনেক বাবাই নিজ সন্তানের মুখে প্রথম শব্দ ‘বাবা’ শোনার সৌভাগ্য পেয়ে থাকেন।
অনেকে কিন্তু বাবাকে ‘ড্যাডি’ ডাকে। এ শব্দটিও শিশুর মুখের আধো বুলি ‘ডা ডা’- এমন ধরনের শব্দ থেকেই এসেছে।
‘বাবা’ শব্দের ইংরেজি হলো Father, যা অনেকটা pater শব্দের কাছাকাছি। pater শব্দটি হলো paeder শব্দের বিশেষ্য রূপ, যার অর্থ পাথর। মিল খুঁজে পেলেন কিছু? আসলে পাথরের দৃঢ়তায় কোমল হৃদয় নিয়েই তো মানুষটা আমাদের লালন-পালন করেন।
বাবা দিবসের প্রথম উপহার কী ছিল?
যদিও বাবা দিবস পালন শুরু হয় ১৯১০ সাল থেকে, তবে বাবা দিবসে নিজের বাবার জন্য প্রথম কার্ড কিন্তু বানিয়েছিল ৪,০০০ বছর আগে ব্যাবিলনের এক ছোট্ট ছেলে, নাম তার এলমেসু।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদানের বিচারে পৃথিবীর চতুর্থ বিখ্যাত দিবসটির নাম বাবা দিবস। মজার বিষয় হলো, বাবা দিবসের শুভেচ্ছা হিসেবে প্রায় ২০ শতাংশ কার্ড বাবাদের কাছে যায় তাদের সন্তানের মায়েদের কাছ থেকে। এছাড়াও বাবা দিবসে সারাবিশ্বে বাবাদের পাওয়া অন্যতম উপহার হলো টাই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস কীভাবে পালিত হয়?
বিশ্ব জুড়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিশেষ দিবসগুলোতে বিভিন্ন রকম প্রথার প্রচলন দেখা যায়। ব্যতিক্রম নয় বাবা দিবসও।
থাইল্যান্ডে বাবা দিবসে হলুদ রঙের কাপড় পরা সেখানকার প্রথা। মেক্সিকোতে বাবা দিবসে শহরে ১৩ মাইল লম্বা একটি দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, যার নাম ‘ক্যানেরা ডিয়া ডেল পেড্রো’। বাবাদের সাথে সাথে ওই দৌড়ে অংশ নেয় সন্তানরাও।
জার্মানিতে আবার বাবা দিবসে সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর বদলে বাবারা বরং দল বেধে হাইকিং করতে যান। নেপালে ছেলেমেয়েরা বাবা দিবসে পিতা-মাতার জন্য মিষ্টি কিনে আনে এবং বাবার কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়। আর যাদের বাবা মারা গেছেন, তারা সমাধিস্থানে গিয়ে বাবাকে স্মরণ করে।
ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্সে বাবা দিবস পেয়েছে ধর্মীয় রূপ। বাবা দিবসকে সেখানে ক্যাথলিক উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। ঊনিশ শতকের দিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আবার এর প্রচলন হয়। বাবা দিবসে ফ্রান্সের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে নানান রকম উপহার দিয়ে থাকে, এর মধ্যে অন্যতম প্রধান উপহার হচ্ছে গোলাপ ফুল। যাদের বাবা বেঁচে আছেন, তারা বাবাকে উপহার দেয় লাল গোলাপ। আর যাদের বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তারা বাবার সমাধিতে রেখে আসে সাদা গোলাপ।
বাবার জন্য ভালোবাসা কি তাহলে শুধুই একদিন?
অন্তত আমাদের দেশের আবহতে ‘বাবা’ শব্দটা ভাবতেই যেন মনের ভেতর ভাবগাম্ভীর্য আর ভয় চলে আসে। একটা বয়স পেরিয়ে যাবার পর রাগী মানুষটার সামনে হয়তো প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি যাওয়াও হয় না। কিন্তু অনেকে ভুলে যায়, বাবাই কিন্তু ছেলেদের প্রথম ফুটবল খেলার সাথী হয়, বাবাই কিন্তু হয় মেয়েদের প্রথম ‘সুপার হিরো’।
বাবা-মা কে ভালোবাসার জন্য আসলে সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আমাদের দিনগুলো সাজাতেই তারা সারাজীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু একটা দিন যদি শুধু তাদের মুখের হাসির দেখার জন্যই আয়োজন করা হয়, তাতে ক্ষতি কী? সন্তানদের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু হয়তো আশাও করেন না তারা। কিন্তু সেই একটি দিনের হাসিই হয়তো তাদের বাঁচিয়ে রাখবে একটি বছর। ব্যস্ততায় ছুটে চলা সন্তানদের সাথে কাটানো একটি দিনই হয়তো বছর জুড়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাবে সন্তানকে কাছে না পাবার অসংখ্য মুহূর্তে।
মায়ের জায়গা পৃথিবীতে কেউ নিতে পারে না, বাবার অভাবও কেউ পূরণ করতে পারে না। যারা বাবা হারিয়েছে, তারাই শুধু বোঝে, বাবা ছাড়া পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কতটা কঠিন। তাই বৃদ্ধ বয়সে বাবার ঐ ঘোলা চশমাতে আপনাকে ঝাপসা দেখা শুরু করার আগে, আপনার ব্যস্ত শিডিউল থেকে বছরের অন্তত একটা দিবস বাবাকে উপহার দিন। প্রতি বছরের ঐ একটা দিনই বাবার স্মৃতিতে আপনাকে কখনো ঘোলা হতে দেবে না।
যারা বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে থাকেন, বিদেশে থাকেন, বাবা দিবসে সময় করে একবার বাবাকে ফোন করে দেখুন না। হয়তো ওপাশ থেকে বাবা বলে উঠবেন, “আয় খুকু আয়”।