মনে করুন, আপনি অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। বাসের অপেক্ষায় স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় পকেটে আপনার ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠলো। ফোনটি চেক করতে গিয়ে পকেটে হাত দিতেই আপনার মনে পড়লো ফোনটি আপনার পকেটে নয়, ব্যাগে রয়েছে। অথচ আপনি ঠিকই পকেটে ভাইব্রেশন টের পেয়েছিলেন! কী ভূতুড়ে কান্ড, তাই না?
না, ভয় পাবার কিছু নেই। এমনটি শুধু আপনার একার সাথেই ঘটে তা নয়। বরং গবেষকদের মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন কোনো না কোনোভাবে এমন বিভ্রান্তির শিকার হন। আর এই যে ফোনে কল কিংবা মেসেজ না আসার সত্ত্বেও আপনার মনে হলো ফোনটি ভাইব্রেট হচ্ছে- একেই বলা হয় ‘ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোম’। এটি হলো একধরনের প্রযুক্তিগত মানসিক বিভ্রান্তি।
বর্তমানে আমাদের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে আমরা আমাদের দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ঘরে কিংবা বাইরে কোথাও বেরোতে হলে সাথে আমাদের ফোনটি থাকা চাই। কোনো কাজের ফাঁকে কিংবা অবসরে ফোন বের করে একটু টেপাটিপি করা চাই! অনেকে তো আবার ফোনের নোটিফিকেশন চেক না করে পাঁচ মিনিটও থাকতে পারেন না। আমাদের পকেটে কিংবা ব্যাগে ফোনটি রাখতে রাখতে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে ফোনটি যেন আমাদের শরীরেরই একটি অংশ।
গবেষকদের মতে, মোবাইল ফোনগুলো আমাদের শরীরে এমন একটি অভ্যাসের সৃষ্টি করছে যাতে শরীরের নানা সংবেদনগুলোকে আমাদের শরীর ফোনের কল কিংবা মেসেজ আসার ভাইব্রেশন ভেবে ভুল করছে।
আটলান্টার জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণারত ডক্টর রবার্ট রোসেনবার্গ জানান, ভাইব্রেট বা কম্পনরত ফোনকে শনাক্ত করা আমাদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তার মতে, ফোনের ব্যবহারকারীরা একটি কল কিংবা মেসেজ মিস করার ভয়ে এতটাই ভীত থাকেন যে তাদের সমস্ত শরীর শুধুমাত্র ফোনের সেই ভাইব্রেশনটি টের পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। ফলে ফোনের ভাইব্রেশনের মতো একই রকম কোনো শারীরিক অনুভূতি, যেমন- কাপড়ের নড়াচড়া কিংবা হয়তো কোনো পেশীর সংকোচন-প্রসারণকেই ঐ ব্যক্তি ফোনের ভাইব্রেশন ভেবে ভুল করেন।
ডক্টর রোজেনবার্গ বলেন,
“মনে করুন, আপনি একজোড়া চশমা পরে আছেন। আপনি যদি বহুদিন থেকে চশমা পরে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে এই চশমাই কিন্তু আপনার শরীরের একটি অংশে পরিণত হয়। আপনি যে চশমা পরে আছেন সেটি একসময় আপনি বুঝতেও পারেন না। অনেক সময় দেখা যায় আপনি চশমা খুঁজে মরছেন অথচ চশমাটি ঠিক আপনার চোখেই রয়েছে! ফোনের ভাইব্রেশনের ব্যাপারটিও ঠিক এমনই।”
শারীরিক অভ্যাসবশত আপনার ফোনটিও চশমার মতোই আপনার শরীরের একটি অংশে পরিণত হয়ে যায়। আর ‘ফোনে ভাইব্রেশন হলেই ধরে নিতে হবে কোনো কল কিংবা মেসেজ এসেছে’ – এমনটা ফোনটি আমাদের শরীরকে শিখিয়ে দেয়। আর এমন একটি অভ্যাস গড়ে উঠার ফলে খুব সহজেই আমাদের শরীর একই ধরনের কোনো ভাইব্রেশন বা কম্পনকে ফোনের ভাইব্রেশন ভেবে ভুল করে।
প্রথমদিকে যারা পেজার ব্যবহার করতেন তাদের মধ্যেই কেবল এই ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোমটি দেখা যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে স্মার্টফোনের বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং অ্যাপ, যেমন- ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার প্রভৃতি অ্যাপের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। আর এসব অ্যাপ থেকে আসতে থাকে প্রচুর নোটিফিকেশন এলার্ট অর্থাৎ প্রচুর ভাইব্রেশন। ফলে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যেও এই ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোম ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালে কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্য করা একটি জরিপে দেখা যায়, একশো জনের ভিতরে ৯০ জন শিক্ষার্থী এই সমস্যা কখনো না কখনো অনুভব করেছেন। একটি হাসপাতালের কর্মচারীদের মধ্যে করা আরেকটি জরিপেও ঠিক একই রকম ফলাফল দেখতে পাওয়া যায়। তাদের মতে, তারা প্রায় প্রতি সপ্তাহে কিংবা প্রতি মাসেই একবার না একবার এই সমস্যার সম্মুখীন হন। মজার ব্যাপার হলো, সে বছরই কাকতালীয়ভাবে ম্যাককুয়ারি ডিকশনারি নামের একটি অভিধান ফ্যান্টম ভাইব্রেশন সিন্ড্রোমকে তাদের ‘Word of the Year’ হিসেবে ঘোষণা দেয়।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ফোনের ভাইব্রেশন অফ করে রাখলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! কিন্তু না, যারা ফোনের ভাইব্রেশন অফ করে নরমাল ‘রিং’ মোডে ফোন ব্যবহার করেন তারাও ঠিক একই ধরনের একটি সিন্ড্রোমে ভোগেন। আর সেটির নাম হলো ‘রিংজাইটি’ (ringxiety)। একটু ভীড় কিংবা কোলাহল পূর্ণ এলাকায় হঠাৎ করেই তাদের মনে হয় এই বুঝি ফোনটি বেজে উঠলো। তাদের মনে হয় তারা ফোনের রিংটোনটি শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে দেখা যায় আসলে কেউই ফোন কিংবা মেসেজ দেয়নি।
অনেক গবেষক এই সমস্যাটিকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বিষয়ক সমস্যা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও ডক্টর রোসেনবার্গ মনে করেন, এই সমস্যার জন্ম আসলে প্রযুক্তির ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে। কম্পিউটার ইন হিউম্যান বিহেভিয়ার নামের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি লেখায় তিনি জানান, খুব বেশি সমস্যা না হলে যাদের ইতিমধ্যে এ ধরনের সমস্যার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের এটা নিয়ে খুব একটা ভাবার প্রয়োজন নেই। তবে এই সমস্যাটি যদি তার প্রতিদিনের জীবনযাপনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে অবশ্যই সেটি চিন্তার বিষয়। তার মতে, প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোন রাখার স্থানটি পরিবর্তন করে এ ধরনের সমস্যা বার বার ঘটা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব ।
এছাড়াও অন্যান্য গবেষকরা এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু উপায় জানিয়েছেন। তাদের মতে, প্রতি ৯০ মিনিট অন্তর অন্তর প্রতিটি স্মার্টফোন কিংবা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারকারীর ১০ মিনিটের একটি বিরতি নেওয়া উচিত। এই ১০ মিনিটের বিরতি তাকে প্রযুক্তিগত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা মুক্ত করবে। এই ১০ মিনিটে করার জন্য একটি তালিকা দিয়েছেন গবেষকরা-
১. এই ১০ মিনিটের জন্য প্রকৃতির কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসুন। যেমন: আপনার কর্মস্থল কিংবা বাসার কাছাকাছি গাছপালা, নদী কিংবা খোলা মাঠ যদি থাকে তবে সেখানে যান। যদি এসব কিছুই না থাকে তবুও ১০ মিনিটের জন্য বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। এই ১০ মিনিট ফোনের দিকে না তাকিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকান।
২. এই ১০ মিনিটে আপনি ছোটখাট একটি মেডিটেশন করে নিন। আপনার মন প্রশান্ত হবে, সেই সাথে দুশ্চিন্তাও দূর হয়ে যাবে।
৩. হালকা কিছু ব্যায়াম করে নিতে পারেন ১০ মিনিটে। এতে শরীরের জড়তা দূর হবে।
৪. যদি উপরের কোনোটিই সম্ভব না হয়, তবে এই ১০ মিনিটে আপনার পছন্দের কোনো গান শুনুন। এক্ষেত্রে রিল্যাক্সিং কোনো গান কিংবা মিউজিকও শুনতে পারেন।
৫. গান শুনতে ভালো না লাগলে নিজেই এই ১০ মিনিটে একটু গান গেয়ে নিন। আপনার গানের গলা ভালো হোক কিংবা খারাপ, তা নিয়ে ভাববেন না। মনে রাখবেন, আপনি কোনো অনুষ্ঠানে অন্যকে শোনানোর জন্য গান গাচ্ছেন না। বরং নিজের ক্লান্তি দূর করার জন্য গান গাচ্ছেন।
৬. হাতের কাছে মজার কোনো কৌতুকের বই রাখুন। এই ১০ মিনিটে দুই-একটি কৌতুক পড়ে ফেলুন। মন ভালো হয়ে যাবে।
এ নিয়মগুলো মেনে চললে ধীরে ধীরে আপনি কমিয়ে আনতে পারবেন আপনার সমস্যা।
ফিচার ইমেজ – rd.com