“সদা সত্য কথা বলিবে।” ছোটবেলা থেকে এটিই শেখানো হয়েছে আমাদেরকে। এমনকি পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে ধর্মগ্রন্থ, সবখানেই বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে সত্যবাদিতার উপর। কিন্তু তারপরও, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই প্রায় প্রতিটি মানুষই কম বেশি মিথ্যার সাথে বসবাস করতে শুরু করে।
অনেকে তো আবার সেই শৈশব থেকেই মিথ্যা বলার বদভ্যাস গড়ে তোলে। যেমনটি আমরা দেখেছিলাম শিশুতোষ ছড়ায়- জনিকে তার বাবা জিজ্ঞেস করছে, সে চিনি খেয়েছে কি না। শুরুতে কিন্তু জনি অস্বীকার করে, তবে মুখ খুলতে তার মিথ্যাটা ধরা পড়ে যায়। এভাবেই, অধিকাংশ শিশুরই ছোটখাট বিভিন্ন বিষয়ে সত্য কথা অস্বীকার করার মাধ্যমে মিথ্যার জগতে হাতেখড়ি হয়। এবং যতই দিন যায়, তাদের মিথ্যার প্রবণতা বাড়তেই থাকে।
এবং চমকে যাওয়ার মতো তথ্য হলো, একজন মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশ মিথ্যাই অচিহ্নিত থেকে যায়, যদি না মানুষটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্বব্যাপী পরিচিত কেউ হয়। বেচারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগ্য নিতান্তই খারাপ, তাই তার প্রতিদিন প্রকাশ্যে বলা সকল কথাই বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। এবং তার মাধ্যমে জানা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর ৮২৭ দিনেই তিনি প্রকাশ্যে ১০,০০০ তম মিথ্যা কথাটি বলে ফেলেছেন। অর্থাৎ তিনি প্রতিদিন প্রকাশ্যে গড়ে ১২টি করে মিথ্যা কথা বলেছেন।
কিন্তু যেমনটি বলছিলাম, আপনি যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প নন, তাই আপনার মিথ্যা ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এবং আপনি যদি নিতান্তই সাধারণ কোনো ব্যক্তি হন, তাহলে আপনার প্রতি ৫টি মিথ্যার মধ্যে ৪টিই হয়তো কেউ ধরতে পারবে না। এমনকি পলিগ্রাফ বা লাই ডিটেক্টরের পক্ষেও কোনো মিথ্যা ধরতে পারার সম্ভাবনা মাত্র ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। সুতরাং, এই পৃথিবীতে মিথ্যা কথা বলেও পার পেয়ে যাওয়া খুবই সম্ভব।
কিন্তু এবার মুদ্রার অপর দিকটি চিন্তা করে দেখুন। হয়তো আপনি কখনোই মিথ্যা কথা বলেন না, বরং আপনাকে অন্যের মিথ্যার শিকার হতে হয়। আপনি হয়তো খুবই সহজ-সরল, কিংবা আপনি মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পছন্দ করেন। আর সেই সুযোগে অনেকেই আপনাকে মিথ্যা বলে ধোঁকা দিতে পারে। এভাবে দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত আপনাকে ঠকতে হয় বা বোকা বনতে হয়।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কোনো মিথ্যাবাদীকে কীভাবে পাকড়াও করা সম্ভব? সরাসরি তাকে “তুমি মিথ্যা বলছো না তো?” ধরনের প্রশ্ন করে বিশেষ লাভ হবে না। কারণ, নিজ মুখে মিথ্যা স্বীকার করবে, এমন সৎ সাহস খুব কম মানুষেরই আছে। তার চেয়ে বরং নিজে একটু সচেতন থাকলেই মিথ্যাবাদীদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব। চলুন, জেনে নিই একজন মিথ্যাবাদীকে শনাক্ত করা কিংবা কেউ সত্য না মিথ্যা বলছে তা বুঝতে পারার কার্যকরী ধাপগুলো সম্পর্কে।
শুরু করুন নিরপেক্ষ বা আপাত নিরীহ প্রশ্ন দিয়ে
একজন মানুষ সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে, তা ধরতে পারার একদম প্রাথমিক ধাপ হলো তাকে খুবই প্রাথমিক, সাদামাটা কিছু প্রশ্ন করা। হতে পারে সেটি আজকের আবহাওয়া নিয়ে, দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে সে সম্পর্কে, কিংবা সন্ধ্যায় তার কী করার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ তাকে এমন সব প্রশ্ন করতে হবে, যেগুলোর উত্তর দিতে তাকে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে না, সাধারণভাবেই উত্তরগুলো সে দিতে পারবে। এবং যখন সে উত্তরগুলো দেবে, তখন কিছু ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে- সে কি নড়েচড়ে বসছে? সে কি বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে? আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থা থেকে চোখ সরিয়ে বা নামিয়ে ফেলছে? এভাবে আপনি তার সাধারণ আলাপচারিতার ঢং বা প্যাটার্ন সম্পর্কে জানতে পারবেন।
এবার করুন স্পর্শকাতর প্রশ্ন
নিরীহ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ঢং সম্পর্কে জানা হয়ে গেলে, এবার ধীরে ধীরে স্পর্শকাতর প্রশ্নের তালিকায় প্রবেশ করুন। তার সাথে পূর্ব-পরিচয়ের সূত্র ধরে তাকে এমন সব প্রশ্ন করুন, যেগুলোর উত্তর দেয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে অনীহা বা অস্বস্তি কাজ করতে পারে। এবং এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে তার অঙ্গভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তি, চোখের নড়াচড়া, বাক্যগঠন প্রভৃতি দিকে বিশেষ নজর দিন। কারণ, এসব প্রশ্নের উত্তরে সে সত্যি বা মিথ্যা যা-ই বলুক না কেন, তবু যেহেতু তাকে সচেতনভাবে উত্তরটা নির্ধারণ করতে হচ্ছে বা মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে হচ্ছে, তাই তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন খুব স্বাভাবিকভাবেই পরিলক্ষিত হবে। এবার যাচাই করে নিন, সাধারণ প্রশ্নের উত্তরের সাথে এসব অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তরে তার মধ্যে ঠিক কী কী পরিবর্তন এসেছে। বলাই বাহুল্য, এসব পরিবর্তন মিথ্যা বলার ক্ষেত্রেও তার মধ্যে দেখা যাবে। যাচাই সম্পন্ন হলো, এবার তার সাথে শুরু করুন মূল আলাপচারিতাটি।
খেয়াল করুন অঙ্গভঙ্গি
মিথ্যা বলার সময় একজন ব্যক্তি অবচেতন মনেই কিছু অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন তাকে গুটিয়ে যেতে দেখা যায়। এর মাধ্যমে সে চায়, তাকে যেন অপেক্ষাকৃত কম লক্ষ্য করা যায়। অনেকে আবার শরীর মোচড়াতে শুরু করে, অস্বস্তিতে হাতের আঙ্গুল লুকানোর চেষ্টা করতে থাকে। অনেককে কাঁধ ঝাঁকাতেও দেখা যায়। সাধারণ আলাপচারিতার একপর্যায়ে কাউকে যদি হঠাৎ করে এগুলো করতে দেখা যায়, তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে সে কথাগুলো বলতে স্বস্তিবোধ করছে না, কিংবা সরাসরি মিথ্যাই বলছে।
নজর রাখুন সূক্ষ্ম মৌখিক অভিব্যক্তিতে
মিথ্যা কথা বলার সময় অবশ্যই একজন মানুষের মৌখিক অভিব্যক্তিতে কিছু পরিবর্তন আসে। কিন্তু যারা মিথ্যা বলায় পটু, তারা মুখ একদম স্বাভাবিক রেখেও মিথ্যা বলে যেতে পারে। তারপরও, কিছু কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন তার অভিব্যক্তিতে আসতে বাধ্য। যেমন: কিছু মানুষের মুখের রঙ মিথ্যা বলার সময় ঈষৎ গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। কারো আবার নাকের পাটা খুব ধীরে ধীরে কাঁপতে থাকে। কেউ আবার তাদের ঠোঁট কামড়ে ধরে, ঘেমে যায়, কিংবা চোখের পাতা দ্রুত হারে খুলতে ও বন্ধ করতে থাকে। একজন মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন তার মস্তিষ্কে কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে যায়, এবং মৌখিক অভিব্যক্তির এসব পরিবর্তন মস্তিষ্কের ওই ব্যস্ততারই লক্ষণ।
তাছাড়া মিথ্যা বলার সময় হাসিরও একটি গভীর যোগসাজশ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি হয়তো সাধারণভাবে খুবই হাসিখুশি। কিন্তু মিথ্যা বলতে গিয়ে সে খানিকক্ষণের জন্য হাসতে ভুলে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, মিথ্যাকে ঢাকার জন্য সে পূর্বাপেক্ষা হাসির পরিমাণ বাড়িয়েও দিতে পারে। সুতরাং, কম হাসা বা বেশি হাসা থেকেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যেতে পারে।
মনোযোগ দিন বাচনভঙ্গি, গলার স্বর ও বাক্যের গঠনশৈলীতে
যেহেতু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আসার আগে আপনি সাধারণ আলাপ করে এসেছেন, তাই হঠাৎ করে তার কন্ঠস্বরে কোনো পরিবর্তন এলে সেটিও আপনার ধরতে পারার কথা। একজন মানুষ মিথ্যা বলার সময় প্রায়ই তার গলার স্বর ও বাচনভঙ্গিতে পরিবর্তন চলে আসে। কেউ পূর্বাপেক্ষা দ্রুত কথা বলতে থাকে, আবার কেউ ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে। গলার স্বরও হয় আগের থেকে জোরালো হয়, কিংবা দুর্বল হয়।
তাছাড়া মিথ্যা বলার সময় বাক্যের গঠনশৈলীও আগের থেকে অনেক জটিল হয়ে যায়। আগে হয়তো সে তিন-চারটি শব্দে একেকটা বাক্য শেষ করছিল। কিন্তু এখন সে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যাংশ একসাথে করে বেশ বড় ও জটিল একটি বাক্য তৈরি করছে, এবং সেই বাক্যে ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘তাছাড়া’ প্রভৃতি যুক্ত করছে। এর কারণ হলো, সত্য কথা বলার সময় মানুষের মস্তিষ্কে খুব বেশি চাপ পড়ে না। সে ইতিমধ্যেই যা জানে, সেগুলোই নিজের মতো করে বলতে শুরু করে। কিন্তু মিথ্যা বলার সময় তাকে পুরো বিষয়টিকে নতুন করে তৈরি করতে হয়। অনেকগুলো ব্যাপার একসাথে তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, এবং বলার সময় সে চায় একবাক্যেই সবগুলো ব্যাপারে কথা বলে ফেলতে।
আবার এমনও হতে পারে যে, নিজের মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সে বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তিও করতে পারে। এর কারণ হলো, সে নিজেই নিশ্চিত নয় যে মিথ্যা বলে আপনাকে সেটি বিশ্বাস করাতে পারছে কি না। তাই নিজে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই সে বারবার একই কথা বলতে থাকে, এবং প্রতিবার তার মধ্যে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বেশি মরিয়া হতে দেখা যায়।
দেখুন সে নিজের ব্যাপারে কথা বলা থামিয়ে দিল কি না
মানুষ যখন সত্য কথা বলে, তখন তার বিবরণী অনেক সাবলীল থাকে, এবং বর্ণিত ঘটনায় যদি সে নিজে উপস্থিত থাকে, তাহলে মূল প্রসঙ্গের বাইরে গিয়েও সে নিজের কিংবা নিজের অনুভূতির ব্যাপারে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। এর কারণ মানুষের আত্মপ্রেম বা আত্মনিমগ্নতা, যে কারণে সে স্বাভাবিকভাবেই সবকিছুর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চায়। কিন্তু যখন সে মিথ্যা কথা বলে, তখন তাকে অনেক সাবধান হয়ে যেতে হয়। মূল ঘটনাটি হয়তো সে নিজের মতো করে পাল্টে নিতে পারে, কিন্তু নিজের অনুভূতির স্মৃতিকে পরিবর্তন করা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। সেটি করতে গিয়ে বেফাঁস কিছু একটা বলে ফেলার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই মিথ্যাবাদী ব্যক্তি তার বিবরণ থেকে নিজেকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়। তখন তার কথায় আর আগের মতো বারবার ‘আমি’, ‘আমাকে’, ‘আমার’ প্রভৃতি উত্তম পুরুষ বা আত্মবাচক সর্বনাম ব্যবহৃত হয় না।
মনোবিদদের আরো একটি বিশ্বাস হলো, মানুষ যখন কোনো ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে, সেটির থেকে নিজেকে দূরে রাখার এক অদ্ভূত প্রবণতা তার মধ্যে কাজ করে। এ কারণেই মিথ্যা বলার সময় সে আর নিজের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করতে চায় না।
খুঁটিনাটি প্রশ্ন করুন
মিথ্যা বলার উপর্যুক্ত লক্ষণগুলো কারো মধ্যে দেখা গেলেই যে সে মিথ্যা বলছে, এমন ধরে নেয়াটা ঠিক হবে না। কারণ অন্য কোনো কারণেও একজন ব্যক্তির মধ্যে ঐসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে। প্রথমত, সে হয়তো মিথ্যা বলছে না, শুধুই অস্বস্তিবোধ করছে। দ্বিতীয়ত, অন্য কোনো ব্যক্তিগত কারণেও আকস্মিকভাবে তার মধ্যে এসব পরিবর্তন আসতে পারে। তাই নিশ্চিত হওয়ার সর্বশেষ ও সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো তাকে খুঁটিনাটি বিভিন্ন প্রশ্ন করা।
একজন ব্যক্তি প্রথমে নিজের মতো করে কোনো একটি মনগড়া মিথ্যা কথা বলে দিতেই পারে। কিন্তু তাকে বিপাকে পড়তে হয় ঐ ব্যাপারে আরো খুঁটিনাটি বর্ণনা দিতে গিয়ে। আপনি তাকে ঘটনা সংশ্লিষ্ট একেবারেই অবান্তর কিংবা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করে বসতে পারেন, যেগুলোর উত্তর হয়তো সে আগে থেকে ঠিক করে রাখেনি। আপনার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ করে যদি সে উত্তরটি বানাতে যায়, তাহলে সেই নবনির্মিত উত্তরের সাথে তার আগের উত্তরের কিছু পার্থক্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। এভাবে বারবার তাকে বিভিন্ন খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতে থাকলে, একবার না একবার সে এমন কোনো একটি উত্তর দিয়ে বসবেই, যার সাথে তার আগের বলা কথার কোনো মিল নেই। এবং এভাবেই হাতেনাতে ধরে ফেলা যাবে তার মিথ্যাটি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/