নিয়ম মেনে শীত হানা দিয়েছে প্রকৃতিতে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বদলাতে হচ্ছে আমাদের জীবনধারা। এই শীতকালে এসে একটা বড়সড় সমস্যা বাধে আমাদের গোসল করার অভ্যাস নিয়ে। সাধারণত বাংলাদেশীদের দিনে অন্তত একবার করে গোসল করার অভ্যাস। কিন্তু এই শীতে গোসল তো দূরের কথা, গরম কাপড় চোপড়ের ওম ছেড়ে ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধোয়ার কথা ভাবলেই গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়!
অবশ্য অনেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে শীতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের অভ্যাস জারি রেখে যান। কিন্তু প্রশ্ন হলো- তার দরকার আছে কি? শুধু শীতকাল নয়, সবসময়ই আমাদের আসলে কতটা ঘন ঘন গোসল করা প্রয়োজন? আর নিয়মিত সাবান বা শ্যাম্পুর ব্যবহার আমাদের ত্বকের জন্য কতটা উপযোগী? এই প্রশ্নগুলোর জবাব নিয়েই আজকে আলোচনা করা হবে। ত্বক বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে।
মানুষের গোসল করার অভ্যাস পরিবেশভেদে ভিন্ন হয়। তবে দৈনিক গোসল করার অভ্যাস তৈরির পেছনে সাবান, শ্যাম্পু বা এ ধরনের পণ্য তৈরি করা ইন্ডাস্ট্রিরও হাত রয়েছে। নিজেদের পণ্য বিক্রি বাড়ানোর জন্য তারা অপবিজ্ঞানের আশ্রয় নেয়, শরীরের গন্ধকে অতিরিক্ত ফোকাস করে মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন বানানো শুরু করে। নিয়মিত শ্যাম্পু করলে আপনি পাবেন নায়িকাদের মতো ঝলমলে চুল, সাবান ব্যবহার করলেই আপনার দেহের সৌরভে মাতোয়ারা হবে চারপাশ- এরকম আরো কত কিছু!
ধারণা করা হয়, তাদের এ ধরনের প্রচারণা কৌশলের ফলেই বিংশ শতকের দিকে এসে আমেরিকানদের গোসল করার অভ্যাস ‘সপ্তাহে একবার’ থেকে বদলে ‘দৈনিক একবার’ হয়ে যেতে শুরু করে। খাওয়া, ঘুমানোর মতো গোসলও প্রাত্যহিক জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মার্কেটিংয়ের প্রভাব খুব বেশি বলে মনে হয় না। কারণ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায়, নদীতে পুকুরে সাঁতার কেটে বেড়ানো থেকেই হয়তো প্রতিদিন গোসল করা আমাদের শহুরে জীবনেও চলে এসেছে।
যা-ই হোক, কত সময় পর পর গোসল করা উচিত- এ বিষয়ে ত্বক বিশেষজ্ঞদের অফিশিয়াল দিকনির্দেশনা তেমন একটা নেই। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি’র পরামর্শ হচ্ছে, খুব বেশি নোংরা না হলে সপ্তাহে একবার বা দু’বার গোসল করালেই চলে। তাছাড়া বাচ্চাদের একটু আধটু অপরিষ্কার থাকাও দরকার আছে। তাদের বিকশিত হতে শুরু করা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতে শক্তিশালী হয়। ব্যাকটেরিয়া, স্বল্প পরিমাণ ভাইরাস বা ছোটখাটো সংক্রমণ তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মজবুত করে তোলে।
আমাদের শরীরের ভেতরের অংশের মতো, বাইরের ত্বকেও সাম্যাবস্থা বিরাজ করে। উপকারী ব্যাকটেরিয়া, শরীর নিঃসৃত তৈলাক্ত রস ইত্যাদির সমন্বয়ে এই সাম্যাবস্থা গড়ে উঠে, যা বাহিরের পরিবর্তিত আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম। ত্বকে সাবান ব্যবহার করলে ত্বক পরিষ্কার করার পাশাপাশি এটি শরীর থেকে এই উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও তৈলাক্ত রসও অপসারণ করে ফেলে। এতে ত্বকে বিরাজমান সাম্যাবস্থা ব্যাহত হয়।
সাবান মূলত দু’ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি করা হয়, তেল বা চর্বি জাতীয় পদার্থের সাথে থাকে অ্যালকালাইন জাতীয় পদার্থ। এই দু’ধরনের পদার্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে ত্বক থেকে অন্যান্য তেলজাতীয় পদার্থকে বের করে আনে। যেমনটি আপনি দেখবেন সাবান দিয়ে কোনো নোংরা পাত্র ধোয়ার সময়ও এগুলো তেল জাতীয় পদার্থকে অপসারণ করে। এছাড়া সাবান ধ্বংস করে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় অণুজীবগুলোও।
তাই অতিরিক্ত সাবান ব্যবহারের ফলে ত্বকের সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়। ত্বক শুষ্ক হয়ে ওঠে। আর শীতকালের শুষ্ক আবহাওয়ায় এ শুষ্ক ত্বক আরো বড় সমস্যা হয়ে ওঠে। শ্যাম্পুর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে, শ্যাম্পু আমাদের চুল থেকে সেবাম নামক তৈলাক্ত পদার্থ অপসারণ করে ফেলে। অতিরিক্ত শ্যাম্পু ব্যবহারের ফলে চুল থেকে প্রয়োজনীয় তৈলাক্ত পদার্থ হারিয়ে চুল শুষ্ক হয়ে যায়। মাথার ত্বকেরও অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, যার ফলে খুশকির জন্য আপনার মাথার ত্বক সহজলভ্য হয়।
অবশ্য এতে আপনার ক্ষতি হলেও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির লাভটা কিন্তু বেড়ে যায়! এ পর্যায়ে তারা হাজির হয় ময়েশ্চারাইজার যেমন, কন্ডিশনার, লোশন ও খুশকিনাশক পণ্য নিয়ে। বিষয়টা একটু আজবই বলতে পারেন। আমরা প্রথমে তাদের সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহার করে আমাদের ত্বকের অবস্থা খারাপ করি। এরপর সে অবস্থা ভালো করার জন্য আবার তাদের লোশন, কন্ডিশনারের দ্বারস্থ হই।
আসলে এটি স্বাভাবিকভাবেই মাথায় আসে, আমাদের শরীরের ভেতরে যেখানে এতো মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে কিন্তু আমাদের ত্বকের এ ব্যবস্থা কি এতোই দুর্বল, যে এটিকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে? সবসময় হাত পরিষ্কার রাখা, দৃশ্যমানভাবে অপরিষ্কার কোনো অংশ বা শরীরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা পরিষ্কার করা দরকার। কিন্তু অপরিষ্কার না হলেও, নিয়মিত সাবান অথবা শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করার বিষয়টি আসলেই অস্বাভাবিক ঠেকে।
এবার আসা যাক সবচেয়ে বড় সমস্যাটিতে, শরীরের দুর্গন্ধ। নিয়মিত গোসল না করলে যে শরীরে দুর্গন্ধ হয় তাতে কী করনীয়? এ বিষয়ে কিছু মানুষ বেশ চরমপন্থী অনুশীলন করে দেখেছেন। তারা গোসল করা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেখেছেন, এটি কেমন প্রভাব ফেলে জীবনধারায়। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রথম প্রথম গোসল না করার প্রভাবটা বেশ বাজে। শরীরের দুর্গন্ধ, ঘাম ও তৈলাক্ত পদার্থ মিলিয়ে বেশ বিচ্ছিরি অবস্থা দাঁড়ায়।
এমন বাজে অবস্থার কারণও কিন্তু আমাদের সাবান ব্যবহার। ত্বকের ব্যাকটেরিয়াগুলো আমাদের শরীরের লোমকূপ থেকে নিঃসৃত তৈলাক্ত পদার্থগুলোর উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। আর আগেই বলেছি, প্রতিনিয়ত সাবান ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা তাদের এই বাস্তুসংস্থানের ব্যাঘাত ঘটাই। সাম্যাবস্থা হারিয়ে ফেলায় কিছুদিন সাবান ব্যবহার না করলে এরা আগের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে জন্মাতে শুরু করে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যাতে দুর্গন্ধ তৈরি করা অণুজীবগুলো অধিক জন্মায়।
তাহলে এই কিছুদিন না গোসল করে তৈলাক্ত, দুর্গন্ধময় প্রাণী বনে যাওয়ার পর তারা কী করছিলেন? তারা কিছুই করেননি। তারা এ অবস্থাকে মেনে নিয়েই এগিয়ে গেছেন। আর শরীরের ত্বক এর মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ত্বকে সৃষ্টি হয়েছে সাম্যাবস্থার। এরপর আর তার শরীর আগের মতো তেলতেলেও থাকেনি, দুর্গন্ধও কেটে গেছে। যদিও বডি স্প্রের মতো সুগন্ধ ছড়ায়নি গা থেকে, তবে অন্তত মানুষের স্বাভাবিক গন্ধ ফিরে এসেছিলো।
তবে কি আমাদেরও তাদের অনুসরণ করে গোসল সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেয়া উচিৎ? না তা নয়। উপরে সম্পূর্ণ আলোচনার সারমর্ম হিসেবে বলা যায়, প্রতিদিন গোসল আসলে আবশ্যিক কিছু না। আর নিয়মিত গোসল করলেও সারা শরীরে সাবান ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং এতে ক্ষতিই বেশি। শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশে সাবান ব্যবহার করলেই চলে। আর আমাদের অবশ্যই কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের ত্বকের জন্য কোনটা ভালো হবে তা বোঝা উচিৎ।