যদি প্রশ্ন করা হয়, একজন ব্যক্তির ঠিক কোন বিষয়গুলো দেখে আমরা বলে দিতে পারি, অমুক খুব ভদ্র বা মার্জিত, কিংবা কোন আচরণগুলো দেখলে আমাদের মনে হয় যে অমুক খুব সুন্দর আদব-কায়দা জানে? উত্তর হবে, ব্যক্তির চালচলন কিংবা কথা বলার ভঙ্গি।
উত্তরটি সঠিক। কিন্তু চলাফেরা কিংবা বাচনভঙ্গি ছাড়াও নিজেকে কেতাদুরস্ত বা ওয়েল ম্যানার্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করবে যে বিষয়টি, তা হলো খাবার টেবিলের আদব-কায়দা। একটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে খাবার টেবিলের আদব কায়দা জানা এবং তা মেনে চলার কোনো জুড়ি নেই।
একেক দেশে একেক রকম খাওয়ার প্রচলন। কোথাও চামচ দিয়ে খাওয়াটাই ভদ্রতার পরিচয়, কোথাও হাত দিয়ে না খেলে অভদ্রতা, আবার কোথাও হয়তো কাঠির (চপস্টিক) উপরই নির্ভর করতে হবে আপনাকে। দেশ, জাতি, সংস্কৃতিভেদে খাওয়ার টেবিলের নিয়মগুলো আলাদাই হয়ে থাকে। তবে কিছু নিয়ম আছে, যা সবার জন্যই প্রযোজ্য। মনে রাখতে হবে, খাবার টেবিলের আদব-কায়দা আপনার ব্যক্তিত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। আপনি গেস্ট হয়ে থাকুন আর হোস্ট, সবার জন্যই এই আদব-কায়দাগুলো মাথায় রাখা দরকার। তাই চলুন, আজকের লেখায় জেনে নেয়া যাক তেমনই কিছু আদব-কায়দা।
হোস্ট বা আপ্যায়ককে অনুসরণ
খাবার টেবিলে একজন অতিথির উচিত আপ্যায়ককে অনুসরণ করা। তাই অতিথি হিসেবে গেলে নিজের ইচ্ছেমতো চেয়ার টেনে বসে না পড়ে অপেক্ষা করুন; আপ্যায়ক কোথায় বসতে বলছেন, সেই অনুযায়ী বসুন। আপ্যায়ক চেয়ারে না বসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর অবশ্যই বসার সময় কর্কশ শব্দে চেয়ার না সরিয়ে আস্তে করে টেনে নিয়ে পিঠ সোজা করে বসতে হবে। পারিবারিক খাবার টেবিলে অনেকেরই অভ্যাস আছে কনুই, পা উঠিয়ে বসে খাওয়ার। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো আয়োজনে কোনোভাবেই তা করা যাবে না। জেনে রাখা ভালো, প্রধান অতিথি বসে থাকেন হোস্টের ডানপাশে।
আরেকটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। আপনি যদি সেখানে নিজের মতো খেতে থাকেন, আস্তে কিংবা দ্রুত, তাহলে তা আপনাকে অন্যদের সামনে অভদ্র হিসেবেই তুলে ধরবে। তাই আপনাকে টেবিলের সবার সাথে গতি রক্ষা করে চলতে হবে খাওয়ার সময়।
খাবার টেবিলে একেক পদের জন্য আলাদা চামচ-প্লেট রাখা থাকে। তাই কোনটির কী ব্যবহার, তা জানতে হবে আগে। সবচেয়ে বাইরের দিকে থাকা চামচ বা প্লেট আগে ব্যবহার করে আস্তে আস্তে ভেতরেরগুলোর দিকে আসতে হবে। আর এসব জানা না থাকলে ঘাবড়ে না গিয়ে হোস্টকে অনুসরণ করতে হবে।
খাবার পরিবেশন
টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে হবে হোস্টের বামপাশ থেকে। বামপাশ থেকে খাবার নিয়ে নেয়া শেষ হলে ডানপাশে সরিয়ে রাখতে হবে। আর যদি হোস্ট না থাকেন, তবে একজন নিয়ে আরেকজনকে দিয়ে দেবেন। এভাবে সবগুলো পদ প্রত্যেকে নেবেন। সাধারণত তরল জাতীয় খাবারগুলো প্রধান পদের বামে এবং অন্য খাবারগুলো ডানে রাখতে হয়।
খেয়াল রাখতে হবে, খাবার টেবিলে যে খাবারের পদটি আপনি খেতে চাইছেন, তা হাতের নাগালের মধ্যে আছে কি না। যদি না থাকে, তবে সেক্ষেত্রে পাত্রটির কাছে থাকা মানুষটিকে অনুরোধ করুন, পাত্রটি এগিয়ে দেওয়ার জন্য। অন্যকে টপকে বা খাবার টেবিলে ভর দিয়ে পাত্রটি টেনে নিতে যাবেন না। তবে নাগালের মধ্যে থাকলে নিজেকেই টেনে নিতে হবে। খাওয়া বাকি, এমন পদগুলো বামে রেখে শেষ হয়ে যাওয়া পদগুলো ডানে রেখে দিতে হবে।
আমরা অনেক সময় কিছু মানুষ দেখি, যারা বিয়ে বা দাওয়াতে গেলে এমনভাবে খেতে শুরু করে, যেন কে কত বেশি খেতে পারে, এমন প্রতিযোগিতা চলছে। সেক্ষেত্রে, বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, আনুষ্ঠানিক খাবারের টেবিলে (বিয়ে বা কোনো দাওয়াতে গেলে) কতটুকু খাওয়া বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে সবার জন্য।
আগেই ইচ্ছেমতো নিজের প্লেটে সব তুলে না নিয়ে মাথায় রাখতে হবে যে, প্রথমে নিজের ভাগটুকু তুলে নিয়ে তারপরে সবার নেয়া হয়ে গেলে আবার নেয়া যেতে পারে।
চিবোনোর নিয়ম
খেতে বসে যদি দেখা যায়, পাশে বসা মানুষটি শব্দ করে খাচ্ছে, তখন খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন আর থাকে না। শুধু তা-ই নয়, চিবোনোর এ শব্দে অনেকে হয়তো খাওয়ার রুচিটাই হারিয়ে ফেলবেন। এজন্য খাবার টেবিলে শব্দ করে খাওয়া আদব-কায়দাহীনতারই পরিচয় দেয়। মুখ বন্ধ রেখে খেলেই এ শব্দ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। আপনি হয়তো খুব তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছেন, কিন্তু আপনার পাশে বসা মানুষটি হয়তো আপনার এই চিবোনোর শব্দেই খেতে পারছেন না। চিবোনোর সময় মুখ খোলা আর বন্ধ রাখার কারণেই এই শব্দ হয়।
আমরা অনেকেই মাছের কাঁটা বা মাংসের হাড় খেতে খুব ভালোবাসি। নিজ বাড়িতে খেলে সেটি অন্য ব্যাপার। কিন্তু দাওয়াতে বা রেস্তোরাঁয় এটি বেশ দৃষ্টিকটু একটি ব্যাপার। ছোট শিশুদের সামনেও এ অভ্যাস পরিহার করা উচিত। কারণ তারা একেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে এবং অনুকরণ করবে।
হাঁচি–কাশি
খাবার টেবিলে বসে খাবারের দিকে মুখ রেখেই হাঁচি বা কাশি দেয়ার অভ্যাস খাবার টেবিলে অত্যন্ত আপত্তিজনক একটি আচরণ। এজন্য হাঁচি বা কাশি পেলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই মুখে রুমাল বা হাত দিয়ে ঢেকে নেয়া উচিত।
ভরা মুখে কথা না বলা
খাবার টেবিল হলো আমাদের ছোটখাটো একটা আড্ডাখানা। দেখা যায়, পরিবারের সবাই সারাদিনের কাজকর্ম সেরে এসে রাতের খাবার টেবিলেই হয়তো মিলিত হচ্ছে। সারাটাদিন কেমন গেল, কী কী হলো- এসব গল্পের মাধ্যমেই রাতের খাবারটি সম্পন্ন হয়। আর সেজন্য এসময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন মুখে খাবার নিয়ে কথা না বলি। মুখের খাওয়াটুকু শেষ করেই উত্তর দিতে বা কথা বলতে হবে। তা নাহলে মুখের খাবার ছিটকে পড়ে খাবার টেবিলের মনোরম পরিবেশ নষ্ট করতে পারে।
ন্যাপকিনের ব্যবহার
খাবার টেবিলে ন্যাপকিন ব্যবহার করা ভালো। ন্যাপকিন কোলের ওপর বিছিয়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করতে হবে। মুখে খাবার লেগে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ন্যাপকিন বা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে ফেলতে হবে। একজনের মুখে লেগে থাকা খাবার, টেবিলে বসা অন্য মানুষের জন্য তা অরুচি বা অভক্তির জন্ম দিতে পারে। খাওয়ার মাঝে টেবিল ছেড়ে কোথাও গেলে ন্যাপকিনটি চেয়ারের ওপর রেখে যেতে হবে। খাওয়া শেষ হলে ন্যাপকিন টেবিলের নিজের স্থানের বামপাশে রেখে দিতে হবে।
দাঁত–মুখ/হাত–পায়ের অবস্থান
আমরা অনেক সময় চামচ দিয়ে খাবার তুলতে না পারলে আঙুল দিয়ে ঠেলে ওঠানোর চেষ্টা করি, যা নিজের ব্যক্তিত্বকেই দুর্বল করে দেয় অন্যদের সামনে। তাই এ বিষয়টি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। আবার কেউ কেউ দাঁতে খাবার আটকে গেলে তা টেবিলে বসে বের করার জন্য খোঁচাখুঁচি করা শুরু করে দেন। এটি খুবই বিব্রতকর। তাই আটকে থাকা খাবার বের করার সময় অবশ্যই মুখে হাত দিয়ে ঢেকে অপর হাত দিয়ে বের করা উচিত। ঢেঁকুর তোলা আমাদের একটি অতি পরিচিত অভ্যাস, কিন্তু খাবার টেবিলে অন্য সকলের সামনে এটি একেবারেই আপত্তিকর একটি আচরণ।
একেবারে বেশি খাবার মুখে পুরে না দিয়ে প্রতিবার অল্প অল্প পরিমাণে মুখে পুরে নিন, হাড্ডি বা কাঁটা ফেলার সময় সরাসরি মুখ থেকে না ফেলে যদি চামচ ব্যবহার করে খাওয়া হয়, তবে চামচের সাহায্যে, যদি হাতই ব্যবহার করা হয় তবে হাত দিয়েই খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে দিন।
অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ
প্লেট, বাটি নেওয়ার সময় শব্দ যেন না হয়- এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। এছাড়া, শব্দ করে চুমুক দেওয়া, হাত না ধুয়েই খেতে বসা, দাঁত খিলানো- এগুলোও অশোভন। অনেকেই আছেন, যারা খাওয়া শেষে প্লেটে হাত ধুয়ে ফেলেন এবং হাত ধোয়ার পর তা পরনের কাপড়ে মুছে ফেলেন। কিন্তু এই কাজটি কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না।
খাওয়া শেষে
খাওয়া শেষ হবার পর হাত নির্দিষ্ট জায়গায় ধুয়ে তোয়ালে বা টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে হবে। খাবার টেবিল থেকে ওঠার সময় পাশেরজনকে বলে টেবিল থেকে উঠুন। এতে আপনার ভদ্রতাই ফুটে উঠবে।
ছুরি–চামচের ব্যবহার
ছুরি-চামচ এবং প্লেটের অবস্থান নির্দেশ করে, কে কতটা ওয়েল ম্যানার্ড বা কেতাদুরস্ত। খাবার টেবিলে নিজেকে অনন্য করে উপস্থাপন করতে যে বিষয়টি জানা থাকা দরকার, তা হলো ছুরি-চামচের ব্যবহার।
- ছুরি-চামচ, প্লেটের মাঝে কোনাকুনি করে রাখার অর্থ হচ্ছে, আপনি খাওয়ার মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
- যোগ চিহ্নের মতো রাখলে বোঝায়, আপনার প্লেট খাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং সেই হিসেবে ওয়েটার খাবার সরবরাহ করবে।
- আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল করে বা পাশাপাশি আড়াআড়ি করে রাখলে তা বোঝাবে, খাওয়া খুবই পছন্দ হয়েছে।
- উল্লম্বভাবে সমান্তরাল করে বা পাশাপাশি লম্বালম্বি করে রাখলে বোঝায় খাওয়া শেষ। ওয়েটার আপনার প্লেটটি নিয়ে যেতে পারেন।
- ছুরি-চামচ একটির ভেতর অপরটি, মূলত কাঁটা চামচের ভেতর ছুরি গেঁথে কোণ তৈরি করে রাখার অর্থ আপনার খাওয়া শেষ, কিন্তু খাবার একেবারেই পছন্দ হয়নি।
এছাড়া ছুরি-চামচ কীভাবে ধরতে হয়, এ নিয়েও ভিন্ন নিয়ম আছে।
কন্টিনেন্টাল পদ্ধতিতে ডান হাতে থাকবে ছুরি আর বাম হাতে থাকবে কাঁটা চামচ। ডান হাতের ছুরি প্লেটের কাছে ধরে রাখতে হবে। আর বাম হাতের কাঁটা চামচ দিয়ে খাবার মুখে পুরে দিতে হবে। এ সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, কাঁটা চামচটি যেন প্লেটের দিকে ঘোরানোই থাকে। আমেরিকান পদ্ধতিতে অবশ্য বাম হাতের কাঁটা চামচ ডান হাতে নিয়ে খেতে হবে।
খাবার মাঝে বিরতি নিলে কন্টিনেন্টাল পদ্ধতিতে ছুরির ধারালো দিকটি প্লেটের দিকে মুখ করে রাখতে হবে। আর কাঁটা চামচ উল্টিয়ে আড়াআড়িভাবে ছুরির উপরে রাখতে হবে, যেন ছুরি ও কাঁটা চামচ ক্রস আকৃতির হয়ে থাকে। আমেরিকান পদ্ধতিতে চামচ আর ছুরির অবস্থান একটু আলাদা। এখানে চামচের কাঁটা অংশ (না উল্টিয়ে) উপরের দিকে মুখ করে আর ছুরির ধারালো প্রান্তটি নিজের দিকে মুখ করে রাখতে হবে। ছুরি আর চামচের অবস্থান হবে কোণাকৃতির।
খাওয়ার সময় বা খাবার টেবিলের উপরোক্ত বিষয়গুলো আপনার ব্যক্তিত্বকে করে তুলতে পারে রুচিসম্মত এবং মার্জিত। তাই আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো দাওয়াতে আদব-কায়দাগুলো মাথায় রেখে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।