“আরে দেখ দেখ, মেয়েটা একদম গোল আলুর মতো দেখতে!”
“ভাই, ভুঁড়িটা তো বেশ ভালোই গোলগাল দেখাচ্ছে। কোন দোকানের চাল খান আপনি?”
“কী হ্যাংলা তুমি! মা খাওয়ায় না ঠিকমতো? দেখে তো মনে হচ্ছে অপুষ্টিতে ভুগছ।”
হাসি-ঠাট্টার ছলে প্রতিদিন কতবার এই কথাগুলো আমরা বলি আর শুনি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যেন অতিরিক্ত বা কম ওজন নিয়ে মজা করলেই ওজনজনিত সমস্যা পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে যাবে। তা তো যাবেই না, বরং এমন সব কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে ঐ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকেন। তার মধ্যে তৈরী হয়ে একধরনের বিষণ্ণতা, যা ধীরে ধীরে মানসিক অসুস্থতায়ও পর্যবসিত হতে পারে। যে যেমন, তাকে তেমনভাবে মেনে নিতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের, এই দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।
একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, চলার পথে কতবার আপনাকে নিজের বাহ্যিক উপস্থাপনের ভঙ্গি পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে? শুধু চিকন বা মোটা হওয়া নিয়ে সমস্যা থাকলে তা-ও চলতো। কারো হয়তো সৌন্দর্যের তথাকথিত সংজ্ঞার চেয়ে চোখ দুটো একটু ছোট, নাকটা একটু বোঁচা, মুখে ব্রন বা কোনো কাটা দাগ আছে। ব্যস, তাহলেই আর রক্ষা নেই। কারো দৈহিক আকার, আয়তন বা গড়ন নিয়ে করা এমন সব প্রকাশ্য সমালোচনা বা মন্তব্যের নামই ‘বডি শেমিং’।
যারা বডি শেমিং করছেন, তারা যদি ভেবে থাকেন- আপনার এহেন মন্তব্য ব্যক্তির জীবন পাল্টে দেবে, আপনার ধারণা তবে একদমই ভুল। একনাগাড়ে মানুষের মুখ থেকে এমন কটুকথা শুনতে শুনতে নিজের উপরই বিতৃষ্ণা জন্মে মানুষের। কেউ কেউ এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে বেছে নেয় বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। আসলে আমাদের মস্তিষ্কে সৌন্দর্যের এমন কিছু বাঁধাধরা-ছক কষা সংজ্ঞা ঢুকে গেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কষ্টসাধ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে বডি শেমিং এমন মহামারী আকার ধারণ করায় এ অঞ্চলে দুর্দান্ত সাফল্যের সাথে টিকে আছে রঙ ফর্সা করার ক্রিম আর স্লিমিং টি তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো।
আসলে এই কুপ্রথার জনপ্রিয়তা থাকার পেছনে দায় কেবল সাধারণ জনগণের নয়। সবাই যে খুব বুঝে-শুনে বডি শেমিং করছে, ব্যাপারটা তা-ও নয়। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই বা টেলিভিশন অন করলেই ওজন কমানোর বা নিখুঁত ফর্সা হওয়ার এত এত পদ্ধতি চোখে পড়ে যে আমরা ধরেই নেই চিকন আর ফর্সা না হলে সে সুন্দর নয়। সিটকম বা সিরিয়ালগুলোতে স্থূলকায় দেহের অধিকারীদের যেভাবে ভাঁড় বানিয়ে দেয়া হয়, তাতে বাস্তব জীবনের মোটা গড়নের ব্যক্তিদের জীবনও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। “কপালে তো বউ জুটবে না”, “তোকে কে বিয়ে করবে, আজীবন বাপের হোটেলেই খেতে হবে”, “ভুঁড়ি তো দেখি তোর আগে আগে হাঁটছে!”- টিপ্পনীর কোনো কমতি নেই যেন! এতে করে তাদের আত্মসম্মানবোধে তৈরি হচ্ছে গভীর ক্ষতের।
মানুষ হিসেবে আপনি কতটা অহেতুক সমালোচক তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বডি শেমিং। সবারই যে সৌন্দর্যের তথাকথিত ছাঁচে একই রকম করে সুন্দর হতে হবে, তার তো কোনো মানে নেই। প্রতিটি মানুষই নিজের মতো করে সুন্দর। কিন্তু সেই বিষয়টিকে মেনে নেয়ার প্রবণতা আমাদের নেই। আমাদের এই ছোট্ট একটি সমালোচনা কারো মনস্তাত্ত্বিক জগতে কতটা তোলপাড় ঘটাতে পারে তার কিছু নমুনা দেখানো যাক। গালে টোল পড়া মেয়েরা অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়- এই ধারণা থেকে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে গিয়ে গালে স্থায়ী গর্তের সৃষ্টি করে ফেলেছে এমন মেয়ের সংখ্যা কম নয়। এছাড়া নাক খাড়া, ঠোঁটের গড়ন পাল্টানো বা স্তন উন্নত করার উদ্দেশ্যে নিজেকে ছুরি-কাঁচির নিচে সঁপে দিয়ে পস্তাচ্ছে অনেকে।
শুধু যে বড় বা প্রাপ্তবয়স্করাই বডি শেমিং করছে, তা কিন্তু নয়। এমনকি স্কুল পড়ুয়া শিশুরাও বড়দের দেখাদেখি না বুঝেই করছে বডি শেমিং। বিশেষ করে উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজ লেভেলে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। গায়ের রঙ কালো বলে সহপাঠীকে এড়িয়ে চলা বা আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করে তাকে ছোট করে রাখার সুদীর্ঘ এক প্রচলন আমাদের সমাজে রয়েছে। অনেকের মুখে, হাতে, পায়ে বা শরীরের অন্য কোথাও জন্মদাগ থাকে। এগুলো নিয়েও বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে সমালোচনা করে। ফেসবুকের যুগে সারাদিন লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে নিখুঁত সুন্দর হওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে কোমলমতি শিশুরা আর কী-ই বা শিখবে?
বডি শেমিং মূলত কোন কোন উপায়ে হচ্ছে দেখে নেয়া যাক এক ঝলকে।
- নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে হা-হুতাশ করা, অন্য কারো সাথে তুলনা করে নিজেকে ছোট করা। যেমন- কোনো টিভি সিরিজের নায়িকাকে দেখে বলে ফেলা, ‘ওর চেয়ে আমি কত বেঁটে’, ‘ইশ, আমার চুল যদি ওর মতো সুন্দর হতো’ ইত্যাদি।
- কারো সামনে তার শারীরিক গঠন নিয়ে সমালোচনা করা; যেমন- ‘এই ওজন নিয়ে রিকশায় উঠবে কীভাবে?’ বা ‘তোমার হাঁটার স্টাইলটা হিজড়াদের মতো’। এখানে বলা রাখা প্রয়োজন, বডি শেমিংয়ের নাম করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অনেক বেশি হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
- কারো পেছনে তার শারীরিক আকার-আকৃতি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা। যেমন- ‘মেয়েটা কী পরে বের হয়েছে দেখলে? সুমো কুস্তিগীরদের মতো লাগছে দেখতে’ কিংবা মজার ছলেও অনেক সময় বলা হয় ‘তুমি দেখতে অন্তত অমুকের মতো নও, সেজন্য শুকরিয়া আদায় করো!’
কী বলে বডি শেমিং করছেন তার চেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো আপনি একজন মানুষের মানসিকতাকে গুরুত্ব না দিয়ে তার শরীর নিয়ে পড়ে আছেন। শরীর খুব ক্ষণস্থায়ী একটি অস্তিত্ব। মরে গেলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে পচে-গলে মাটির সাথে মিশে যায় শরীর আর অনন্তকাল থেকে যায় কর্ম। একটি সুন্দর মন পাল্টে দিতে পারে একটি সমাজ, একটি সুন্দর শরীরের কথা মানুষ বেশিদিন মনেও রাখে না। তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, তারপরও মানুষ কেন এত বেশি বডি শেমিং করে?
এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুব সহজ। আপনি যখন যোগ্যতায় কারো কাছে হেরে যাবেন, কারো উপর ভীষণ রাগ হবে বা বিরক্ত লাগবে, তাকে ছোট করার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে তার শরীরকে বেছে নেয়া হবে একদম নির্ঝঞ্ঝাট এক উপায়। এতে মনের ক্ষোভও মিটলো, প্রতিপক্ষকে ছোটও করা হলো। ধরা যাক, চাকরির পরীক্ষায় এক মেয়ের কাছে পরাজিত হয়ে আপনি চাকরি পেলেন না, পেয়ে গেল মেয়েটি। মানতেই হবে সে ঐ কাজটির জন্য যোগ্য ছিল। কিন্তু কগনিটিভ ডিজোনেন্স বা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আপনি হয়তো মনে মনে ভাববেন, ‘চাকরি পেলে পাক, ওর যে চেহারা, কে বিয়ে করবে ওকে?’ এভাবেই জন্ম নেয় একেকটি বডি শেমিংয়ের গল্প।
আমাদের দেশে আজকাল ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতেও বডি শেমিংয়ের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব রাখছে। অনেকের মধ্যেই একটি মনোভাব কাজ করে- আমার পার্টনারের যদি জিরো ফিগার থাকতো বা জিম করা পেশীবহুল ফিগার থাকতো, তাহলে কী ভালোই না হতো! আসলে ফিগারের এই ব্যাপারটিকে এত বেশি হাইলাইট করা হয় যে ফিগার আর চেহারা সুন্দর করতে আদাজল খেয়ে লাগছেন অনেকেই। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই আমেরিকাতে প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষ প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন চেহারা সুন্দর করতে এবং স্তনের আকৃতি বৃদ্ধি করতে। ১৮ বছরের কম বয়সী অনেকেও স্বেচ্ছায় নিজেদের এই কাটাছেঁড়ার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনামে অনেক মা মেয়ের জন্মদিনে উপহার হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারি করাচ্ছেন! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ভালোবাসার মানুষের উপর দোষ চাপিয়েই বা কী লাভ?
কারো ঘাড়ে দোষ না দিয়ে আমরা বরং জঘন্য এই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করি। নিজের কোন বিষয়গুলো আপনার ভালো লাগে বা আপনার জীবনে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে সেগুলোর যত্ন নিন, সেটা শরীরই হোক বা অন্য কোনো গুণই হোক। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন, আমার কেন মডেলদের মতো ‘পারফেক্ট’ হতে হবে? বিউটি স্যালনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর চেয়ে সে সময়টুকু সমাজ বা ব্যক্তিগত কোনো গঠনমূলক কাজে কেন ব্যবহার করছেন না? সৌন্দর্যের কোনো স্ট্যান্ডার্ড থাকতে পারে না, সৌন্দর্যের কোনো সংজ্ঞা থাকতে পারে না। পার্লারের দেয়ালে দেয়ালে যে ছবি টাঙানো থাকে, কেউ সেরকম সুন্দর না হলে তার ‘খুঁত’ ধরতে হবে এমন চিন্তাও ছোট মনের পরিচায়ক।
সমাজ যেমন চাইবে সেই শর্ত মেনে সুন্দর হতে হবে- তার কোনো মানে নেই। খুব সহজেই বলে ফেলা যায়, তুমি তো সুন্দর না। কিন্তু খুব সহজে কি একজন সুন্দর মনের মানুষ হওয়া যায়? একজন তথাকথিত কালো, মোটা বা ‘অসুন্দর’ মানুষ সমাজের কোনো ক্ষতি করে না, তার কারণে কেউ হয়রানির শিকার হয়। কিন্তু কারো মনে যদি বাস করে অসুন্দর চিন্তা, সেক্ষেত্রে ঘটে যেতে পারে ঘোরতর অনিষ্ট। তাই কারো ভালো করার উদ্দেশ্যে বডি শেমিং না করে যারা সমাজের জন্য আক্ষরিক অর্থেই ক্ষতিকর তাদেরকে কাউন্সেলিং করে সুপথে আনাই শ্রেয়।