ধরে নিন, আপনি হাইওয়েতে বেশ উচ্চগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আপনি বাইকটি দু’ভাবে চালাতে পারেন। হয় ব্রেক, ক্লাচ, হর্ন, আলোর সংকেত, গিয়ার, ইত্যাদি সব সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আবার এসব কিছুর দায়িত্ব অবচেতন মনের হাতে সপে দিয়ে আপনি বন্ধুদের সাথে গান গেয়ে বা হৈ-হল্লা করতে করতে চলতে পারেন।
আপনার অবিচেতন মন এ কাজগুলো ঠিকঠাক সামলে নেবে। মাঝেমধ্যে আচমকা কোনো কিছু ঘটলে হয়তো আপনার সচেতন মনের সাহায্যের দরকার হবে। নচেৎ আপনি টেরই পাবেন না, কীভাবে আপনি বিশাল রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলছেন। আসলে আমরা আমাদের জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে এভাবে সচেতন আর অবচেতন মনের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেই।
এটি আপনি এখনো করছেন, এই যে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, মাঝে মাঝে চোখের পলক ফেলছেন, বসার একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গী ধরে রেখেছেন বা পড়ার সময় চোয়াল বদ্ধ করে রেখেছেন। এ কাজগুলো কিন্তু আপনি সচেতনভাবে করছেন না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করা স্নায়ুতন্ত্রের হাতে এ দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তবে চাইলেই আবার আপনি সচেতনভাবে এ কাজগুলো করতে পারেন। যেমনটি বাইক চালানোর ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি।
এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের অবচেতন মনকে কাজে লাগাই। আমাদের কাছে এটি মানুষের মনের অদ্ভুত একটি অংশ যা বিরক্তিকর কাজগুলো করে, সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ যার নেই। তবে বিজ্ঞান কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অবচেতন মন অমিত সম্ভাবনা ধারণ করে। আমাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্তগুলোতেই অবচেতন মনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অবচেতন মন কতটা শক্তিশালী হতে পারে একটি উদাহরণ দেখা যাক।
ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী একবার একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেখানে তারা কয়েকজন ব্যক্তিকে বললেন তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধটি স্মরণ করতে, এমন কিছু যা খুবই অনৈতিক ছিল। এরপর এটি স্মরণ করার ফলে তাদের অনুভূতি বর্ণনা করতে বললেন। এ বর্ণনা শেষে তাদের দুটি দলে ভাগ করা হলো। একদলকে হাত ধোয়ার সুযোগ দেয়া হলো, আরেকদলকে সে সুযোগ দেয়া হলো না।
এবার মূল পরীক্ষার পালা। তাদেরকে প্রস্তাব দেয়া হলো ছাত্র-ছাত্রীদের অন্য একটি পরীক্ষায় সহায়তা করতে। কিন্তু এ কাজের বিনিময়ে তারা কোনো টাকা পাবে না। কেবলমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপকার হবে এতে, খুশি হবে তারা। এখানে দেখা গেল, যাদের হাত ধোয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি তাদের মধ্যে ৭৪% এ প্রস্তাবে রাজি হলেন। অন্যদিকে যাদের হাত ধোয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে তাদের মাত্র ৪১% এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন।
এমনটি কেন হলো? আসলে নিজেদের পাপের কথা স্মরণ করতে গিয়ে একধরনের অনুশোচনা জেঁকে ধরেছিল তাদের মনে। এরপর যাদের হাত ধোয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে তারা অনেকটা হাত ধোয়ার সাথে সাথে তাদের এই পাপবোধকেও ধুয়ে ফেলেছেন। এর কারণটা বোঝা খুবই সহজ। আমরা পরিচ্ছন্নতা আর পবিত্রতাকে প্রায়ই এক করে ফেলি। পাপ বা খারাপ বোঝাতে নোংরা, ময়লা ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করি। আবার পবিত্রতা বোঝাতে পরিষ্কার,পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করি।
এছাড়া বিভিন্ন ধর্মে প্রার্থনার পূর্বে হাত-মুখ ধোয়ারও নিয়ম আছে, যেটি অনেকটা পবিত্রতা নির্দেশ করে। এসব কারণে হাত মুখ ধোয়া আমাদের কাছে স্রেফ হাত থেকে ময়লা দূর করার কাজই করেনা। অনেকটা আমাদের হাতের সাথে মনকেও ধুয়ে দেয়। আপনি হয়তোবা খেয়াল করে থাকবেন, গোসল করার পর নিজের মধ্যে কেমন যেন পবিত্রভাব উদয় হয়।
এ বিষয়টি ঘটেছে এসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও। যারা হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন, তাদের অনুশোচনা কমে গেছে বলে তারা কারো উপকার করার ক্ষেত্রে ততোটা আগ্রহী ছিলেন না। অন্যদিকে যারা হাত ধোয়ার সুযোগ পাননি, অনুশোচনা দূর করতে তারা অন্যের উপকার করতে অধিক আগ্রহী হয়েছেন। এই যে তাদের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতীতের স্মৃতিচারণ ও হাত ধোয়ার বিষয়টি প্রভাব ফেললো এটি তারা সচেতনভাবে চিন্তাও করেননি। এক্ষেত্রে কাজ করেছে অবচেতন মন।
এভাবে অতীতের কোনো বিষয় মানুষের আচরনে প্রভাব ফেলার এ প্রক্রিয়াকে প্রাইমিং বলা হয়। প্রত্যেকটি উপলব্ধি আপনি সচেতনভাবে খেয়াল করুন আর না-ই করুন, আপনার মস্তিষ্কে একই ধরনের অন্য একটি উদ্দীপনার জন্ম দেয়। যেমন- পেন্সিল আপনাকে কলমের কথা মনে করিয়ে দেয়, ব্ল্যাকবোর্ড স্মরণ করিয়ে দেয় ক্লাসরুমের কথা। এভাবে সবগুলো উদ্দীপনাগুলো একসাথে আপনাকে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে, বদলে দেয় আপনার আচরণকে।
এই প্রাইমিং যে মনের ওপর কতোটা প্রভাব ফেলতে পারে তা বোঝার জন্য ২০০৩ সালের অন্য একটি পরীক্ষার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেখানে মনোবিজ্ঞানীরা কয়েকজন মানুষকে দুটি দলে ভাগ করে নিয়েছিলেন। এরপর তাদের লিখিত বর্ণনা ও ছবির মধ্যে দাগ টেনে মেলাতে বললেন। এক দলকে সাধারণ সব ছবি দেয়া হলো। তারা ঘুড়ি, হাঙ্গর, টার্কি ইত্যাদির ছবি ও লেখার মধ্যে দাগ টানলেন। অন্য দলকে দেয়া হলো ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত সব ছবি, যেমন- ব্রিফকেস, ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি।
এরপর তাদের অন্য একটি পরীক্ষা দেয়া হলো। তাদের সবাইকে আলাদা আলাদা করে একজন সঙ্গী দেয়া হলো। আর সবাইকে দশ ডলার করে দেয়া হলো। বলা হলো এই দশ ডলার তার আর সঙ্গীর মধ্যে ভাগ করে দিতে। যদি তার সঙ্গী সেই ভাগাভাগিতে সম্মত হয় তবে তারা দুজনই সেই অনুসারে টাকা পাবে। আর সঙ্গী সম্মত না হলে তাদের কেউই কিছু পাবে না। এবারের ফলাফল হলো আরো অদ্ভুত। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা সঠিক বলেই প্রমাণাত হলো তাতে।
দেখা গেলো, যারা সাধারণ ছবি যোগ করেছেন তাদের মধ্যে ৯১% ব্যক্তি দশ ডলারকে দুজনের মধ্যে পাঁচ ডলার, পাঁচ ডলার করে ভাগ করেছেন। কিন্তু যারা ব্যবসা সংক্রান্ত ছবি যোগ করেছেন তাদের মধ্যে মাত্র ৩৩% টাকাকে এমন সমানভাগে ভাগ করেছেন। বাকীরা সবাই নিজের জন্য কিছুটা বেশী রেখে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টা কি ধরতে পারছেন? তারা কেবলমাত্র ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত কিছু ছবি নিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করেছেন, এতেই তাদের অবচেতন মন আগের থেকে বেশি লোভী হয়ে উঠছে।
শুধু এই একটি পরীক্ষাই নয় এ বিষয়ে চালানো আরো অনেকগুলো পরীক্ষায়ও একই ফলাফল পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝা যায় যে আমরা প্রতিনিয়ত যে বিষয়গুলো দেখি, শুনি বা উপলব্ধি করি- এসবই আমাদের প্রভাবিত করে। আমরা যখন সচেতনভাবে খেয়াল করিনা তখন এ প্রভাব আরো বেশী হয়। আর যখন জটিল কোনো পরিস্থতির উদ্ভব হয়, তখন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবচেতন মনের ভূমিকাই বেশী থাকে। কারণ আমাদের যৌক্তিক বা সচেতন মন একসাথে বেশী বিষয় সামলাতে পারে না। কোনো বিষয় সামলানোর জন্য তার একে ছোটখাট ভাগে ভাগ করে নিতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে সিলেবাল ভেঙ্গে কঠিন ইংরেজি শব্দ শেখার কৌশলটিকেই দেয়া যায়। যেমন ধরুন ইংরেজি একটি শব্দ ‘lieutenant’। এর বানানটি বেশ জটিল গোছের। মনে রাখাও একটু কঠিন। কিন্তু আমরা যদি একে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নেই যেমন: Lie u ten ant। এবার এটি মনে রাখা খুবই সহজ। এর কারণ সচেতন মনের যেকোনো কাজ করার আগে বিষয়গুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিতে হয়।
কিন্তু বিষয়গুলো যখন অনেক জটিল হয় আর দ্রুত করতে হয় তখন এটি অবচেতন মনের হাতে চলে যায়। যেমন ধরুন, গিটার বাজানো, ব্রেক ডান্স করা, কার্ড শাফল করা বা তালের সাথে মিল রেখে গান গাওয়া। এসব কাজ সহজ মনে হলেও এসবে অনেকগুলো ধাপ আছে আর এগুলো খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে হয়। এ কাজগুলো অবচেতন মনই সামলায়। কারণ বিবর্তনজনিত কারণে আমাদের অবচেতন মন সচেতন মনের তুলনায় অধিক শক্তিশালী।
আমরা যদিও মনে করি আমরা সচেতনভাবে সব সিদ্ধান্ত নিই, আসলে আমাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই নেয় অবচেতন মন। বস্তুত আমরা নিজেরা যে কতটুকু অসচেতন সে বিষয়েই আমরা অসচেতন। আর আমাদের মনকে প্রভাবিত করার এ কৌশল কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে গড় উঠেছে হরেক রকমের ব্যবসা। ক্যাসিনোর কথাই ধরুন, আপনি একবার এতে ঢুকে গেছেন তো এর মিউজিক থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ব্যবস্থাপনা আপনাকে আটকে রাখবে।
এ কৌশল কাজে লাগায় ফেসবুকের মতো ওয়েবসাইটগুলোও। আপনি একবার ঢুকলে বের হওয়াটা কষ্টের। যদিও আপনি সচেতনভাবে জানেন আপনার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ। বিজ্ঞাপনগুলোও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে আপনাকে প্রাইমিং করতে। আপনি নিজেও হয়তো জানেন না আপনি কেন একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য কিনছেন। জিজ্ঞেস করলে হয়তো একটি জবাব দেবেন যাতে মনে হবে এটি আপনার সচেতন সিদ্ধান্ত। কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রেই এ জবাবটি নিজেকে সান্তনা দেয়া বৈ ভিন্ন কিছু নয়। আমরা কেন প্রভাবিত হচ্ছি সেটি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না।