সময়ের সাথে সাথে চাকরির বাজারটা যেন একটু বেশিই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর কারণ তুমুল প্রতিযোগিতা। সব কিছুর উন্নয়নের সাথে সাথে থেমে নেই এই খাতটিও। একটি ভালো চাকরি তাই এখন অনেকটা সোনার হরিণের মতো ব্যাপার বৈকি। আবেদন, লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ মিলিয়ে ঝক্কিও একেবারে কম নয়।
এ ধাপগুলোর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ইন্টারভিউ, যাকে বলে চূড়ান্ত নির্বাচন। এই ধাপটি পার হয়ে যেতে পারলেই চাকরি একরকম নিশ্চিত। কিন্তু অনেক সময় ছোটখাট কিছু ভুল আর অসাবধানতায় আমরা এই ধাপটিতে নিজেদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি না। ব্যর্থ হই প্রত্যাশিত চাকরিটি পেতে।
আসুন জেনে নেওয়া সেই ভুলগুলো, যা ইন্টারভিউ বোর্ডে আমরা হরহামেশাই করে থাকি এবং তা এড়ানোর উপায় সম্পর্কে।
১. অপেশাদার পোষাক
কথায় বলে, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী”। কথাটা ইন্টারভিউ বোর্ডের বেলায় একেবারে মিথ্যে নয়। আপনার পোষাকই প্রথম দেখায় নিয়োগকর্তার মনে আপনার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। আপনার পোষাক দেখেই নিয়োগকর্তা আপনার ব্যক্তিত্ব এবং রুচি সম্পর্কে আভাস পান। সুতরাং এই ব্যাপারটি মোটেই হেলাফেলার নয়। অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডে পোষাকের ব্যাপারটিকে খুব একটা গুরুত্ব সহকারে দেখেন না। অথচ এই ছোট্ট একটি অসাবধানতা ডেকে আনতে পারে মারাত্মক ক্ষতি।
ইন্টারভিউ বোর্ডের পোষাক হওয়া চাই মার্জিত এবং পরিপাটি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন যেন পেশাদার কোন পোষাক হয়। আর হ্যাঁ। সেটি যেন অবশ্যই পরিস্কার, ভালোমতন ইস্ত্রি করা আর খুব রংচঙে জবরজং না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
২. দেরিতে পৌঁছানো
ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক- প্রায়শই এই ভুলটি আমাদের হয়ে থাকে। কিন্তু এতে নিয়োগদাতার মনে প্রার্থী সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা যে তৈরি হয় না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আপনার উপস্থিতির সময়ই প্রমাণ করে দেয় আপনি বিষয়টি নিয়ে কতটা সিরিয়াস। আপনার নিয়োগকর্তা নিশ্চয়ই চাইবেন না আপনি দেরি করে অফিসে আসেন।
এই সমস্যাটি এড়াতে যা করতে পারেন তা হলো সচেতন হওয়া। ইন্টারভিউ বোর্ডে কমপক্ষে আধাঘণ্টা আগে উপস্থিত থাকুন। ক্ষতি তো নেই। আর যদি নেহায়েতই কোনো সমস্যা থাকে বা রাস্তায় কোনো ঝামেলায় পড়ে যান, তবে সেটা আগে থেকেই কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখুন এবং এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করুন। এতে আপনার পেশাদার মনোভাব ফুটে ওঠে।
৩. কোনো পানীয় সাথে নেওয়া বা চুইংগাম খাওয়া
অনেক সময় আমরা ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার সময় সাথে পানির বোতল নিয়ে ঢুকি। ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে একটু পরপর বোতল বের করে পানি পান করাটা একটু অশোভনই বটে। আপনার যদি নিতান্তই পানি পানের প্রয়োজন হয়, তবে সেটা বোর্ডে প্রবেশের আগে পান করে নিন। আর বোর্ডে আপনি যেহেতু আপনি অনন্তকালের জন্য প্রবেশ করছেন না তাই সেই সময়টুকু পানি পান না করারই চেষ্টা করুন। আর হ্যাঁ, ইন্টারভিউ বোর্ডে চকলেট কিংবা চুইংগাম চিবানোর মতো স্বভাবও কারো কারো আছে, যা কখনোই কাম্য নয়।
৪. রেজিউম বা জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে ধারণা না থাকা
আবেদনের সময় যে রেজিউম বা জীবনবৃত্তান্ত দিয়েছেন তার একটি কপি নিজের কাছে রাখা উচিত এবং ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রবেশের আগে সে সম্পর্কিত ধারণা থাকাটাও জরুরি। অনেক সময় সেখান থেকে প্রশ্ন করা হতে পারে। নিজের জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে যদি নিজেরই ধারণা না থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। আর এতে করে নিয়োগদাতার মনে প্রার্থী সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়।
তাই সচেতন হতে হবে জীবনবৃত্তান্ত নিয়েও। এক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার সবসময় মাথায় রাখবেন। রেজিউম কিংবা জীবনবৃত্তান্ত, কোথাও নিজেকে জাহির করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত কিছু লিখবেন না। ইন্টারভিউ বোর্ডে এসব কারচুপি ধরা পড়ে খুব সহজেই।
৫. প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকা
এর থেকে মারাত্মক ভুল আসলে আর হয় না। অথচ এই ভুলটি ইন্টারভিউ বোর্ডের সবচেয়ে মারাত্মক আর বহুল প্রচলিত ভুলগুলোর মধ্যে একটি। আপনি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন এবং আপনার দায়িত্ব কী হবে সেই সম্পর্কে ধারণা না থাকাটা এক হিসেবে অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। এতে করে নিয়োগকর্তা আপনার পেশাদারী মনোভাব সম্পর্কে খুব খারাপ একটি ধারণা পান। এক্ষেত্রে যা করা যেতে পারে তা হলো ইন্টারভিউ বোর্ডে যাওয়ার আগে প্রতিষ্ঠান এবং আবেদনকৃত পদটি সম্পর্কে ভালোমতো পড়াশোনা করে যাওয়া। এক্ষেত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিতে চোখ বুলানোও দারুণ সহায়ক হতে পারে।
৬. ফোন ব্যবহার করা
ইন্টারভিউ বোর্ডে ফোন রিসিভ করা বা সময় দেখা কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। সবচেয়ে ভালো হয় বোর্ডে প্রবেশের আগে ফোনটি কারো কাছে রেখে যেতে পারলে কিংবা সুইচ অফ করে রাখতে পারলে। আর একান্ত প্রয়োজন হলে ফোনটিকে ‘সাইলেন্ট’ অবস্থায় রাখতে পারেন। ‘জেনারেল’ তো নয়ই এবং ‘ভাইব্রেশন’ অবস্থায়ও নয়। কেননা ‘ভাইব্রেশন’ অবস্থার কাঁপাকাঁপি ইন্টারভিউ বোর্ডে অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
৭. বেশি কথা বলা
অনেক সময় নার্ভাসনেস, অধিক উত্তেজনাজনিত কারণ কিংবা নিজেকে জাহির করতে গিয়ে আমরা ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে ফেলি। এটি একেবারেই অনুচিত। কেননা বেশি কথা বললে অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে ফেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে সচেতনতা এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানাটা খুবই জরুরি।
৮. পূর্বের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা
ইন্টারভিউ বোর্ডে অনেকে পূর্বের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করে থাকেন। এতে করে আপনার মানসিকতার খারাপ দিকটিই নিয়োগকর্তার সামনে ফুটে ওঠে। তাই কখনোই ইন্টারভিউ বোর্ডে পূর্বের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খারাপ কোনো মন্তব্য বা গোপন কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।
৯. মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা এবং রেগে যাওয়া
অনেকে দীর্ঘ ইন্টারভিউয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। মনোযোগ একবার ছিটকে গেলো তো স্রোত থেকে সরে গেলেন। তাই এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। তাছাড়া নিয়োগকর্তা কখনো কখনো আপনার মানসিক অবস্থা যাচাইয়ের জন্য ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনাকে রাগানোর চেষ্টা করতে পারেন। এক্ষেত্রে মানসিকভাবে স্থির এবং শান্ত থাকতে পারাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
১০. বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি এবং মুদ্রাদোষ
আমাদের বাচনভঙ্গি এবং অঙ্গভঙ্গিতে প্রকাশ পায় আমাদের ব্যক্তিত্ব, আমাদের রুচি। কথা বলার স্বর, হাতের ওঠানামা- সবকিছুতেই যেন রুচিশীলতা ছাপ থাকে সেদিকে খেয়াল রাখা চাই। আবার অনেকের থাকে নাক খোঁচানো, পা নাড়ানো, বারবার থুতু ফেলার মতো মুদ্রাদোষ। ইন্টারভিউ বোর্ডে এ ধরনের আচরণ কখনোই কাম্য নয়। একটু সচেতনতা আর সতর্কতা থাকলেই এড়ানো যেতে পারে এ ধরনের ভুল।
১১. অহেতুক তর্ক করা
অনেকে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে অযথাই তর্ক করেন। অনেক সময় সেই তর্ক রূপ নেয় বাকবিতণ্ডায়। এর ফলাফল অবশ্যই ভয়াবহ। তাই কোনো কারণে মতের অমিল হলে তা নিয়ে অহেতুক তর্ক করতে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে বোকামি।
১২. প্রশ্ন করতে না জানা
ইন্টারভিউ বোর্ডে অনেক সময় নিয়োগকর্তা জানতে চান প্রার্থীর কোনো প্রশ্ন আছে কি না। অনেকেই এ সময় কোনো প্রশ্ন করেন না। এ সুযোগটা কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনার প্রশ্নের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠান এবং কাজ সম্পর্কে আপনার আগ্রহ তুলে ধরতে পারেন। তবে কী প্রশ্ন করবেন সেটা সম্পর্কে আগে থেকে পড়াশোনা করে যাওয়া ভালো। বেতন কত হবে, কেমন ছুটি হবে এ ধরনের প্রশ্ন না করাই ভালো।