একটু একটু করে নিজেদের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আস্থায় যে সংসারটা দুজন মিলে গড়ে তুলেছিলেন, ‘ডিভোর্স’ নামের একটা ছোট্ট শব্দ সেই সুখের সংসারটা নিমেষেই এলোমেলো করে দেয়। কী অদ্ভুত, তাই না? ডিভোর্স মানেই এতদিন যে জিনিসগুলো দুজন মানুষের জন্য সমান অধিকারের ছিল, হঠাৎ সেসব কিছুর উপর দুজনের আলাদা আলাদা অধিকারবোধ জন্মানো।
দাম্পত্য জীবনের সব ঝুটঝামেলার একমাত্র সহজ সমাধান যেন ডিভোর্সই! হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়াটা সহজ, কিন্তু ডিভোর্স থেকে শুরু করে ডিভোর্স পরবর্তী সময়গুলো কীভাবে সবটা সামলাবেন, ভেবেছেন তো? তারপর যদি আপনাদের দুজনের জীবনের সাথে আরও কোনো জীবন জড়িয়ে থাকে, তাহলে বলবো, আপনি আরেকবার ভাবুন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো? হ্যাঁ, আমি আপনার সন্তানের কথা বলছি, কারণ ডিভোর্স পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বাজে প্রভাবটি পড়বে আপনার সন্তানের উপরেই। মা-বাবা দুজনের এই পরস্পর সংঘর্ষমূলক আচরণের শিকার হয়ে সন্তান হয়ে পড়বে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আর অসহায়।
ডিভোর্স দেবেন, এই সিদ্ধান্ত মনের ভেতর দৃঢ়ভাবে নিয়ে নেয়ার পর আপনি ভাবতে শুরু করেন, সব সমস্যা শেষ হতে চলেছে। মনে হয় যেন আপনার দাম্পত্য জীবনের সব খারাপ দিকগুলো এবার ভালো দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। মনে রাখবেন, ভাবা আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। তাই ডিভোর্স এর মতো বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেখে নিন, কী কী ব্যাপার নিয়ে আপনার আরও একবার ভাবা উচিত।
মানুষটির প্রতি মনের মধ্যে কোথাও ভালোবাসা, মায়া লুকিয়ে নেই তো?
যে মানুষটাকে ঘিরে এতদিন স্বপ্ন আর আশা-আকাঙ্ক্ষার জাল বুনে চলছিলেন, যার চোখের দিকে তাকিয়ে অতীতের সব গ্লানি, না পাওয়ার যন্ত্রনা আর বেঁচে থাকার জীবনী শক্তি পাচ্ছিলেন, সেই মানুষটা হুট করেই আপনার জীবনের অন্যতম প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একটি মুহূর্তও আপনার সেই পরম ভালোবাসার সাথে আপনি কাটাতে রাজি নন। আপনি নিশ্চিত তো, তাকে আর ভালোবাসেন না? ডিভোর্স কিন্তু দাম্পত্য খুনসুটি নয় যে, যখন আপনি আবার বুঝতে পারবেন ওই মানুষটাকে ছাড়া আপনার চলছে না, তখন সবটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তাই এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে, মানুষটার জন্য আপনার মনে আর বিন্দুমাত্র ভালোবাসা বা মায়া বেঁচে নেই। একবার ডিভোর্স হয়ে গেলে কিন্তু আপনার মনের ভেতরের লুকানো ভালোবাসা কেবল আপনাকেই পোড়াবে আর ডিভোর্স পরবর্তী জীবন গুছিয়ে নেওয়ার পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করবে।
আপনার আদরের সন্তান, ভেবেছেন কি তার কথা?
ডিভোর্সের পর নিজেদের অন্যান্য সব জিনিসপত্রের মতো আদরের সন্তানের উপরও বাবা-মা দুজনের পারস্পরিক বিপরীতমুখী অধিকারবোধের জন্ম হয়। যার মাশুল দিতে হয় সন্তানকেই। আপনার দাম্পত্য জীবনের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হিসেবে আপনি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু ডিভোর্স পরবর্তী আপনার সন্তানের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার সকল সুবিধা আপনি প্রদান করতে পারবেন কি? হুট করে বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়ার যে ধাক্কাটা আপনার সন্তান পাবে, সেটা সামাল দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে কি সে? আর আপনি ডিভোর্স পরবর্তী কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ হলে, আপনার সন্তান পারবে কি এতকিছু মেনে নিয়ে, আর দশটা বাচ্চার মতো মানসিক বিকাশ ঘটাতে? তাড়াহুড়ো করে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরেকবার ভাবুন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করুন। তাতে করে যা হবে, ভবিষ্যতে হাহুতাশ করে জীবন পার করতে হবে না অন্তত।
ডিভোর্সের যুক্তিপূর্ণ কারণটি চিহ্নিত করতে পেরেছেন তো?
বিবাহিত জীবনে ঝগড়াঝাঁটি কিংবা মান-অভিমান, এগুলো খুব সাধারণ ইস্যু। স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকতে গেলে বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে মতবিরোধ, মন কষাকষি বা মনোমালিন্য হবেই। কারণ বিয়ে মানেই দুটি সম্পূর্ণ আলাদা মন মানসিকতার মানুষের একসাথে একই ছাদের নিচে থাকা, একই বিছানায় রাত্রি যাপন করা আর একটা ঘরকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। যেখানে আমরা স্কুল-কলেজ, এমনকি কাজ করার জায়গা বা অফিসে দিনের সামান্য কিছু সময় অতিবাহিত করতে গিয়েই মতের অমিল, মানসিকতার অমিল ও রুচিবোধের অমিল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঝামেলায় পড়ি, সেখানে এক ছাদের নিচে দুজন ভিন্ন মতের মানুষ একসাথে থাকতে গেলে টুকটাক ঝামেলা বাঁধবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসবের সূত্র ধরে আপনি যদি ভাবেন, ডিভোর্স ছাড়া ভালো থাকার আর কোনো উপায় নেই, তাহলে ভুল করবেন। তাই ডিভোর্স নেবেন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে, কেন ডিভোর্স চান সেটার যুক্তিপূর্ণ কারণ খুঁজে বের করুন। সামান্য কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপনি যদি বারবার ডিভোর্স শব্দটা টেনে আনেন, তাহলে হয়তো একটা সময় দেখা যাবে, খুব সামান্য কারনেই আপনার জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদ এর মতো ভয়াবহ ঘটনাটা ঘটেই যাবে।
আবেগতাড়িত নাকি বাস্তবমুখী, কেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?
আপনি ডিভোর্সের জন্য প্রস্তুত, এর মানে হচ্ছে আপনি আবেগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বরং ডিভোর্স আপনার সম্পূর্ণ বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। জানেন তো, আবেগ যখন কোনো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তখন সেই মানুষের মধ্যে বাস্তবমুখী বা গঠনমূলক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাটুকু বেঁচে থাকে না। তাই আবেগ আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার আগে আপনি আবেগের রাশ টেনে ধরুন। একবার ডিভোর্স হয়ে গেলে কিন্তু সবটা পাল্টে যাবে। আপনার চেনাজানা পরিচিত প্রিয় মুখগুলো বদলে যাবে। হয়তো যে বা যারা আপনার শুভ চিন্তায় এতদিন পাগলপ্রায় হয়ে যাচ্ছিলো, তারাও হুট করেই খুব বেশি নিজের জীবনের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আপনাকে বাদ দিয়ে। তাই বলবো, ডিভোর্স এর মতো জীবনের এত বড় ব্যাপারটা কারও কথায় বা নিজের আবেগের বশে নিয়ে বসবেন না। কে জানে, হয়তো এই একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্তই আপনার বাকি জীবনটা বিষাদময় করে তুলবে।
ডিভোর্স পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারবেন তো?
আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও পরিবার কাঠামো এখন পর্যন্ত কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদকে খুব স্বাভাবিক চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। আপনি ডিভোর্সি মানেই ধরে নিন, বাঁকা চাহনি, বাঁকা কথা আর বাঁকা মন্তব্য আপনার জন্য বাঁধা। নিজ পরিবার থেকে শুরু করে কর্মস্থল পর্যন্ত সব জায়গায় আপনাকে নিয়ে গুঞ্জন, গল্প আর সমালোচনার শেষ থাকবে না। আপনি পারবেন তো, এসব কিছু পেছনে ফেলে নতুন ভাবে সবটা শুরু করতে? যদি আপনি মন থেকে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস পান যে, নানা লোকের নানা গুঞ্জন আপনার নতুন জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না, তাহলে আপনি ভাগ্যবান। আর যদি না পারেন সব সমালোচনা পেছনে ফেলে নতুন শুভ সূচনা করতে, তাহলে আরেকটু সময় নিন, আরও একটু ভাবুন।
ডিভোর্সের পর আপনার করণীয় কী, ঠিক করেছেন তো?
পুরাতন সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে বেরিয়ে কী করে আপনার ডিভোর্স পরবর্তী জীবনটা সাজিয়ে তুলবেন, সেটা ঠিক করা সবার আগে দরকার, আর সেটার দায়ভার আপনারই। যখন সিদ্ধান্ত নেবেন আপনি আপনার বৈবাহিক জীবনের ইতি টানবেন, ঠিক তখনই ভেবে ফেলুন আপনার বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী করণীয় কী হবে। যা আছে কপালে তা-ই হবে, এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন সবার আগে, মনে রাখবেন আপনার জীবন আপনাকেই গুছিয়ে নিতে হবে। আপনার জন্য আহা-উহু করার লোকের হয়তো অভাব হবে না, কিন্তু সেই আহা-উহু আপনার নতুন জীবনের সুন্দর শুরুর জন্য সাহায্য করবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে আপনি যদি একটা গোছানো পরিকল্পনা করে ডিভোর্স পরবর্তী জীবনটা নিয়ে অগ্রসর হন, তাহলে আপনার সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত, এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি।
একটি ভালোবাসা আর বিশ্বাসহীন সম্পর্কের শেষ পরিণতি ডিভোর্স। একটি সম্পর্ক যখন ডিভোর্সের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়, তখন সে সম্পর্কে ঘৃণা, রাগ, ক্রোধ আর অন্ধ ইগো এত বেশি পরিমাণে বেড়ে যায় যে, মানুষ না চাইলেও এই সময়টায় অনেক ভুল কাজ করে ফেলে। যার ফলে ডিভোর্স পরবর্তী জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই তাড়াহুড়ো করে অন্ধ আবেগ বা ইগোকে পাত্তা না দিয়ে বাস্তবতা আর পারিপার্শ্বিক সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিন, আশা করি আপনি আপনার জীবনের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিতে পারবেন।
ফিচার ছবিসূত্র: barrysedwardslaw.com