সম্প্রতি বেশ কিছু টিভি সিরিজে একটি দৃশ্যের অবতারণা অতি সাধারণ হয়ে পড়েছে। সিরিজের কোনো এক চরিত্র সন্তানকে স্কুলের জন্য রেডি করছে, সকালের নাস্তা বানাচ্ছে, কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। আবার একই সিরিজে অন্য একজন চরিত্র বিদেশী ক্রেতার ইমেইলের উত্তর দিচ্ছে, কল রিসিভ করে কথা বলছে, অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। এই সবগুলো কাজ চরিত্রগুলো একের পর এক ক্রমান্বয়ে না করে বরং একইসাথে করে চলেছে। মূলত তারা মাল্টিটাস্কিং করছে।
কাজের ধরনের প্রেক্ষিতে মানুষকে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একদল মাল্টিটাস্কিং করেন, আর অন্য দল একটি কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ করে এরপর অন্য কাজে মনোনিবেশ করেন। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে- সৃজনশীলতার বিকাশে মাল্টিটাস্কিং সত্যিই ভূমিকা রাখে কি না?
বেশ কিছুদিন আগপর্যন্ত গবেষকদের ধারণা ছিল মাল্টিটাস্কিং মূলত কাজের মান হ্রাসের জন্য দায়ী। বিষয়টি তারা ব্যাখ্যা করতেন এভাবে যে, দুটি ভিন্ন কাজ একইসাথে করলে মানুষের মস্তিষ্ক হিসেবনিকেশে ভুল করে ফেলে; অনেকটা যেন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। যখন অসম্পন্ন একটি কাজ থেকে চট করে ভিন্ন আরেকটি কাজে হাত দেওয়া হয়, তখন দুটি কাজই সঠিকভাবে সম্পন্নের দিকে অগ্রসরের হার হ্রাস পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, আপনি হয়তো একইসাথে চা বসাচ্ছেন চুলোয় আর হোয়াটসঅ্যাপে সহকর্মীকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন। সম্ভাবনা আছে- হয় আপনি চায়ের উপাদানে কোনো গড়মিল করবেন, কিংবা মেসেজে বানান ভুল করবেন। অর্থাৎ কাছাকাছি সময়ে একইসাথে দুটি ভিন্ন কাজ করতে গেলে মস্তিষ্ক তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করে।
এই বিষয়কে ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞানের জগতে অসংখ্য গবেষণা সম্পাদিত হয়েছে। তবে এসব কাজের প্রতিটিই প্রকৃতপক্ষে মাল্টিটাস্কিংয়ের তাৎক্ষণিক ফলাফলের উপর নজর দিয়ে প্রাপ্ত তথ্যকে বিশ্লেষণপূর্বক একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। মাল্টিটাস্কিংয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হতে পারে সেই বিষয়ের ওপর গবেষণা জানাচ্ছে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য।
ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার কেনান ফ্ল্যাগলার বিজনেস স্কুলে অর্গানাইজেশনাল বিহেভিয়ারের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত শিমুল মেলওয়ানি। মেলওয়ানি ও তার সাবেক ছাত্রী এবং পরবর্তীতে ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক চৈতালী কাপাডিয়া যৌথভাবে বেশ কিছু গবেষণা পরিচালনা করেছেন মাল্টিটাস্কিংয়ের সাথে সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক নিয়ে।
তাদের এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। দু’দলের সদস্যরাই বাধ্যতামূলকভাবে একটি কনফারেন্স কলে অংশ নেন। তবে একটি দল কলে থাকা অবস্থাতেই ইমেইলের উত্তর দেয় এবং অন্য দল কল শেষ করে তারপর ইমেইলের উত্তর দেয়। এরপর প্রত্যেক দলের সদস্যদেরই অল্টারনেটিভ ইউজারস টেস্টে অংশ নিতে বলা হয়। এই পরীক্ষায় গৃহস্থালির কোনো অতি পরিচিত বস্তুকে (হতে পারে ইট, বই, কলম) ভিন্ন পরিচয় প্রদান করতে বলা হয়। পরীক্ষা শেষে বিচারকরা অংশগ্রহণকারীদের আইডিয়াগুলো কতটা স্বকীয় এবং মৌলিক ছিল সেটার ওপর মন্তব্য করেন।
দেখা যায়, যারা ইমেইল ও কনফারেন্স কলের সময়ে মাল্টিটাস্কিং দলে ছিলেন, তারা গৃহস্থালি কোনো বস্তুর বিকল্প ব্যবহার হিসেবে অধিকতর সৃজনশীল এবং ভিন্নধর্মী আইডিয়া দিতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে এই দু’দলকে এমন একটি শব্দজট সমাধান করতে দেওয়া হয় যেখানে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতার চেয়ে বরং বিশ্লেষণধর্মীতার বিচার হয় বেশি। এই শব্দজট খেলার দক্ষতায় তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। অর্থাৎ সৃজনশীলতার সাথেই মাল্টিটাস্কিং সূক্ষ্মভাবে জড়িত।
রন্ধনশিল্প; সত্যিকার অর্থেই একটি শিল্প। গবেষকরা সৃজনশীলতার সন্ধানে গেছেন হেঁশেল অব্দি। টিভি শো চপড-এর (Chopped) একেকটি পর্বে পেশাদার শেফদের সামনে হাজির করা হয়েছিল নানাবিধ উপকরণ। অংশগ্রহণকারী শেফরা কেউই এসব উপকরণ সম্বন্ধে বিশদ জানতেন না। ধারাবাহিকভাবে অ্যাপেটাইজার, অন্ট্রে, এবং ডেজার্ট তৈরির প্রতিটি ধাপেই যথেষ্ট পরিমাণ মাল্টিটাস্কিং-এর দরকার ছিল। রান্না শেষে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেফদের তত্ত্বাবধানে সকলের মাল্টিটাস্কিং এবং রান্নার মান যাচাই করলে দেখা যায় যে অ্যাপেটাইজার বানাতে যিনি যত বেশি মাল্টিটাস্কিং করেছিলেন তার অন্ট্রে তত বেশি সুস্বাদু এবং মানসম্মত ছিল। অন্ট্রে প্রস্তুতকরণের ক্ষেত্রে যার মাল্টিটাস্কিংয়ের হার ছিল সর্বাধিক, তার ডেজার্ট তত বেশি চমৎকার হয়েছিল। নিজেদের প্রস্তাবিত তত্ত্বের সাথে মেলওয়ানি আর কাপাডিয়ার এই গবেষণার ফলাফলও মিলে যায়।
কিছুটা অবাক আর কিছুটা অতি উৎসাহী হয়ে কাপাডিয়া অংশগ্রহণকারী শেফদের মাঝ থেকে কারো কারো সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন যে রান্নার সেই টিভি সিরিজ সম্পর্কে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন ছিল? গবেষণার ফলাফল জোরদার করার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার ঠিক বিজ্ঞানসম্মত না, বরং অ্যানেকডোটাল, অর্থাৎ যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি-নির্ভর তথ্য। শেফরা তখন স্বীকার করেন যে তিনি যত বেশি মাল্টিটাস্কিং করতে পেরেছিলেন, তত বেশি তার কাছে নিজেকে সতেজ ও প্রাণবন্ত লেগেছিল। এই ফুরফুরে মেজাজ যার যত বেশি ছিল, তিনিই পরের ধাপে তত বেশি মৌলিক ও অভিনব পদ রান্না করতে পেরেছিলেন।
এছাড়াও মেলওয়ানি ও কাপাডিয়া আরেকটি গবেষণা পরিচালনা করেন বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় কর্মরত ১৫০ জন ওয়েটার ও ওয়েট্রেসের ওপর। দুটি ভিন্ন সময় (শিফট) তারা বেছে নেন- শুক্র ও শনিবার (অত্যন্ত ব্যস্ত), এবং মঙ্গল ও বুধবার (ঢিমেতাল)। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককেই ভিনগ্রহবাসীর ছবি আঁকতে বলা হয়। এর পাশাপাশি তারা অল্টারনেটিভ ইউজারস টেস্টেও অংশ নেন। প্রশ্ন হচ্ছে- ভিনগ্রহবাসীর ছবি থেকে কীভাবে বোঝা যাবে যে কে কতটা অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছেন কিংবা কে কতটা সৃজনশীল? ছবিগুলো যত বেশি মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে, তত বেশি শিল্পীর চিন্তার সীমারেখা কম, এবং অন্য দিকে, যত বেশি মানুষ থেকে আলাদা অথবা স্টেরিওটাইপ ভিনগ্রহবাসী থেকে ভিন্ন, শিল্পীর চিন্তন দক্ষতা তত বেশি। এই পরীক্ষা থেকে ফলাফল মিলল যে, যেসব কর্মী ব্যস্ত সময়ে কাজ করেন, তারা তত বেশি মাল্টিটাস্কিং করতে বাধ্য হন। যত বেশি মাল্টিটাস্কিং, তত বেশি সতেজতা। এরই বদৌলতে তারা তত বেশি অভিনব ভিনগ্রহবাসীর ছবি এঁকেছিলেন।
এতসব গবেষণা যদি সত্যিই মাল্টিটাস্কিং সম্বন্ধে ইতিবাচক কথা বলে থাকে, তাহলে আমাদের জীবনে মাল্টিটাস্কিংয়ের অবস্থান কোথায়? সত্যিই কি আমাদের মাল্টিটাস্কিংয়ের প্রতি উৎসাহী হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি “হ্যাঁ” কিংবা “না” বলাটা বেশ মুশকিল।
মাল্টিটাস্কিং করতে গিয়ে যদি আপনার মানসিক চাপ বেড়ে যায় তাহলে বিষয়টি অবশ্যই দুশ্চিন্তার। সৃজনশীলতাকে আকাশচুম্বী করতে গিয়ে যদি মানসিক স্থিরতাই না থাকে, তাহলে এই ‘ট্রেড অভ’ একেবারেই মানানসই হয় না। একইসাথে একাধিক কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো দক্ষ যদি আপনি হয়ে থাকেন, শুধু তাহলেই আপনি নিজের নিজস্বতাকে বৃদ্ধি করতে মাল্টিটাস্কিং বেছে নিতে পারেন। অন্যদিকে, যদি মাল্টিটাস্কিং আপনাকে কিছুটা এলোমেলো অবস্থার সম্মুখীন করে, তাহলে আপনি হাতে থাকা কাজগুলো একের পর এক ক্রমান্বয়ে শেষ করুন।
দিনশেষে আমাদের সকলেরই একটি বিষয়ে সজাগ থাকা উচিত। প্রতিযোগিতাটা অন্যের সাথে না, বরং আপনার নিজের সাথেই। জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের সেরা সংস্করণ হয়ে ওঠা। কেউ মাল্টিটাস্কিং করতে অসাধারণ পারদর্শী, তাই বলে আপনাকেও সেরকম হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। নিজের মতো করে জ্বলে উঠুন।