দৈনন্দিন জীবনে একজন মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। একেবারেই ঝামেলাবিহীন মানুষ আপনার পক্ষে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারপরেও আপনি যখন কাউকে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করবেন, তিনি তাঁর সমস্যার কথাটি এড়িয়ে গিয়ে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে তাঁর জীবন কত নির্ঝঞ্ঝাট, কত নিখুঁত। সাধারণত এক অর্থে এই উত্তরগুলো সম্পূর্ণ ভুল এবং অর্থহীন। এটাই বাস্তব যে আপনার জীবনেও অন্যান্য মানুষের মতোই সমস্যা আছে। এ ধরনের সাধারণ কিছু সমস্যাগুলো নিয়েই আজকের আয়োজন ।
শুরু করার সাথে সাথে প্রশ্নে প্রশ্নে একটু খোঁজাখুঁজি করা যাক। সেগুলো হতে পারে আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবসাদ কিংবা আপনার প্রিয় কোনো বদঅভ্যাস, যেটাকে আপনি বদ অভ্যাস বলে মনে করেন কিন্তু ছাড়তে নারাজ অথচ সেটাকে পুঁজি করে দিনের পর দিন নিজেকে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন কিংবা এর থেকেও বড় কিছু। আচ্ছা, আমরা প্রশ্নগুলোর দিকেই তাকাই–
১. কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ ?
২. হতাশায় ভুগছেন ?
৩. মিথ্যা বলা কি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ?
৪. প্রয়োজনীয় কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে ?
৫. কোনোরকম আসক্তি আছে ? (গেম খেলা, পর্ণ দেখা অথবা প্রেমে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি)
৬. কিছু হলেই অভিযোগ করতে ছোটেন কি ?
৭. পৃথিবীর সব মানুষের ব্যাপারে তিক্ত অনুভূতি আছে কি ?
৮. নিজের বাবা-মায়ের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই ?
৯. গড়িমসি করার অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না ?
মজার ব্যপার হচ্ছে, আমরা প্রত্যেকেই ব্যাক্তিগত সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত। যেগুলো আগেই প্রশ্ন আঁকারে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যেই একটা বড় সমস্যা লুকিয়ে আছে, তা হলো সামনে সমস্যা বা ঝামেলা থাকলেও সেটা কাটিয়ে ওঠার কোনো চেষ্টা না করা। আর এই ভুলের ফলাফল হয় এই রকম, সমস্যার মুখোমুখি আমাকে হতেই হবে সেটা একটু আগে অথবা একটু পরে। মনে রাখবেন,আপনার সমস্যার কারণে পৃথিবী কিন্তু থেমে থাকবে না; আপনার সমস্যা যতই বড় হোক না কেন।
গত বছর আমারই এক বান্ধবীর সম্পর্ক খারাপ চলছিলো তার একটা ছেলেবন্ধুর সাথে। এই নিয়ে যদিও তার অভিযোগের শেষ ছিল না, কিন্তু এর সমাধানে তাদের কোনো উদ্যোগও ছিল না। পুরোটা বছর লেগেছে তার এই সমস্যার রহস্য সমাধান করতে। আসলে মেয়েটি মিথ্যা ভয় পেত, ছেলেটি ভয় পেতো একাকীত্বের। শেষমেশ দুজনের ব্যর্থ চেষ্টায় সম্পর্কের যবনিকা। যা-ই হোক, এই বিষয়ে আমরা আর না যাই। আমাদের সবার জীবন সম্পর্কিত দর্শন একেক রকম এবং তা পরিবর্তনের উপায়ও ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সমাধান একটাই, সঠিক সময়ে সমস্যাকে খুঁজে বের করে তা সমাধানে ঝাপিয়ে পড়া।
“ঠিক আছে, কিন্তু …”
সবসময়ই “কিন্তু” কথাটি এসে যায়। তবে আমি এ কথাও বলছি না যে, আপনার সমস্যা সমাধান কোনো ব্যপারই না। তবে এটা নিশ্চিত যে, আপনাকে চেষ্টা করতে হবে অন্যভাবে, বেছে নিতে হবে অন্য কোনো রাস্তা। অর্থাৎ আপনার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমস্যায় পড়লে আপনি অনুভব করেন আপনার নিজের অসহায়ত্ব, নিজের সীমাবদ্ধতা । কারণ আপনি যদি জানতেন যে কিভাবে আপনার সমস্যা দূর করতে হবে, তাহলে আপনি নিজেই তা করে ফেলতে পারতেন। অর্থাৎ আপনি স্বীকার করছেন যে আপনার সমস্যা আপনি নিজে সমাধান করতে অপারগ।
বিষয়টি আপনার কাছে অবশ্যই জটিল । তবে তার মানে এটা নয় যে আপনার পক্ষে সমস্যার সমাধান করা পুরোপুরি অসম্ভব । আপনাকে আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে।
আমাদের সমস্যা সমাধান সম্পর্কে আইনস্টাইনের বক্তব্যটি অসাধারনঃ “We cannot solve our problems with the same thinking we used when we created them.” অর্থাৎ “যে চিন্তা করে আমরা সমস্যা তৈরি করে ফেলেছি, সেই একই চিন্তা ধরে রেখে এটির সমাধান করা যাবে না।”
আপনার সমস্যার সমাধান করতে হবে আপনাকেই। কেননা কিছুই না করার চাইতে কিছু করাটাই শ্রেয়, তাই নয় কি ? বেশিরভাগ মানুষই এ অবস্থায় অসহায় এবং ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এবং আপনার প্রতি অনুরোধ রইল, নিজেকে এই বেশিরভাগ মানুষের কাতারে ফেলবেন না। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখুন যে আপনি অবশ্যই পারবেন। আপনার অবস্থান হোক আপনার সমস্যার উর্ধ্বে।
এখানে একটু আত্মবিশ্বাসের কথায় আসি, সাধারণত বলা চলে, সমস্যা সমাধানের খাতিরে আত্মবিশ্বাস অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আপনার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে পারে আপনার সমস্যা সমাধানের প্রখরতা। তেমনি আবার দুর্বল আত্মবিশ্বাসের অভাবে আপনার পুরো পরিশ্রমটাই পন্ড শ্রমে হয়ে যেতে পারে ম্লান। তবে সব কিছুই বেশি ভালো না, বলা যায় অতিমাত্রার আত্মবিশ্বাস আপনার ব্যক্তিত্ব বা আপনার চিন্তা চেতনার প্রখরতাকে না বাড়িয়ে বরং অপরের মনে জন্ম দিতে পারে আপনার সর্ম্পকে নেতিবাচক মনোভাবের, যেটা আপনি না চাইলেও হবে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে উদাসীনতা বলতে কোনো কিছুতে কাউকে পরোয়া না করে করে যাওয়ালে বোঝানো হয়। তবে ভালো-খারাপ কোনো কিছুকে গুরুত্ব না দেওয়াও উদাসীনতার অর্ন্তভুক্ত। এই উদাসীনতার ব্যাপারগুলো সংক্রামক হারে ছড়িয়ে পড়ে, হতে পারে আপনার ব্যবসার ভবিষ্যৎ, সংসার, চাকরিজীবন, প্রেম ভালোবাসা সংক্রান্ত এসব। তবে এসব নিয়ে আপনি যদি চিন্তা না করেন, তবে কী করে সেখান থেকে সমাধান আশা করবেন? আপনার সামনের দিকে এগিয়ে প্রধান ভিত্তি হলো এসব সমস্যার সমাধান করা। সেই সমস্যা ভেদ করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
সমস্যা সমাধান নিয়ে হতাশার বালাই ধরতে গেলে সবারই একটু একটু আছে। ওই যে, আগে বলেছিলাম হাল ছেড়ে দেয়া, মূলত আপনার সম্ভাবনার রাস্তা একেবারেই বন্ধ করে দিতে পারে এই নাম না জানা প্রতিষেধকহীন রোগটি। হ্যাঁ, হতাশা যেকোনো কিছু ধ্বংস করে দিতে পারে, সে ক্ষমতা তার আছে। তবে এখানে আপনাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে আশার নামক ভেলায় চেপে।
একটু মনে করে দেখুন…
ছোটবেলা ভাব সম্প্রসারণে পড়েছিলেন, “সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা আশা তার একমাত্র ভেলা”। বলা চলে, দুরাশার দুঃসময়েও মানুষ নতুন করে আশায় উদ্দীপ্ত হয়। চায় নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে। আশাই মানুষের জীবনীশক্তি। তাইতো বলা হয় – ‘আশায় বসতি।’ আশা ভাগ্যহতকে শোনায় জেগে উঠার গান। আশার ভেলায় ভর করেই চলছে পৃথিবী, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সভ্যতা, নতুন নতুন স্বপ্ন। সমস্যাহীন জীবন কেউ কখনো পায়নি, কিন্তু সবসময় আশা ধরে রাখতে হয়। চলার পথে নানান বাধা আসবে, তাই বলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া চলবে না। যেখানে আশা নেই, সেখানে কোনো সম্ভাবনা নেই- এ কথার ভুল প্রমাণ না হয় নিজেই দিয়ে দিন আরেকবার। হতাশাকে বিদায় বলুন। চেষ্টা করুন হতাশাকে সুযোগে পরিণত করার। হতাশাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে পারাটাও একটি বিশাল গুণ।
আপনার হাতে একটাই উপায়, সমস্যার সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। আপনার সমস্যা আপনা আপনি যাবে না, এটিকে সরাতে হবে, হ্যাঁ, আপনাকেই। আরেকটি কথা, সমস্যা নিয়ে শুধু শুধু অভিযোগ করে আপনি হয়তো সহানুভূতি পেতে পারেন, কিন্তু এটির বিন্দুমাত্র সমাধান পাবেন না। আপনার অভিযোগের পালা শেষ হলে আবারও আপনাকেই এটির মুখোমুখি হতে হবে।