একুশ শতকেও বাহ্যিক অবয়ব একজন মানুষের মেধা বা পরিশ্রমকে ছাপিয়ে যায়, আবার এর কারণে অনেকেই নানা ধরনের গঞ্জনার শিকারও হয়ে থাকে। সমাজের এই পিছিয়ে পড়া মনোভাব পরিবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক ফ্যাশনের জগতের অগ্রগামী নারীদের মধ্যে অন্যতম প্যালোমা অ্যালস্যাসার।
পরিবর্তনের জোয়ার
‘ফ্যাশন’ শব্দটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ছিপছিপে গড়নের অল্পবয়সী কোনো মেয়ের চিত্তাকর্ষক ডিজাইনার পোশাকে, কোনো ফ্যাশন শো-তে হেঁটে চলার দৃশ্য। সৌভাগ্যের বিষয়, ফ্যাশন জগতে বর্তমানে মানুষের গায়ের রং, বয়স বা লিঙ্গভেদে পার্থক্য অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু এখনও ফ্যাশন যেন ছিপছিপে শারীরিক গড়নের সাথেই মানানসই। তবে ধীরে ধীরে সেখানেও পরিবর্তন আসছে।
এমনকি, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট, যেখানে নির্দিষ্ট আকৃতির শারীরিক গঠন না থাকায় স্বয়ং জিজি হাদিদকেও ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানও বর্তমানে তাদের এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ পরিবর্তন করে স্থূলকায় নারীদের মডেল হিসেবে নিয়োগ করছে এবং নিয়মিতভাবে সকল প্রকার বাহ্যিক অবয়বের অধিকারী নারীদের জন্যই তারা পণ্য তৈরি করছে। একই ধরনের পরিবর্তন দেখা গিয়েছে ডলচি এন্ড গ্যাবানা, ফেন্ডি, কোচ, ফেরাগ্যামো সহ আরও বেশ কিছু ফ্যাশন হাউজের শো-তেও।
প্যালোমার স্বকীয়তা
প্যালোমার শারীরিক বিশেষত্ব এই যে তিনি শুধু যে স্থূলকায়ই নন, বরং তিনি কৃষ্ণবর্ণের অধিকারীও। তার জাতীয়তাও বৈচিত্র্যময়– মায়ের জাতীয়তায় রয়েছে আফ্রিকা ও আমেরিকার মিশ্রণ, আর বাবার জাতীয়তায় রয়েছে চিলি ও সুইজারল্যাণ্ডের মিশ্রণ। প্যালোমা বেড়ে উঠেছেন লস আঞ্জেলসের কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে, যদিও তার স্কুলে ছিল শ্বেতাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের অগ্রাধিকার। পারিবারিক বিত্তবৈভবের দিক থেকেও তিনি তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট পিছিয়ে ছিলেন।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তার মুখমণ্ডল, যার কারণে তাকে দেখলে ঠিক পাশের বাড়ির মেয়েটির মতোই চেনাজানা মনে হয়- ফ্যাশন জগতের বেশ বড় একটি অংশের ক্রেতারা তার সাথে নিজেদের মিল খুঁজে পায়। বহুসাংস্কৃতিক পরিচিতি ও অভিজ্ঞতা এবং একইসাথে ইউরোপীয় ও ল্যাটিন শারীরিক গড়নের কারণে তিনি ফ্যাশন জগতে খুব সহজেই একটি স্বকীয় অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।
সে যখন ফ্যাশন জগতে যাত্রা শুরু করে তখন, বিশেষ করে স্থূলকায় মডেলদের মাঝে তার মতো আর কেউই ছিল না। সকলেই বেশ কঠিন সময় পার করছিল। ‘কুল গার্ল’ বলতে যা বোঝায় সেরকম কেউই ছিল না- প্যালোমা এই জগতে প্রবেশ করে নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
– মিনা হোয়াইট, পরিচালক, আইএমজি মডেল ম্যানেজমেন্ট
ফ্যাশন জগতে পদার্পণ
আমার পরিকল্পনায় মডেলিং কখনোই ছিল না- আমার ধারণা ছিল, খুব বেশি হলে আমি এমন কোনো কাজ করতে পারবো যেখানে ব্যক্তিত্বের প্রাধান্য রয়েছে। আমি এমটিভি দেখতাম আর ভাবতাম একজন ভিজে হতে পারলে দারুণ ব্যাপার হতো!
– প্যালোমা অ্যালস্যাসার
স্কুলের পাঠ চুকিয়ে, সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য প্যালোমা নিউ ইয়র্কের ‘নিউ স্কুল’-এ যোগ দেন। এ সময় নিউ ইয়র্কে উপলব্ধ শিল্প, চলচ্চিত্র ও সংগীত বিষয়ের সকল উপস্থাপনাই তিনি উপভোগ করতে শুরু করেন। অথচ বিশ্ব ফ্যাশনের চারটি রাজধানীর মধ্যে একটি নিউ ইয়র্ক, আর ফ্যাশন জগতেই তার কোনো রকম আকর্ষণ ছিল না- তবে স্বকীয় বাহ্যিক অবয়ব, ফ্যাশন জগতের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের নজর কাড়তে শুরু করে।
অস্ট্রেলীয় স্টাইলিস্ট ও বন্ধু স্টিভি ডান্সের জোরাজুরিতেই প্যালোমা মডেলিং এজেন্সিতে ঢুঁ মারতে শুরু করেন। কিন্তু সঠিক পোশাক নির্বাচনের গুণ না থাকায় তিনি বার বার ব্যর্থ হতে থাকেন। এরই মাঝে তিনি ছোটবেলার বন্ধু আর্ল সোয়েটশার্টের ২০১৫ সালের কনসার্ট ট্যুরে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। যেদিন দলটি ফিলাডেলফিয়া পৌঁছায়, সেদিন তিনি একটি ইমেইল পান যা তার জীবনের গতিধারা পুরোপুরি পাল্টে দেয়।
বিশিষ্ট প্রসাধন শিল্পী প্যাট ম্যাকগ্রাথ নিজ নামে প্রসাধনী পণ্য বাজারে আনার জন্য নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন। প্যালোমার শান্তস্নিগ্ধ রূপ তার নজর কাড়ে। প্যালোমা ফ্যাশন সম্পর্কে খুব বেশি না জানলেও কৃষ্ণাঙ্গ এই প্রসাধনশিল্পীর খ্যাতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ফ্যাশন জগতে প্যালোমার যাত্রার শুরু থেকে বর্তমান সাফল্য লাভের এই যাত্রায় ম্যাকগ্রাথ ছিলেন তার সর্বক্ষণের উপদেষ্টা।
প্রতিবন্ধকতা ও সাফল্য
ম্যাকগ্রাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বেগ পেতে না হলেও ফ্যাশন জগতের মূল কাজে সুযোগ পেতে প্যালোমাকে আরও অপেক্ষা করতে হয়। বাণিজ্যিক প্রচারণায় শুধুমাত্র সেসকল মডেলকেই নেওয়া হতো যাদের ছবি ম্যাগাজিনের পাতায় শোভনীয় মনে হতো। অন্যদিকে, তার উচ্চতা অন্য স্থূলকায় মডেলদের তুলনায় কম। তবে এই যাত্রায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল তার আত্মবিশ্বাসের অভাব, যদিও খুব শীঘ্রই তিনি উপলব্ধি করেন, একটি নির্দিষ্ট নিয়ম প্রচলিত থাকার মানে এই নয় যে নতুন কোনো কিছুর জন্য স্থান নেই।
তারপর? তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই আত্মবিশ্বাস ও উপলব্ধি তিনি শুধুমাত্র নিজের অবস্থানের উন্নতির জন্যই নয়, বরং বিভিন্ন বর্ণের ও উপজাতীয় তরুণদের অধিকার আদায়ে উৎসাহিত করতেও কাজে লাগিয়েছেন। যেকোনো সাক্ষাৎকার ও সামাজিক মাধ্যমে তিনি বরাবরই স্পষ্টভাষী ও সাহসী। সম্প্রতি তার মতো শারীরিক অবয়বের অধিকারীদের সৌন্দর্য্যকে ছবির মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
আমি এমন পোশাক তৈরি করতে চাই যা হবে শুধুমাত্র আমাদের মতো শারীরিক অবয়বের অধিকারী নারীদের জন্য!
– প্যালোমা অ্যালস্যাসার
চাকরির পাশাপাশি মডেলিং ছাড়া অন্যান্য উপায়েও তিনি সমাজে অবদান রাখতে চান। তার মতে, বাজারে যেসকল ডিজাইনার পোশাক বিক্রি হয় তার কোনোটাই ঠিক তার মতো নারীদের উদ্দ্যেশ্যে তৈরি নয়, বরং এসকল পোশাকে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এই ধরনের নারীদের জন্য পোশাক তৈরি করতে হলে ফ্যাশন জগতের অনেক গভীরে গিয়ে গোড়া থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আর সেই লড়াইয়ের জন্য তিনি প্রস্তুত।