পথের মাঝে ছবির দেখা

শিল্পীর মনের মাধুরী আর রং তুলির নিপুণ ছোঁয়ায় তৈরি হয় একটি চিত্রকর্ম। আর এই চিত্রকর্মগুলো প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় প্রায়শই চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। আমরা সেই নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে চিত্রকর্মগুলো দেখে থাকি। একবার ভাবুন তো, আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন আর অসাধারণ কিছু ছবি আপনি দেখতে পাচ্ছেন পথিমধ্যে বা পাশে থাকা নিষ্প্রাণ কংক্রিটের দেয়ালটিতে। আসুন আপনাদেরকে আজকে স্ট্রীট আর্ট বা পথচিত্রের ভূবন থেকে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরিয়ে আনি ।

স্ট্রীট আর্ট এমন একটি শিল্পকর্ম যা সচরাচর চলার পথ অর্থাৎ রাস্তায় আঁকা হয়। এই চিত্রগুলোর মাধ্যমে শিল্পী সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়, অনুভূতি, তাদের আবেগ এবং সচেতনতামূলক অনেক ধরনের বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে চেষ্টা করে থাকেন।

একেবারে শুরুর দিকে এই ছবিগুলো এরোসল রঙে আঁকা হয়েছিল। কিন্তু এখন অনেকগুলি কৌশল রয়েছে যেমন- মোজাইক টাইলিং, মুরাল, স্টেনসিল আর্ট, স্টিকার আর্ট, স্ট্রীট ইন্সটলেশন, হুইট পেস্ট সহ অনেকভাবেই এখন ছবিগুলো আঁকা হয়ে থাকে।

স্ট্রীট আর্টের ইতিকথা

স্ট্রীট আর্টের উদ্ভবের একদম সঠিক দিন, তারিখ বা স্থান সম্পর্কে ইতিহাসে কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। অনেকেই বলে থাকেন, মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই এই শিল্প বিরাজমান। ১৯৮০ সালের আগে স্ট্রীট আর্ট উন্নয়নের ডকুমেন্টেশন পাওয়াটা সহজ নয়। কারণ প্রযুক্তিগত কারণে আগেকার দিনে অনেক কিছুই সংরক্ষিত ছিল না। একটি বৈশ্বিক শিল্প হিসেবে স্ট্রীট আর্টের নিজস্ব বিবর্তনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা অনেকে মহাদেশেই স্ট্রীট আর্টের প্রথম উদাহরণ খুঁজে পাই।

স্ট্রীট আর্টের জনক

জোসেফ কেসেলাক

জোসেফ কেসেলাককে অনেকেই আধুনিক স্ট্রীট আর্টের জনক বলে মনে করে থাকেন।  তাঁর জন্ম ১৭৯৯ সালের ২২ শে ডিসেম্বর। বিভিন্ন জায়গায় তাঁর নাম খোঁদাইয়ের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন।

বামদিকের ছবিতে স্ট্রীট আর্টের জনক জোসেফ কেসেলাকের একটি চিত্রকর্ম দেখা যাচ্ছে এবং ডানদিকের ছবিটিতে অস্ট্রিয়ায় কেসেলাকের একটি ট্যাগ দেখা যাচ্ছে।

স্ট্রীট আর্টের উদ্দেশ্য

স্ট্রীট আর্ট শিল্পীর ব্যক্তিগত চিন্তা ধারার প্রকাশ। হতে পারে এটা রাজনৈতিক, সামাজিক, সচেতনতামূলক, বৈশ্বিক বা একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। শিল্পীরা বাস্তবিক চিন্তাগুলোকে অপটিক্যাল ইলুশ্যানের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা হয়ত কোনো গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছতে পারেন না, তাই তাঁরা তাদের চিত্রকর্মের মাধ্যমে সবার কাছে এই বার্তাগুলো ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। যাতে করে এই অভিব্যক্তিগুলো রাস্তায় উদ্ঘাটিত হয়, যেখানে সব মানুষ উপভোগ করতে পারেন এবং তাদের মূল্যায়ন করতে পারেন।

পৃথিবীর শীর্ষ ৪ জন স্ট্রীট আর্টিস্টের পরিচয়

জেন মাইকেল বাস্কুইট

জেন মাইকেল বাস্কুইট একজন আমেরিকান চিত্রশিল্পী। তিনি ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন। বাস্কুইট ছিলেন একজন গৃহহীন পলাতক, যিনি পুরো নিউ ইয়োর্ক শহরে “স্যামো” নামে পথচিত্র আঁকতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্বের সব থেকে সক্রিয় স্ট্রীট আর্টিস্ট ছিলেন। তিনি মইয়ের উপরে উঠে বেশিরভাগ ছবি এঁকেছেন।

কেইথ হেরিং

ইনিও একজন আমেরিকান চিত্রশিল্পী। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কেইথ হেরিং সারা বিশ্বে তার পথচিত্রের জন্য পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি খুব অল্প বয়সে (৩১ বছর) এইডস সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার চিত্রকর্মের মূল বিষয়বস্তু ছিল কার্টুন।

বাংক্সি

বাংক্সি ইংল্যান্ডের একজন চিত্রশিল্পী। বাংক্সি অন্যান্য স্ট্রীট আর্টিস্টদের তুলনায় অনেক পরে এসেছেন স্ট্রীট আর্টের জগতে । কিন্তু তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

লেনি ম্যাকগার

লেনি ম্যাকগার একজন আমেরিকান চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি তাঁর চিত্রকর্মের সূচনা করেন ১৯৭০ সালে এবং ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর আশেপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা।

কিছু ছবি

ইতিহাস আর আর্টিস্টদের কথা তো অনেক হল, এবার আসুন সেই অসাধারণ চিত্রকর্মগুলো একবার দেখে নেই।

রাস্তার পুরোটা জুড়ে এই ছবিটি আঁকা হয়েছে। এখানে ভূমিকম্পে পৃথিবী ভেঙ্গে যাওয়ার দৃশ্যপট তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিটি এঁকেছেন জার্মানের বিখ্যাত স্ট্রীট আর্টিস্ট এডগার মুলার।

এই ছবিতে কতগুলো মূর্তি দেখা যাচ্ছে এবং তাদের ঠিক সামনেই রয়েছে তাদের প্রতিমূর্তি বা রিফ্লেকশন। এখানে এই মূর্তিগুলো আসল, কিন্তু প্রতিচ্ছবিগুলো শিল্পীর হাতে আঁকা। এই ছবির চিত্রশিল্পী হলেন ইটালীয়ান কার্ট ওয়েনার।

মানুষের জীবনের ঘূর্ণায়মান এক চিত্র দেখানো হয়েছে এখানে। আমরা সবাই জীবনের এই ঘূর্ণায়মান চক্রে ঘুরছি।

আমাদের প্রাত্যাহিক অফিসের কর্মজীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এখানে। যেখান আমরা সবাই কাজের শিকলে বন্দী, প্রাণহীনের মতো কাজ করে চলেছে সবাই।

ছবিটি দেখলে মনে হয় যে মাটি  ফুঁড়ে এস্কেলেটরটি বেরিয়ে এসেছে। প্রথমে দেখেলে যে কেউ ছবিটিকে চিত্রকর্ম না ভেবে আসল এস্কেলেটরই ভেবে বসবেন। ছবিটি এঁকেছেন ইটালিয়ান স্ট্রীট আর্টিস্ট ম্যানফ্রেড স্টেডার।

এই ছবিটি দেখলে মনে হবে, শহরের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য যেন আপনি সী বিচে আছেন। কংক্রিটের জীবনে মুহূর্তের স্নিগ্ধতার অনুভূতি।

আহা! পথিমধ্যে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে এক কাপ গরম ক্যাপুচিনো।

দেখুন, হঠাৎ রাস্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একদানবাকৃতির হাঙ্গর। পিলে চমকানোর মতোই ঘটনা।

শহরের মাঝে এক বিশাল গুপ্তধনের সন্ধান। চারিদিকে শুধু স্বর্ণের ছড়াছড়ি। ছবিটি এঁকেছেন ব্রিটিশ আর্টিস্ট জুলিয়ান বেভার।

চিন্তায় পড়ে গেলাম, কিভাবে পার হব আমি এই জায়গা! আর চিন্তায় ফেলা ছবিটি এঁকেছেন ইটালিয়ান চিত্রশিল্পী ট্র্যাসি লি স্টাম ।

কী ভয়ংকর! মমীরা জীবিত হয়ে উঠেছে, তাদের অন্ধকার কুঠুরী থেকে তারা বেরিয়ে পড়ছে। চলার পথে হঠাৎ করে এমন ছবি চোখে পড়লে আঁতকে উঠে মন।

চল বন্ধুরা কমলা, আপেল, নাশপাতি, স্ট্রবেরী সবাই মিলে আমরা ফ্রেশ জুস হয়ে যাই।

একটি হোটেলের গায়ে এই ছবিটি আঁকা। প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে একটি  সামাজিক সচেতনতামূলক মেসেজ দেয়া হয়েছে এখানে এবং চিত্রশিল্পী ছবিটির ক্যাপশন দিয়েছেন “বন্ধ দরজার পেছনে”।

ব্যাটম্যান চলে এসেছে একজন বিপদগ্রস্থকে উদ্ধার করতে, আর চিন্তা নেই।

দরজায় পাহারা দিতে দিতে ঝিমিয়ে পড়েছি…

কী ভয়ংকর রাস্তা, সাবধানে পার না হলে একদম ধপাস!

অক্টোপাস, অক্টোপাস! বাঁচাও, বাঁচাও!

উমমম! কত্ত বড় কিটক্যাট!

পাতাল ঘরের সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পেয়ে গেছি এবার।

হিসহিস, পোড়োবাড়িতে একটি আপেল ও অজগরের গল্প।

অগোছালো চুলগুলো এবার একটু আঁচড়ে নেই।

পরিত্যক্ত বাড়িতে অশুভ আত্মার ছায়া।

অন্তঃসত্তা হওয়ার সুখবর এবং একজন নারীর পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠা।

নিষ্প্রাণ নগরীতে ছোট বাচ্চাদের খেলার একটুখানি জায়গা।

সবুজের বুকে নিষ্প্রাণ কংক্রিটের গ্রাস।

যানজটের কবল থেকে মুক্তি পাবার বিকল্প পথ।

অতৃপ্ত – পৈশাচিক ভালোবাসা…

ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে হাতে হাত মিলিয়ে পথ চলা এবং একজন আদর্শ নেতার দিক নির্দেশনায় এবং সহায়তায় লক্ষ্যে পৌঁছানো।

অপেক্ষমান ভালোবাসা।

স্ট্রীট আর্ট এবং স্ট্রীট আর্টিস্টদের থেকে শিক্ষণীয় বিষয়

১. কোনো প্রত্যাশা ছাড়া কাজ করা।

২. সমসাময়িক চলতে থাকা নিয়মনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা, যদি আপনার কাছে এর থেকে উন্নত এবং ফলপ্রসূ কোনো ধারণা থাকে।

৩. নির্ভীক হওয়া।

৪. যেকোনো নতুন কাজের দায়ভার গ্রহণ করা।

৫. কোনো কিছু জানার জন্য প্রশ্ন করুন।

৬. সহযোগিতা উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

৭. সৃজনশীলতা একটি সর্বজনীন ভাষা।

৮. জীবন একটি যাত্রা, গন্তব্য নয়।

তথ্যসূত্র

১) hyperallergic.com/14166/origins-of-street-art/

Related Articles

Exit mobile version