সিভি এবং রেজিউমি এই দুটি শব্দের সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। চাকুরি, উচ্চশিক্ষা কিংবা কোনো প্রশিক্ষণে বাছাই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি উতরে যেতে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে সিভি বা রেজিউমি। আপনি ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পাবেন কিনা সেটা নিয়োগদাতা আপনার সিভি বা রেজিউমি যাচাই করেই ঠিক করবেন।
সিভি আর রেজিউমি এক নয়
মজার ব্যাপার হলো, আমরা বেশিরভাগ মানুষই মনে করি সিভি এবং রেজিউমি বোধহয় একই জিনিস। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কিছু মিল থাকলেও সিভি আর রেজিউমি দুটি আলাদা জিনিস। তাই দুটি লেখার নিয়মও আলাদা।
সাধারণত উচ্চশিক্ষা, বৃত্তি, ফেলোশিপ কিংবা অনুদান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আবেদনের সময় সিভি প্রয়োজন হয়। সিভি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরি করতে হয়। এটি পড়াশোনা ও গবেষণাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে রেজিউমি মূলত দক্ষতা ভিত্তিক। অর্থাৎ আপনার দক্ষতাগুলোকে তুলে ধরার একটি মাধ্যম হলো রেজিউমি। সাধারণত বেসরকারি, অলাভজনক, ব্যবসায় কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদনের সময় রেজিউমি প্রয়োজন হয়।
এই আর্টিকেলটিতে রেজিউমি লেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা থাকবে। রেজিউমি বানানোর জন্য কোন ফরম্যাট ব্যবহার করবেন তা নির্ভর করছে আপনি যে চাকুরির জন্য আবেদন করছেন তার উপর। ইন্টারনেট ঘাঁটলে এরকম বহু ফরম্যাট পাবেন। সেখান থেকে পছন্দমত এবং উপযুক্ত ফরম্যাট অনুযায়ী রেজিউমি বানিয়ে নিতে পারবেন। তবে রেজিউমি লেখার সময় কিছু খুঁঁটিনাটি বিষয় মাথায় না রাখলেই নয়। আসুন সেগুলোই জেনে নেয়া যাক।
১. সংক্ষিপ্ত হওয়া চাই
রেজিউমির দৈর্ঘ্য হতে হবে সংক্ষিপ্ত। বলা হয়ে থাকে, এক পৃষ্ঠা হলে ভালো হয়, দু’পৃষ্ঠার বেশি নয়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে রেজিউমি যেন এক পৃষ্ঠায় রাখা যায়। তবে যাদের চাকরির অভিজ্ঞতা দশ বছরের বেশি তারা দু’পৃষ্ঠায় লিখতে পারেন। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘Short and Sweet’। অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত অথচ মধুর। আপনার রেজিউমিও ঠিক তেমনি হতে হবে। অল্প পরিসরে ফুটিয়ে তুলতে হবে দক্ষতাগুলোকে। এক্ষেত্রে বুলেট পয়েন্টে তথ্যগুলোকে গুছিয়ে লেখাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
২. অপ্রয়োজনীয় তথ্য পরিহার করুন
আমরা অনেক সময় রেজিউমিতে বাবা-মা, ক’ ভাই-বোন সে সম্পর্কিত তথ্য দিই! কিন্তু কোনোদিন ভেবে দেখেছেন কি আদৌ এই তথ্যগুলো নিয়োগদাতার প্রয়োজন আছে কি না? তিনি জানতে চান আপনার দক্ষতার কথা, আপনার কাজের অভিজ্ঞতাগুলোর কথা। তাই রেজিউমি লেখার জন্য যে অল্প জায়গাটুকু পাচ্ছেন সেটার সদ্ব্যবহার করুন। অপ্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করার দরকার নেই। তবে হ্যাঁ, যদি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এ ধরণের তথ্য চাওয়া হয়, তবে অবশ্যই তা দিতে হবে। আরেকটি বিষয়, রেজিউমিতে কখনো মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেবেন না। এটাও একধরনের অপ্রয়োজনীয় তথ্য। অনেকে নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে লিখতে গিয়ে ভুল তথ্য দেন। এতে করে আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাশা বাড়িয়ে তোলেন আর আপনার অযোগ্যতা কখনোই অভিজ্ঞ নিয়োগদাতার চোখ এড়াবে না। তাই রেজিউমিতে ভুল বা মিথ্যা তথ্য না দিয়ে বরং নিজের মাঝে দক্ষতাগুলো গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।
৩. সব চাকরির জন্য একই রেজিউমি কখনোই নয়
এই সাধারণ ভুল আমরা কমবেশি সবাই করে থাকি। সব চাকরিতে একই ধরনের যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় না। তাই রেজিউমি হতে হবে চাকরির ধরন বুঝে। নিয়োগবিজ্ঞপ্তির ‘জব ডেসক্রিপশন’ অংশটি ভালোমতন পড়লেই বুঝতে পারবেন চাকরিদাতা আসলে কাকে খুঁজছেন। সেই অনুযায়ী সাজান রেজিউমিকে। ধরুন, আপনি একইসাথে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সেলস এক্সিকিউটিভ এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ফিল্ড ম্যানেজার পদে আবেদন করবেন। দু’জায়গায় যে দক্ষতাগুলো চাওয়া হবে, সেগুলো নিশ্চয়ই এক না। তাই আপনার রেজিউমিও হতে হবে ভিন্ন। একই রেজিউমি সব জায়গায় চালিয়ে দেয়ার বদভ্যাসটি ঝেড়ে ফেলুন।
৪. গৎবাঁধা অবজেক্টিভ লেখা থেকে বিরত থাকুন
সাধারণ রেজিউমির শুরুতে ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ লেখার সময় আমরা গৎবাঁধা কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকি, যেমন: Service Oriented, Hard Working, Self-Motivated ইত্যাদি। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের গৎবাঁধা ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ সবাই-ই লেখে। ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ লিখুন ‘জব ডেসক্রিপশন’এর সাথে মিল রেখে। তারা কেমন মানসিকতার লোক চাচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে ঠিক করুন ক্যারিয়ার অবজেক্টিভে কোন শব্দগুলো ব্যবহার করবেন। আপনার একটুখানি ব্যতিক্রমধর্মী ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ আপনার রেজিউমিকে দিতে পারে ভিন্নমাত্রা।
৫. তথ্য হওয়া চাই সুনির্দিষ্ট
এলোমেলো বা অনির্দিষ্ট নয়, বরং তথ্যগুলো দিন সুনির্দিষ্টভাবে। এখন আমি যদি আপনাকে বলি, “আমি ‘X’ প্রতিষ্ঠানে প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছি।” তাহলে আপনি শুধু জানবেন যে আমি প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতাম। কিন্তু আমি যদি বলি, “আমি ‘X’ প্রতিষ্ঠানে প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে দু’বছর ধরে ২০টিরও বেশি প্রোগ্রামের ম্যানেজমেন্ট, মনিটরিং এবং ইভ্যাল্যুয়েশনের দায়িত্ব পালন করেছি।” তাহলে আপনি আমার কাজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আমি কোন বিষয়ে দক্ষ সেটাও জেনে যাবেন। রেজিউমি লেখার সময়ও ঠিক এভাবেই সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে আপনার দক্ষতাগুলোকে তুলে ধরতে হবে।
৬. ফন্ট এবং ডিজাইনিং এর ব্যাপারে সচেতনতা
রেজিউমি লেখায় ফন্টের ব্যাপারে সচেতন থাকাটা জরুরি। সহজপাঠ্য ফন্ট ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। ফন্টের সাইজ ১১ অথবা ১২ রাখাই আদর্শ। অনেক সময় আমরা অকারণেই কিছু শব্দকে বোল্ড করি বা পুরোপুরি ক্যাপিটাল হরফে লিখি। মনে রাখবেন, আপনি তখনই কোনো শব্দকে বোল্ড বা সম্পূর্ণ ক্যাপিটালে লিখবেন যখন আপনি সেটাকে হাইলাইট করতে চান। সুতরাং কোন শব্দটিকে হাইলাইট করতে চান সেটি নির্বাচনে সচেতন হোন। অনেকে রেজিউমিতে অনেক বেশি গ্রাফিক ডিজাইন ব্যবহার করে থাকেন। আপনি গ্রাফিক ডিজাইন ব্যবহার করবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণই আপনার ব্যক্তিগত রুচি। তবে মাথায় রাখবেন, নিয়োগদাতা সবসময়ই একটি পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম ও মেদবর্জিত রেজিউমি পছন্দ করেন।
৭. শিক্ষাগত যোগ্যতা
অনেকে রেজিউমিতে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সেই ছোটবেলায় কোন স্কুলে পড়েছেন সেটাও উল্লেখ করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আলাদা করে কোনোকিছু চাওয়া না হলে সর্বশেষ অর্জনকৃত দুটি ডিগ্রী উল্লেখ করাই যথেষ্ট। ধরা যাক, আপনি মাস্টার্সে পড়ছেন। এ অবস্থায় রেজিউমিতে আপনার এইচএসসি এবং অনার্স এর তথ্য প্রদানই যথেষ্ট। প্রয়োজন মনে করলে চাকরির সাথে সম্পর্কিত কোনো কোর্স প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সময় সম্পন্ন করে থাকলে সেটা এ অংশে উল্লেখ করতে পারেন। আর হ্যাঁ, সাম্প্রতিক কোনো বৃত্তি বা বিশেষ পুরস্কার পেয়ে থাকলে তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না যেন।
৮. অভিজ্ঞতা নির্বাচনে কৌশলী হোন
আপনার অনেক কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সব কি রেজিউমিতে দেবেন? নাকি দেবেন না? দিলেও কোনটা দেবেন? আবারও ফিরে যান ‘জব ডেসক্রিপশন’ এ।
কোন অভিজ্ঞতার কথা রেজিউমিতে দেবেন আর কোনটা দেবেন না সেটা ‘জব ডেসক্রিপশন’ই ঠিক করে দেবে। আবেদনকৃত পদের সাথে মিলে যায় এমন অভিজ্ঞতাগুলোকেই প্রাধান্য দিন। এরপর জায়গা বাঁচলে সেখানে অন্য অভিজ্ঞতাগুলো লিখতে পারেন।
৯. ফ্রেশারদের অভিজ্ঞতা
অনেকে সদ্য স্নাতক পাশ করেছেন বা এখনো হয়তো পড়ছেন। তারা রেজিউমির অভিজ্ঞতার জায়গাটি কি খালি রাখবেন? কখনোই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিশ্চয়ই আপনাকে কোনো না কোনো বিষয়ে টার্ম পেপার তৈরি করতে হয়েছে, গ্রুপে কাজ করতে হয়েছে, কেউ কেউ আবার রিসার্চের কাজও করে থাকেন, অনেকে বিভিন্ন ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকেন। সেটাই তুলে ধরুন গুছিয়ে, এসব কাজের মাধ্যমে আপনার মাঝে কোন দক্ষতা গড়ে উঠেছে সেটা তুলে ধরুন।
১০. ব্যক্তিগত তথ্য এবং শখ
ব্যক্তিগত তথ্য যখন দেবেন, তখন খেয়াল রাখুন আপনার ইমেইল অ্যাড্রেসটির নামটি প্রফেশনাল কিনা? অনেকের ইমেইল অ্যাড্রেসের নাম থাকে অ্যাঞ্জেল পরিনা, দুঃখবিলাসী, আগুনপাখি ইত্যাদি। এ ধরনের ইনফরমাল ইমেইল অ্যাড্রেস আপনার সম্পর্কে মারাত্মক বাজে ইম্প্রেশন তৈরি করতে পারে। আর শখের জায়গায় আমরা খুব সাধারণ কিছু ব্যাপার লিখে থাকি, যেমন: বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি। এই জায়গাটাকেও কিন্তু কাজে লাগানো যায়। যেমন অনেকের শখ গিটার বাজানো কিংবা নতুন ভাষা শেখা। এগুলো কিন্তু একধরনের দক্ষতা। সুতরাং, আপনিই ঠিক করবেন এই জায়গাটিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন।
১১. সবশেষে রিভিশন এবং রিভিশন
রেজিউমিটি বানানো হয়ে গেলে অবশ্যই বেশ কয়েকবার রিভিশন দিয়ে নেবেন। নিজে তো দেবেনই, বন্ধু বা অভিজ্ঞ কাউকেও দেখিয়ে নিতে পারেন। টাইপিং বা ব্যাকরণগত ভুলগুলো শুধরে নিন। আর অবশ্যই কিছুদিন পর পর রেজিউমিটিকে আপডেট করে নেবেন। সময়ের সাথে সাথে আপনার অভিজ্ঞতা যেহেতু সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাহলে আপনার রেজিউমি কেন নয়?
তথ্যসূত্র: theballance.com, themuse.com