আমাদের জীবনে অনেক উত্থান-পতন রয়েছে। কখনো কখনো নিজেকে এত বেশি অবাঞ্ছিত মনে হয় যে বুঝে উঠতে পারি না এই মুহুর্তে আমাদের কী করা উচিৎ, আর কী করা উচিৎ না। কোনো সময় মনে হয়, “যাক, এবার তো সমস্যার সমাধান হলো!” আবার পরমুহূর্তে মনে হয়, “আরো বড় চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে গেছি!” সবার মানসিক শক্তি যেমন এক নয়, তেমনই সবার সমস্যা মোকাবেলা করার শক্তিও এক না।
অন্যভাবে বলতে গেলে, একেকজনের সমস্যাও একেকরকম। শুধুমাত্র আপনার বা আমাদের নয়, পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিন্তু এ ধরনের সমস্যা আসতে পারে, আসে, এবং আসবেই। পিছিয়ে গেলে বা হার মেনে নিলে সমস্যার সমাধান হবে না। সঠিক সমাধান প্রয়োজন সবার। আমাদের শিখতে হবে কীভাবে এই কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে হবে; নিজের স্নায়ু, শরীর, মস্তিষ্ক কীভাবে ঠান্ডা রেখে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একেকজনের জীবনদর্শন যেমন একেক রকম, সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিও তেমনই ভিন্ন ভিন্ন। আমরা কিছু পরামর্শ দিতে পারি, বাকিটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবার দায়িত্ব পাঠকের।
১) পরিকল্পনা মোতাবেক এগিয়ে যান
প্রতিদিনকে যদিও ছকে ফেলা সম্ভব না, তবুও কিছু বিষয় ছকে বেধে রাখা ভালো। আমরা কেউ কিন্তু জানি না আমাদের ভবিষ্যতে কী আছে। আপনার জীবনের ঘটনা এতদিন যেভাবে ঘটে এসেছে, সেভাবেই একটা ছকে বেধে কাজ শুরু করুন। দেখুন পেছনে কী কী সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, কীভাবে সেসবের সমাধান করেছেন। সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে ভাবুন সামনে কখন, কী করতে হবে, কেন করবেন।
ধরুন, পড়াশোনার ক্ষেত্রে, কাজের ক্ষেত্রে সময় মেনে চলতে পারেন না, তাই বেশ ঝামেলার শিকার হন আপনি। তাহলে ভাবুন, কীভাবে পড়াশোনা করলে বা কাজ করলে ভবিষ্যতে সময় স্বল্পতার ফাঁদে পড়বেন না। একবার যদি সময় কাজে লাগাতে আর পরিকল্পনা তৈরি করতে শিখে যান, আশা করি সামনে আর কখনও ঝামেলায় পড়বেন না।
২) আরো অনেকেই আছে আপনার মতো
পৃথিবীতে যত মানুষ রয়েছে, সবারই কিছু না কিছু দুর্বল সময় আসে। কিছু উইক পয়েন্ট আছে, আছে স্ট্রং পয়েন্ট। যখন একজন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে, সেসময় অনেকেই সেটা মোকাবেলা ভালোভাবে করতে পারলেও অনেকে আবার পারে না। অনেকে আবার নিজের দুর্বলতাগুলো একদম লুকিয়ে রাখতে পারে, কেউ কেউ পারে না। মজার ব্যাপার কী জানেন? আপনি যে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক একই অবস্থায় আরও অনেকেই পড়েছেন।
এই পরিস্থিতি অনেকেই মোকাবেলা করেছেন। নিজে চেষ্টা করে না পারলে যারা আপনার মতো এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন, তাদের খুঁজে বের করবার চেষ্টা করুন। তাদের সাথে শেয়ার করুন আপনার সমস্যা। তারা কীভাবে সেই অবস্থাকে থেকে ফেরত এসেছে জানুন। এরপর নিজের মতো করে ভাবুন, নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়ান।
৩) সাহায্য খুঁজুন, সাহায্য নিন, সাহায্য করুন
আমাদের অনেক বড় একটা সমস্যা হলো, আমরা সাহায্য চাইতে দ্বিধাবোধ করি। সাহায্য চাই না, ভয় পাই, কেউ আমাদের বিদ্রুপ করবে কিংবা উপহাস করবে অথবা ফিরিয়ে দেবে ভেবে দু’পা পিছিয়ে যাই। কিন্তু, এটা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। ভেঙে পড়লে, বিপদে পড়লে আমাদের উচিত কারো সাথে কথা শেয়ার করা, পরামর্শ নেয়া। যে কেউ হতে পারে, চেনা বা অচেনা। অবশ্যই কেউ না কেউ আছে, যে আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।
আবার, কেউ যদি স্বেচ্ছায় আপনার দুর্বলতম অবস্থায় সাহায্য করতে চায়, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আপনার চেনা গন্ডির মানুষেরা, যারা আপনার মঙ্গল চায়, তারা কিন্তু আপনার ভালোর জন্যই এগিয়ে আসবে। যারা এগিয়ে আসবে, তাদের সাথে কথা বলুন, শেয়ার করুন। তারা যদি পথ বাতলে দেয়, সেই পথে হাঁটুন। দেখবেন, জীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতা তুড়িতেই উড়িয়ে দিতে পারবেন।
ঠিক একইভাবে যারা অনেক দুর্বল, তাদের মানসিকভাবে সাহায্য করুন, তাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। তাদের সাহায্য করুন উঠে দাঁড়াতে। তাদের কথা শুনলে দেখবেন নিজেরও ভালো লাগবে, নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে পারবেন।
৪) নিজেকে অনুভব করুন
আমরা যে ভুলটা করি সেটা হলো- নিজের অনুভূতি চেপে রাখি। এভাবে কিন্তু আসলে আমরা নিজেদেরই ক্ষতি করি। এতে আমাদের শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হতে পারে। আমাদের শক্তি কমে যায়, দুর্বলতা ঘিরে ধরে। এতে আসলে উল্টো ফল হয়। ধরুন, আপনি কোনো একটা বিষয়ে আঘাত পেয়েছেন, মানসিকভাবে প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সেটা চেপে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। এটা অনেক বড় ভুল।
কারো সাথে শেয়ার করুন নিজের কষ্টের কথাগুলো, তারা সমাধান দিতে পারে। আপনি চেপে না রেখে আগে বুঝুন আপনার এই অবস্থা আসলে কী, কেন হলো। নিজেকে অনুভব করুন। এরপর ভেবে-চিন্তে পদক্ষেপ নিন। যেমন- ইয়োগার অভ্যাস করুন। লিখে রাখুন ডায়েরিতে, শেয়ার করুন কারো সাথে। দেখবেন অনেক হালকা লাগবে নিজের। মজার ব্যাপার হলো- এক বা দুবার যদি এটা করতে পারেন, দেখবেন পরের যেকোনো চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলতে পারবেন।
৫) সুস্থ চিন্তা করুন, হার মানবেন না
কোনো কাজে ব্যর্থ হলে আমরা অনেক সময়ই ঘুরে দাঁড়াতে ভাই চাই না বা ভয় পাই। বার বার আশঙ্কা জাগে- যদি আবার ব্যর্থ হতে হয়, যদি আবার হেরে যাই!
কথায় আছে, “একবার না পারিলে দেখ শতবার।” সুস্থ ঘরানার আর ইতিবাচক চিন্তা করুন। আমি এবার সফল হবো, আমি চেষ্টা করে যাব সফল হওয়ার আগপর্যন্ত। কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করলে কখনোই আমরা সফল হব না। পিছু না হটে হোঁচট খেয়ে হলেও সামনে এগোতে হবে। যখন আপনি পিছিয়ে যাবেন, তখন আপনি আসলে হার মেনে নিলেন। অসুস্থ চিন্তা করে নিজের সমস্ত ইতিবাচক শক্তিকে আপনি শেষ করে দিচ্ছেন।
এতে বর্তমান চ্যালেঞ্জ যেমন মোকাবেলা করতে পারবেন না, তেমনই ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি বা সাহস অবশিষ্ট থাকবে না। তাই বলি- হারুন বা জিতুন, কী হবে পরে ভাবুন, আগে সম্মুখীন হোন প্রতিবন্ধকতার।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যে ধাপগুলো আপনাকে সাহায্য করতে পারে
এতক্ষণ যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হলো সেগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল। এখন আমরা কথা বলব ধাপে ধাপে কীভাবে এই কৌশলগুলো কাজে লাগাতে পারেন সেই ব্যাপারে। চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপের কথা আজ বলা হবে। ঠিকঠাক মেনে চলতে পারলে অবশ্যই যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবেন।
১) জীবনে যাই ঘটুক, সেটা গ্রহণ করেই সামনে এগিয়ে যান। এটা আপনার জীবন, এখানে সবকিছু ক্ষণস্থায়ী। এটা মেনে এগিয়ে চলুন। দেখবেন আপনার দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ সব কমে যাবে। মেডিটেশন করতে পারেন, এতে নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। মেডিটেশন শেখায় কীভাবে নিজেকে সব পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে হয়।
২) আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করুন এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে গ্রহণ করুন। কী হবে সেটা না ভেবে “যা হবে দেখা যাবে” কথাটি মাথায় রেখে সামনে পা বাড়ান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আপনার অন্তরাত্মা কী বলে সেটা শুনুন।
৩) ভয়ের মুখোমুখি হোন। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে যেকোনো একটা পদক্ষেপ নেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভাবুন, এই পরিস্থিতিতে কোন বিষয় নিয়ে আপনি ভয় পাচ্ছেন, সেটা কীভাবে এড়ানো যায় সেটা একটু ভাবুন। সেভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করুন।
৪) আপনার যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকার চেষ্টা করুন। বিনয়ী হোন। অনেক ক্ষেত্রে নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে গেলে আমাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সেই জোনের বাইরে পা রাখার দরকার হতেও পারে। আমাদের এই পরিস্থিতিও দক্ষভাবে সামাল দেয়া শিখতে হবে।
আমরা কিন্তু একদিনেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে কিংবা উঠে দাঁড়াতে শিখতে পারব না। জীবনে উত্থান-পতন আসবে, যতই সব সুন্দরভাবে হোক না কেন। চলতে চলতে আমাদের শিখে যেতে হবে, শিখে নিতে হবে টিকে থাকা আর প্রতিকূলতা মোকাবেলা করা। পিছিয়ে গিয়ে নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে চলতে শিখলেই সফল হতে পারব আমরা।