ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক স্থানে একটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলো। কেউ বলবেন সেটি দেখতে সুন্দর হয় নি, তো কারো কাছে সেটি হবে ব্যাপক শিল্পগুণ সমৃদ্ধ! ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হাতটি কোনো একটি বিশেষ নামে পরিচিত হবে এবং কয়েক প্রজন্ম পর যখন নতুন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, তখন তাদের নিকট ভাস্কর্যটি হয়ে উঠবে কোনো এক মহামূল্যবান শিল্প। কিন্তু শিল্প কি শুধুই সময়ের আবর্তে খ্যাতি লাভ করে? কিংবা কোনো শিল্প কেন কারো কাছে শিল্প হয়ে ওঠে, আবার কারো কাছে মূল্যহীন রয়ে যায়? তাহলে কি শিল্পের উপলব্ধি সকলের নেই? নান্দনিকতার উপলব্ধি কি সকলে করতে পারে না?
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় ‘অ্যাস্থেটিক’ শব্দটির বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। খুব সাধারণ অর্থে, যাদের সৌন্দর্যবোধ আছে, তারা নিজেদের অ্যাস্থেটিক বা নান্দনিক দাবি করেন। বিপরীতক্রমে কেউ কেউ আবার শিল্পের ধার না ধেরে নিজেদের ‘অ-নান্দনিক’ দাবি করে সন্তুষ্ট থাকেন। কিন্তু নান্দনিকতা নিয়ে দর্শনের একটি আস্ত শাখাই রয়েছে, যেটি কিনা শিল্পের রসাস্বাদনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। নান্দনিক দাবি করা ব্যক্তিদের দাবি কতটা সত্য, কিংবা অ-নান্দনিক ব্যক্তিরা আসলে কতটা অ-নান্দনিক, এই প্রশ্নগুলো নান্দনিকতার দর্শনের ফিল্টারে ফেললেই উত্তর মিলবে।
প্রথমেই অ-নান্দনিকতা নিয়ে ভাবা যাক। পৃথিবীর সবচেয়ে আবেগহীন মানুষটিও কিন্তু গান শোনেন, রসকষহীন ব্যক্তিটিও তার শয়নকক্ষ পরিপাটি রাখার চেষ্টা করেন, চিত্রকর্মে নিরাসক্ত লোকটিও সন্ধ্যাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা দেখতে ভালোবাসেন, পেটুক এবং ভোজনরসিক নন, এরূপ মানুষটিও সুস্বাদু খাবারের স্বাদ চোখ বন্ধ করে আস্বাদন করতে পারেন, বিয়োগান্ত নাটকের শেষ দৃশ্যে সর্বদা নিরাবেগ, নির্মোহভাবে আচরণ করা লোকটির চোখের কোনেও এক ফোঁটা অশ্রু টলমল করে। এসবই শিল্পের ছোঁয়া, নান্দনিকতার একেকটি রূপ। নান্দনিকতার কোনো ধরাবাঁধা সংজ্ঞা নেই। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যা কিছু সুন্দর বলে উপলব্ধি করা যায়, তা-ই তো নান্দনিক। তাই কোনো মানুষ আদতে অ-নান্দনিক হয় কী করে? শিল্পের সাথে সংযোগ নেই, এরূপ মানুষ কি আদৌ আছে?
নান্দনিকতার আলোচনা করতে গেলে, “শিল্প কী?” এ প্রশ্নটি অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। শিল্প কী, সে আলোচনা ব্যাপক এবং বিস্তৃত। আপাতত বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয়ের সংজ্ঞাটি নিয়েই আগানো যাক। “শিল্প হচ্ছে তা-ই, যা মানুষ সহজে প্রকাশ করতে পারে না।” যেমন, কেউ যদি তার প্রেমিকার প্রতি আবেগ সহজ ভাষায় প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়ে কবিতা রচনা করে, তাহলে সেটি শিল্পের রূপ নেয়। তলস্তয়ের মতে, শিল্পী সাধারণের সাথে তার মনের ভাব ভাগাভাগি করে নিতেই শিল্পের শরণাপন্ন হন। তবে শিল্প সর্বদাই যোগাযোগের মাধ্যম না-ও হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহতা সকলেই প্রত্যক্ষ করেছে এবং নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে। তবুও, কেউ সে ঘটনা নিয়ে গান লিখেছে কিংবা ছবি এঁকেছে। এক্ষেত্রে শিল্প হচ্ছে আবেগকে তীব্রতর করার পন্থা, নিজের ভাষা এবং প্রতিক্রিয়াকে প্রচণ্ড রূপ দেয়ার হাতিয়ার।
তলস্তয় পরবর্তী সময়ে এক দল দার্শনিক শিল্পের ক্ষেত্রে শিল্পীর পূর্বনির্ধারিত ভাবনার সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেন। তাদের মতে, শিল্প অনেকটাই দৈব। অনেকসময় অনেক শ্রম দিয়ে, অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, অনেক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সিনেমা নির্মাণের পরও সেটি দর্শক সমালোচকদের সন্তুষ্ট করতে পারে না, শিল্পী যা চান, তা দর্শককে ঠিকভাবে বোঝাতে পারেন না। কিন্তু, একটি বিড়াল বিভিন্ন রঙের উপর দিয়ে হাঁটার পর একটি সাদা ক্যানভাসে হেঁটে গেলে যে এলোমেলো ছবির সৃষ্টি হবে, তা থেকে মানুষ খুঁজে পেতে পারে শিল্পের ছোঁয়া! ব্যাপারটা কি তাহলে দৈব নয়? এক্ষেত্রে দার্শনিকরা শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করেছেন নান্দনিকতার সাহায্য নিয়ে। যে শিল্প মানুষের নান্দনিক উপলব্ধি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তা-ই উৎকৃষ্ট শিল্প।
যেখানে শিল্পের সংজ্ঞাই এতো জটিল, সেখানে শিল্পের নান্দনিকতার ধারণা কতটা বিস্তৃত হতে পারে, ভেবেছেন? তাহলে কিছু রুচিসম্পন্ন কাজ করলেই নিজেকে নান্দনিক দাবি করা কিংবা অন্য কাউকে অ-নান্দনিক অভিহিত করা অবশ্যই বাস্তবসম্মত নয়। কেন নয়, তার উত্তর দিয়েছেন ব্রিটিশ দার্শনিক লুডভিগ উইটগেনস্টাইন। তার মতে, যতদিন আমরা শিল্প নিয়ে অজ্ঞ থাকি, ততদিন আমাদের নিকট শিল্পের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকে। কিন্তু যখন আমরা শিল্প নিয়ে ভাবতে শুরু করি, তখন প্রতিনিয়ত শিল্পের পরিসর বড় হতে থাকে এবং তা সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। উইটগেনস্টাইন শিল্পের সংজ্ঞার ধারণাই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে শিল্প কতটা নান্দনিক এবং সেটার রসাস্বাদনের মাপকাঠি কী, তা আমাদের জানা নেই। আর যে বিষয়ে আমরা অজ্ঞ, সে বিষয়ে অহরহ সিদ্ধান্ত দেয়াটাও অযৌক্তিক। একটি কাল্পনিক দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক।
ধরুন আপনি কোনো আর্ট গ্যালারিতে গিয়েছেন কিছু নান্দনিক চিত্রকর্মের নান্দনিকতা উপলব্ধি করবার জন্য। হঠাৎ আপনার চোখে পড়লো চারটি একই রকম ফ্রেমে বাঁধানো, একই রঙে আঁকা, একই রকম দেখতে ছবির দিকে। তবে ছবিগুলো দেখতে একরম হলেও সেগুলোর পটভূমি ভিন্ন। প্রথম ছবিটি এঁকেছেন সর্বদা ঘরে বসে বই পড়া এক নিভৃতচারী ব্যক্তি, তার ঘরের একটি রঙিন সোফার কথা মাথায় রেখে। দ্বিতীয় ছবিটি এঁকেছেন একজন বিশ্বখ্যাত শিল্পী। লোহিত সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে নিজের ক্যানভাসে লোহিত সাগরের আবহ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তৃতীয় ছবিটি এঁকেছেন বাংলাদেশের একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ, যিনি নিজের ছবিতে লাল রং দ্বারা বিপ্লব ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। আর শেষ ছবিটি একজন উদীয়মান চিত্রশিল্পীর অসম্পূর্ণ চিত্রকর্ম। ছবিটি এঁকে শেষ করবার পূর্বেই তিনি মারা গেছেন।
এমতাবস্থায়, ছবিগুলোর পেছনের পটভূমি না জানিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় কোনটি সেরা, আপনি হয়তো উত্তর দিতে ব্যর্থ হতেন। কিন্তু পটভূমি জানবার পর প্রতিটি ছবিতেই শিল্পীদের পূর্বনির্ধারিত ভাবনাগুলো (সোফা, লোহিত সাগর, বিপ্লব আর অজানা কোনোকিছু) খুঁজে পেতে শুরু করবেন এবং কোনো একটিকে সহজে বেছে নিতে পারবেন। এ থেকে সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, নান্দনিকতা উপলব্ধিতে পূর্বজ্ঞানও সহায়তা করে। এখানে বিখ্যাত হলিউড সিনেমা ‘সিটিজেন কেইন’ এর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন সাধারণ দর্শকের চোখে ছবিটি সাধারণই মনে হবে। কিন্তু যখন তাকে ছবিটির টেকনিক্যাল দিকগুলো জানানো হবে, তখন সে সিটিজেন কেইনের শিল্পগুণ উপলব্ধি করতে পারবে। যা হোক, কাল্পনিক দৃশ্যকল্প এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কারণ পটভূমি না জানলে কীভাবে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করবো, তা আমাদের এখনো অজানা।
“নান্দনিকতা হচ্ছে দর্শকের চোখ!”– আর্থার ডান্টো
এই সমস্যার সহজতম সমাধান দিয়েছেন মার্কিন দার্শনিক ডান্টো। তার মতে, শিল্পের নান্দনিকতা এর পটভূমি, শিল্পী কিংবা পূর্বজ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। বরং দর্শকের চোখই শিল্পগুণ বিচারের প্রধান নিয়ামক। ডান্টোর মতে, চারটি ছবির দিকে ভালো করে মনোযোগ স্থাপন করলে সেগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্য চোখে পড়বেই। সেসব পার্থক্যের জন্যই দর্শক যেকোনো একটিকে বেছে নেবেন। আর এ বেছে নেয়ার কাজটি করবে দর্শকের চোখই। তাহলে, শিল্পের নান্দনিকতা শিল্পের মাঝে নয়, দর্শকের চোখে বিরাজমান? এমনটা হলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই নান্দনিক এবং রুচিশীল। কারণ, সে তা-ই করে, যা তার চোখে সুন্দর মনে হয়। তাহলে আর ঘটা করে নান্দনিকতার আলোচনার প্রয়োজন আছে?
“যখন আমরা শিল্পগুণ বিচার করি, তখন আমরা একে পছন্দ করি কিনা তা না ভেবে সেটি গুণগতভাবে কতটুকু ভালো তা চিন্তা করা উচিৎ।”- ডেভিড হিউম
বলা বাহুল্য ডান্টোর দাবি সমালোচকদের সমালোচনার ভিড়ে স্থান করে নিতে পারেনি। বস্তুত শিল্পের মাঝে যদি প্রকৃতপক্ষেই নান্দনিকতা বলতে কিছু না থাকতো, তাহলে হয় পৃথিবীর সকল শিল্পকর্মই ইতিহাসে স্থান পেত, কিংবা সবগুলোই সাধারণ হিসেবে হারিয়ে যেত। তাই নান্দনিকতার সমাধান পেতে আমাদের কড়া নাড়তে হবে স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউমের দরজায়। তার মতে, নান্দনিকতা উপলব্ধি করার ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের মাঝেই রয়েছে। প্রয়োজন কেবল সততার। “কোনটি ভালো লাগছে”, এই চিন্তা করে শিল্পগুণ যাচাই করতে গেলে তা বস্তুনিষ্ঠ হয় না। বরং নিরপেক্ষভাবেই বিচার করতে হবে কোনটির শিল্পগুণ অধিক, কোন ছবিটি অধিক পরিমাণ কথা বলতে সক্ষম।
তথাপি সকলেই শিল্পগুণ নির্ণয় করতে পারেন না। হিউমের জন্য তা কোনো সমস্যা নয়। মানুষ প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতেও শিল্পের রসাস্বাদন করা শিখতে পারে, নান্দনিকতা উপলব্ধি করতে পারে। প্রথম ক্রিকেট খেলা দেখতে শুরু করা দর্শকের নিকট কেবল বাউন্ডারিই আনন্দদায়ক হয়। কিন্তু কয়েকবছর ক্রিকেট খেলা নিয়মিত দেখার পর ঐ একই ব্যক্তি ক্রিকেটের অনেকে সূক্ষ্ম বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবেন, ক্রিকেটের প্রকৃত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবেন। আলোচনার এ পর্যায়ে এসে নতুন কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। শিল্প কেন নান্দনিক হতে হবে? শিল্পের নান্দনিকতা আমাদের জীবনে আসলে কী ভূমিকা পালন করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক চলুন।
একবার ডেনমার্কের এক জাদুঘরে একজন শিল্পী শিল্পের নৈতিক দিক পরীক্ষা করার এক অদ্ভুত প্রয়াস চালান। তিনি একটি টেবিলের উপর কিছু ব্লেন্ডার রাখেন। প্রতিটি ব্লেন্ডারের ভেতরেই একটি করে জীবন্ত গোল্ডফিশ ছিল। তিনি দর্শকদের আহ্বান করেন এই বলে যে, কারো শিল্পরুচি উন্নত হলে সে যেন এসে ব্লেন্ডারের সুইচ অন করে দেয় এবং নতুন কিছু দেখার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করে। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল তিনটি বিষয় পরীক্ষা করা। যদি কেউ সুইচ টিপে দেয়, তাহলে সে হবে একজন ‘স্যাডিস্ট’ বা ধর্ষকামী, যে অন্যকে কষ্ট দিয়ে সুখ লাভ করে। যদি কেউ সুইচ অন না-ও করে, কিন্তু অন্যের অন করা দেখে কষ্ট পায় (এজন্য যে মাছগুলো নিষ্ঠুরভাবে মারা যাবে), তাহলে সে ‘মোরালিস্ট’ বা নীতিবাদী। আর যে সুইচ অন করবে না কিন্তু অন্যের করা দেখে আনন্দ লাভ করবে, তিনি ‘ভয়ার’ বা ঈক্ষণকামী, যিনি অন্যের দুঃখ দেখে সুখ লাভ করেন।
এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিল্পের নৈতিক দিক বিবেচনা করা। শিল্প কি নৈতিকতার উর্ধ্বে নাকি নৈতিকতার ছকে আবদ্ধ, তা বিবেচনা করাই ছিল এর পেছনের কারণ। আমাদের প্রায়শই চোখে পড়ে যে, শিল্পের নামে বিকৃত যৌনতা, নির্মমতা এবং নানাবিধ অসংবেদনশীল বিষয় চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই কাজটি সঠিক কিনা, তা নিয়ে হাজার বছর আগেই প্রশ্ন তুলে গেছেন দার্শনিক প্লেটো। তার মতে, শিল্পের নান্দনিকতা মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা করে। তাই শিল্পকে অবশ্যই নৈতিকতা রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় অনৈতিক বিষয়বস্তুই মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। আর এরূপ ঘটলে সমাজের সার্বিক অবস্থার স্খলন ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
“শিল্পের একটি রূপ হচ্ছে বাস্তবতা হতে পালানোর পথ!”- আর. জি. কলিংউড
একটু আগে যে বিভিন্ন অপসংস্কৃতিকে শিল্প নামে চালিয়ে দেয়ার কথা বলা হলো, সে প্রসঙ্গে সবচেয়ে ভালো সমাধান দিয়েছেন ব্রিটিশ দার্শনিক কলিংউড। তার মতে, শিল্প দুই প্রকার। একটি হচ্ছে ‘অ্যামিউজমেন্ট আর্ট’ বা চিত্তবিনোদনমূলক শিল্প এবং অপরটি হলো ‘ম্যাজিক আর্ট’ বা উৎকৃষ্ট শিল্প। উল্লেখ্য, ‘ম্যাজিক’ শব্দটি দ্বারা তিনি জাদু নয়, উৎকৃষ্টতা বুঝিয়েছেন। চিত্তবিনোদনমূলক শিল্প হচ্ছে সেই শিল্প যা দুঃখ দুর্যোগের এই পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য মানুষকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় কোনো এক মায়াবী জগতে। অন্যদিকে ম্যাজিক আর্টের জাদু মানুষকে বাস্তবতা আরো ভালোকরে বুঝতে সহায়তা করে। যেমন ধরুন, হলিউডের দুর্দান্ত অ্যাকশন সিনেমা ‘টার্মিনেটর’ কলিংউডের জন্য চিত্তবিনোদনমূলক সিনেমা, যা কিছু সময়ের জন্য আপনাকে অন্য জগতে নিয়ে যাবে এবং আপনার মন ভালো করে দেবে। অন্যদিকে ‘ট্রুম্যান শো’র মতো সিনেমা হচ্ছে উৎকৃষ্ট শিল্প যা বাস্তবতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো আপনার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। কলিংউডের মতে, শিল্পের নান্দনিকতা অবশ্যই উৎকৃষ্ট শিল্পের মধ্যেই রয়েছে। বিনোদনমূলক শিল্প তার জন্য শিল্পই, এর মাঝে নান্দনিকতা খুঁজে পান না তিনি।
যারা বিশ্বাস করেন যে শিল্পের নান্দনিকতা দৈব, শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবে নান্দনিকতার আবেশ দিতে পারেন না, তারা কলিংউড তত্ত্বের পাল্টা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন। ‘হ্যারি পটার’ সিনেমাটির কথাই ধরা যাক। কলিংউড হয়তো বলবেন বাস্তবতাবিবর্জিত হগওয়ার্ট নিছক কিছু সময় আমাদের হতাশা আর ক্লান্তি ভুলিয়ে রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু সমালোচকরা দাবি করলেন যে তারা হ্যারি পটার সিনেমায়ও অনেক কিছু শেখার মতো পেয়েছেন, যেমন- বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্ব, উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি। তাহলে সমাধান কী? কলিংউড যাকে চিত্তবিনোদনমূলক শিল্প বলছেন, তার মধ্যেও কি দৈবভাবে নান্দনিকতা উপস্থিত?
২০১১ সালে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ডেভিড স্ল্যাটার ইন্দোনেশিয়ার এক জঙ্গলে গিয়েছিলেন বানরের ছবি তুলতে। হঠাৎ নারুটো নামক একটি বানর গাছ থেকে নেমে স্ল্যাটারের ক্যামেরা হাতে নিয়ে নেয় এবং দৈবক্রমে কিছু ছবি উঠে যায়, যেগুলো পরে বেশ নান্দনিক হিসেবে প্রশংসা কুড়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নান্দনিকতার পেছনে শিল্পীর অবদান আছে নাকি পুরোটাই দৈব ঘটনা মাত্র? একদল মানুষ তো আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল এজন্য যে, এই ছবিগুলোর আয় পুরোটাই বানরের কাছে যাওয়া উচিৎ! কিন্তু স্ল্যাটার যুক্তি দেখালেন যে, তিনি সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে গিয়ে ক্যামেরা মাটিতে না রাখলে বানর সেটি হাতে নেয়ার সুযোগ পেত কী করে? তার এ যুক্তি এড়ানোর যেহেতু কোনো উপায় আপাতত নেই, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, শিল্পের নান্দনিকতায় ঘটনার আকস্মিকতা আর শিল্পীর ভাবনা, দুটো সমানভাবেই কাজ করে।
সবশেষ বাকি রইলো শিল্পের নান্দনিকতার প্রয়োজনীয়তা। এই প্রয়োজনীয়তা ২০০০ বছর আগে থেকেই মানুষ জানে মহামতি অ্যারিস্টটলের কল্যাণে। তিনি শিল্পের নান্দনিকতার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ‘ক্যাথারসিস’ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। যখন কেউ দীর্ঘ সময় যাবত আবেগ সংক্রান্ত বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকে, তখন তার মনে সেসব আবেগীয় মুহূর্তগুলোর জন্য প্রবল আগ্রহ জাগে। এই আগ্রহকে কোনোভাবে সন্তুষ্ট করা না গেলে সে অনৈতিক উপায়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে চায়। আর এভাবে সমাজে নৈতিক স্খলন ঘটে। কিন্তু, বাস্তব জীবনে মানবীয় আবেগগুলো খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়া মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে শিল্পের নান্দনিকতা। শিল্পের রসাস্বাদনের মাধ্যমে মানুষের মনের সুখ দুঃখের অনুভূতিগুলো সজীব থাকে, সতেজ থাকে। এতে করে বিপথে যাবার সম্ভাবনা কমে যায়। অ্যারিস্টটল এ প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ক্যাথারসিস তথা রেচন।
দীর্ঘদিন স্ত্রী সাহচর্যের বাইরে থাকা একজন পুরুষের মনে সঙ্গত কারণেই যৌনাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাবে। অ্যারিস্টটলের মতে, একটি নান্দনিক নারীর চিত্রকর্ম তার সে আকাঙ্ক্ষাকে অনেকটাই হ্রাস করতে সক্ষম হবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এমন অনেক কিছুই সিনেমায় আমরা দেখে থাকি, যা আমরা করতে চাই কিন্তু পারি না, পেতে চাই কিন্তু পাই না। সিনেমায় সেসব দেখার সময় আমাদের অবচেতন মন সিনেমার কাল্পনিক চরিত্রের তৃপ্তির স্বাদ আস্বাদন করে। ফলে আমাদের মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাগুলো বিকৃত হবার পূর্বেই রেচন প্রক্রিয়ায় চুকে যায়। ঠিক যেভাবে ক্যানভাসে একটি নান্দনিক ছবি দেখে ঐ ব্যক্তি যৌন চাহিদা সংবরণের শক্তি পায়। তবে, এই ক্যাথারসিস ততক্ষণ ঘটবে, যতক্ষণ শিল্পকর্মটি নান্দনিক হবে। শিল্পকর্মটি নান্দনিকতা হারালেই সেটি ক্যাথারসিস ঘটানোর বিপরীতে মানুষের মনকে বিকৃত করতে সহায়তা করবে।
এই দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, মানবজীবনে শিল্পরস এবং নান্দনিকতার কোনো বিকল্প নেই। আবার নান্দনিকতার আবেশহীন শিল্প কোনো উৎকৃষ্ট শিল্প হতে পারে না। কিন্তু, নান্দনিকতা ব্যাপারটা যেহেতু নৈর্ব্যক্তিক, তাই এটি পরিমাপ করার কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠিও নেই। তবে অধিকাংশ দার্শনিকের মতেই নান্দনিকতার সাথে নৈতিকতার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। শিল্প তখনোই নান্দনিক, যখন তা বাস্তবতাকে আরো বাস্তব করে ফুটিয়ে তোলে, নৈতিকতাকে সর্বাগ্রে স্থাপন করে। নান্দনিক শিল্পকর্ম কখনোই মানুষকে অনৈতিক হতে প্ররোচনা দেয় না। অন্য কথায়, যে শিল্পকর্মে নৈতিকতার ছোঁয়া নেই, তা নান্দনিক নয়।
ফিচার ছবি: picsart.com