সুমনের আজ একটা অফিস পার্টি রয়েছে। তৈরি হয়ে যথাসময়ে পার্টিতে গেলো সে। গিয়েই তো তার চক্ষু ছানাবড়া! এত এত মানুষের আনাগোনা, ঝা তকতকে পোশাকে পরিপাটি সকলেই।
সে যতটা আত্মবিশ্বাস আর খুশিমনে পার্টিতে এসেছিল, সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে ইতোমধ্যে। নিজের অজান্তেই পার্টিতে অংশগ্রহণ করা অতিথিদের পরখ করতে শুরু করলো সুমন। যতই তাদের পরখ করে, ততই নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে সে।
সুমনের মনে হতে থাকে, ইশ, যদি মাটি ফাঁক হতো, তবে ভেতরে ঢুকে পড়তাম! এখান থেকে বেরুতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। উপস্থিত সবার মধ্যে নিজেকে তার বেমানান ঠেকতে লাগলো।
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষক আলফ্রেড অ্যাডলার এ ধরনের মানুষদের নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালাচ্ছিলেন। তিনি ‘সবসময় অনিরাপদ বোধ করা’ এসব মানুষদের ভেতর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন। যেটিকে তিনি ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স‘ নামে অভিহিত করেন।
এই কমপ্লেক্স হচ্ছে মনের এমন এক অবস্থা, যখন কোনো ব্যক্তি, অন্য লোকেদের সামনে নিজেকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেন না, এবং তখন নিজের ভেতর নিজেকে ছোট ভাবার এই অবস্থা কাটিয়ে তুলতে, নিজের চারপাশেই একটা দেয়াল তুলে ধরেন। এই কাজটি কেন করেন তারা? যাতে আশপাশ মানুষের কাছে, তার এই হীনমন্যতা বা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ধরা না পড়ে।
নিজের হীনমন্যতা ঢাকবার ক্রমাগত প্রয়াস তাদের অধৈর্য করে তোলে। তারা যেকোনোভাবে নিজের অবস্থানকে ওপরে উঠানোর চেষ্টায় থাকেন। তবে উপস্থিত লোকজনদের কাছে তাদের এহেন আচরণ সুখকর হয় না। কারণ হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা ব্যক্তি নিজেকে তুলে ধরতে গিয়ে, প্রায়ই অন্য ব্যক্তিকে অসম্মান করে বসেন নিজের অজান্তেই।
একজন ব্যক্তি ঠিক কী পরিমাণ হীনমন্যতায় ভুগছে, সেটা হয়তো পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের আচরণের কিছু সাধারণ দিক রয়েছে, যা তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে বা চর্চা করে। এই আচরণগুলোর মাধ্যমে তারা মূলত অন্যদের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। চলুন, এবারে সে আচরণগুলোর দিকেই দৃষ্টি দেওয়া যাক।
১. নিজেকে ব্যস্ত হিসেবে উপস্থাপন করা
হীনমন্যতায় ভোগা মানুষদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, আশপাশের মানুষদের এড়িয়ে চলার জন্য নিজেকে ব্যস্ত হিসেবে উপস্থাপন করেন। বারবার ঘড়ি দেখা, দ্রুত কথা বলা, কথা শোনার ব্যাপারে অমনোযোগী ভাব- এগুলোই তাদের ব্যস্ততা দেখানোর উপায়।
ব্যস্ততা দেখানোর এমন বদভ্যাস হয়তো অপর পাশের মানুষটি ধরে ফেলতে পারেন, যা তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে নিজেকে ব্যস্ত দেখানোর এই কৌশল কিন্তু প্রায় সময় যথেষ্ট কার্যকর।
সাধারণত আমরা ভেবে নিই যে, কোনো মানুষ ব্যস্ততা দেখাচ্ছে মানেই সে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি, যে অল্প সময়ে অনেক কাজ সামলায়। তাই অপর ব্যক্তিটি যখন দেখবে আপনি ব্যস্ত, স্বভাবতই সে আপনাকে এড়িয়ে চলতে চাইবে। কারণ, আপনি কথা বলার সময় কিংবা তার উপস্থিতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাই হীনমন্যতা ঢাকার এই ডিফেন্স মেকানিকজম প্রায়ই খুব কাজে দেয়।
২. অপরকে অবজ্ঞা করা
আপনি এমন একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলছেন, যিনি হয়তো আপনার চেয়ে বড় মাপের মানুষ। অন্তত তার সাথে কথা বলে এটাই মনে হচ্ছে আপনার। এরকম পরিবেশে আপনার যদি হীনমন্যতাভাব জেগে ওঠে, আপনি স্বভাবতই ভাববেন, এমন পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
সে সময় অস্ত্র হিসেবে, লোকটির সামনে নিজের গুণকীর্তন করা শুরু করলেন আপনি। মানুষটিও হয়তো আপনার অর্জনের ফিরিস্তি শুনছে। এতটুকু অবধি সব ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু হঠাৎ আপনি এমন কিছু বলে বসলেন, যা আপনার সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে আঘাত করে। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, নিজেকে ওপরে তুলে ধরতে হলে আরেকজনকে নিচে নামাতে হয়। আপনার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে অপমান করে হয়তো আপনি নিজের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠলেন। কিন্তু ততক্ষণে তার সাথে আপনার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছে গেছে।
চলতে ফিরতে আমাদের সমাজে এমন মানুষদের দেখা পাওয়া যায় অহরহ। পারিবারিক জীবনে যেটি দাম্পত্য কলহের অন্যতম কারণ। স্বামী কিংবা স্ত্রীর কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরার জন্য অনেকেই এমন আচরণের আশ্রয় নেন। যার পরিণতি সব জায়গাতেই ভয়াবহ।
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে আলাপ বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা, কিংবা যেকোনো স্থানে, আপনি যদি নিজেকে উপরে তুলতে গিয়ে অপরজনকে হেয় করেন, সেটা আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে পারে চিরতরে।
আরেক দল মানুষ আছেন, যারা যেকোনো কথাকে নিজের দিকে টেনে নেন, তার কাছে মনে হতে থাকে, এই কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে, যদিও আদৌ তাকে নিয়ে কথাটা বলা হয়নি। যাচাই না করেই এমন আচরণ করার কারণে অনেক মানুষের মনে আপনার সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা জন্মাবে।
সত্যিকার অর্থে, কারোরই এতটা সময় নেই যে, আপনাকে নিয়ে পড়ে থাকবে। তাই আড্ডার আসরে উদ্দেশ্যমূলক কথা বলার সম্ভাবনা খুব কম থাকে, যেটি আপনার বোধগম্য না হওয়ায় সহজেই রেগে গিয়ে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছেন। কথাটি যে অন্য কাউকে বলা হয়নি, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
৩. নিজের সমস্যা বলে বেড়ানো
বর্তমান সময়টা এমন যে, সবাই খুব দ্রুত চিন্তা করে এবং সেভাবে কাজ করে। কিন্তু আপনি যদি ক্রমাগত উদ্বিগ্ন থাকেন এবং সেটা মানুষের কাছে বলে বেড়ান, নিশ্চিত থাকুন মানুষ সেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে না।
নিজের নিরাপত্তাহীনতা, সমস্যার কথা মানুষকে বলে আসলে লাভ নেই, কারণ তারা ইতোমধ্যেই হাজারটা সমস্যার সমাধান করতে ব্যস্ত। কালেভদ্রে দুয়েকজনকে হয়তো পেয়েও যেতে পারেন, যারা আপনার সমস্যার কথা শুনতে আগ্রহী। তবে নিশ্চিত থাকুন, এভাবে বেশিদিন কাউকে ধরে রাখতে পারবেন না।
বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে অনেক মানুষ নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা, মন খারাপের কথা সকলের সামনে প্রকাশ করতে চান। আদতে এটা তাদের সমস্যার কতটুকু সমাধান করে, তা ভাববার বিষয়।
বস্তুত নিজের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবেন আপনি নিজেই। মানুষ হয়তো আপনার কথা শুনবে, তারপর ভুলে যাবে। সকলের আলোচনা বা মনোযোগের মধ্যমণি হয়ে থাকার এই উপায় কোনো কাজেই আসে না। উল্টো মানুষ যদি প্রত্যাশিত পাত্তা না দেয়, আপনার হীনমন্যতা বাড়বে।
৪. নিজেকে ‘স্মার্ট’ হিসেবে তুলে ধরা
হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা মানুষদের আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, যেখানে সেখানে নিজেকে ‘স্মার্ট’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা। বিশেষ করে এমন সব মানুষের সামনে, যারা সত্যিকার অর্থেই তাদের কাজেকর্মে স্মার্ট।
তাদের সামনে পড়লে মানিয়ে নেওয়ার জন্য হয়তো আপনি স্মার্টনেস দেখাতে যাবেন, এবং ভাববেন তারা ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। বাস্তবে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ দেখাতে গেলে নিজের পরিস্থিতিটাই ঘোলাটে করে তুলবেন।
অনেকেই নিজেকে সবচেয়ে স্মার্ট হিসেবে তুলে ধরতে নতুন মানুষজনের সাথে মেশা বন্ধ করে দেন। কেবল পরিচিত পরিমণ্ডলের ভেতরই নিজেকে নিরাপদ হিসেবে দেখতে পান। তখন সহজেই পরিচিত মানুষগুলোর সামনে নিজেকে সেরা হিসেবে তুলে ধরা যায়। কিন্তু এ ধরনের মানুষগুলো ভুলেই যান, পরিচিত মানুষরা ইতোমধ্যে তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট জানেন!
৫. অপরকে অপেক্ষা করানো
আপনার বন্ধু কিংবা কলিগদের মাঝেই হয়তো এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে পেয়ে যাবেন, যে আপনাকে কথা দিয়ে ঘোরাবে, কিংবা কোথাও অপেক্ষা করতে বলে আপনার সময় অপচয় করবে।
এ ধরনের মানুষগুলো মনে করে, আপনাকে যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করানো যায়, তখন আপনি ভাববেন সে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করছে। তারপরও আপনার জন্য কিছুটা সময় বের করেছে!
আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর তাদের প্রথম কথা হবে ‘দুঃখিত’!’ তারপর সে আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, অন্য একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দেরি হয়ে গেছে।
তাছাড়া হীনমন্য ব্যক্তিরা যাদের সঙ্গে মেশে, তাদেরকে নানান ক্যাটাগরিতে ভাগ করতে ওস্তাদ তারা। সাধারণত তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট উপরের দিকেই থাকে। সেখানে আপনার-আমার সিরিয়াল কত, সেটা ভাববার বিষয়।
এতগুলো বদভ্যাস কাটিয়ে ওঠার একটাই পথ হতে পারে- প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা। সমাজের বেঁধে দেওয়া অদৃশ্য দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ না নিয়ে, বরং নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠার দিকে নজর দিতে হবে। তাহলেই একটা সময় গিয়ে নিজেকে সত্যিকারার্থেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাতারে নিয়ে গিয়ে স্মার্টনেস দেখাতে পারবেন সহজাত ভঙ্গিতে।