আমরা সবাই জীবনে একবার হলেও ভুল সিদ্ধান্ত নিই। তবে বুদ্ধিমান মানুষ নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ঘটনাগুলো যাচাই-বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে শিখেন। কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দক্ষতা সাধারণত বিদ্যালয়ে শেখানো হয় না। অথচ জীবনে চলার পথে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগে। বিশ্লেষণ কাজে পটু মানুষ কখনো আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনানির্ভর হয়ে সিদ্ধান্ত নেন না। তার প্রতিটি কাজই হয় পরিস্থিতি এবং সময়োপযোগী। এই একটিমাত্র দক্ষতা সাধারণ আর অসাধারণ মানুষের ভেতর পার্থক্য গড়ে দেয়। কোনো কাজে একজন মানুষ সফল হবে কি না, সেটার পার্থক্যও তৈরি করে বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা।
অ্যানালিটিক্যাল স্কিল বা বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা কী?
কয়েকটি বিষয়কে একসাথে করে বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা তৈরি হয়। এটাকে অন্য ভাষায় ‘সমস্যা সমাধানের দক্ষতা’ নামেও ডাকা যায়। কোনো বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো একত্রিত করা, তারপর সেগুলোকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাই অ্যানালিটিক্যাল স্কিল। অনেকগুলো সক্ষমতার উপর নির্ভর করে বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা যাচাই করা হয়।
১. আন্দাজ করার ক্ষমতা
কোনো ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার পরিপ্রেক্ষিতে কী সিদ্ধান্ত নিলে সেটার সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে, তা আন্দাজ করা দক্ষতার উপর নির্ভর করে। ব্যক্তিগত জীবনে আন্দাজ করার দক্ষতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কর্মজীবনেও আন্দাজ করার সক্ষমতা থাকতে হয়। আন্দাজ করা কেবল কল্পনানির্ভর হলে তা দক্ষতার বদলে একজন মানুষের অদক্ষতার পরিচয় বহন করে। প্রাত্যহিক কোনো ঘটনা ব্যাখ্যা করতে আমরা সাধারণত পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কিন্তু কর্মজীবনে এই কাজের জন্য গ্রাফ, চার্টের সাহায্য নিতে হয়, যেখানে সঠিক তথ্যের সন্নিবেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
২. জটিল চিন্তন দক্ষতা
একজন মানুষ কতটুকু জটিলভাবে চিন্তা করতে পারে সেটা বোঝা যায় পুরো ঘটনাপ্রবাহ জুড়ে সে কতটুকু তথ্যনির্ভর সূত্র থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা থেকে। কথাটি জটিল চিন্তন হলেও অনেকগুলো কাজ কিংবা সমস্যার একটি সহজ সমাধান বের করতে পারাই আসলে মূল কাজ। তাই আবেগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা হয়তো সাময়িক সমাধান বয়ে আনতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটা আপনার জটিল চিন্তন দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাছাড়া আপনার নেয়া সিদ্ধান্ত কতটা টেকসই সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সংখ্যা গণনার দক্ষতা
আপনি পছন্দ করেন আর না করেন, প্রাত্যহিক জীবনে আমাদেরকে গাণিতিক হিসাব মেনেই চলতে হয়। আপনার বাজারসদাই থেকে শুরু করে জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার সময়ও একটু হিসাব কষে নিতে হয়। একটি সিদ্ধান্ত কতটুকু কাজে দেবে সেটা যাচাই করতে হলে একটু হিসাব করতেই হবে। কর্মজীবনেও এগিয়ে যেতে হলে এই হিসাব দিয়েই সব পরিমাপ করতে হবে।
৪. সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
বাস্তব জীবনে কেবল সমস্যা বুঝতে পারলেই চলবে না, সেটা সমাধানের জন্য সময়োপযোগী সমাধানও খু্ঁজে বের করতে জানতে হয়। তাহলেই বলা যাবে আপনার সমস্যা সমাধানের দক্ষতা রয়েছে। এই সমাধান করা নির্ভর করবে আপনার কাজের গুরুত্বের ভিত্তিতে। জীবনে চলার পথে যদি বেশি গুরুত্বের সমস্যাগুলো সমাধান না করে কম গুরুত্বের সমস্যা নিয়ে লেগে থাকেন, তবে সবগুলো মিলেই একটা অগোছালো ফলাফল হাজির হবে। তাই কোনটা আগে আর কোনটা নিয়ে পরে ভাবতে হবে, সেটাও আপনাকে বুঝতে হবে।
৫. বিস্তারিত জানায় মনোযোগ
কোনো ব্যাপারে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন সেটার বিস্তারিত জানতে হয়। জীবনের সবগুলো সমস্যার পুরোপুরি তথ্য আপনি একসাথে না-ও পেতে পারেন। তাই শুধুমাত্র কয়েকটি ঘটনা কিংবা তথ্য যাচাই করে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আপনাকে অপেক্ষা করতে জানতে হবে, প্রাপ্ত তথ্য একটার পর একটা সাজাতে হবে। এই ধৈর্য্য ধরে বিস্তারিত জানার মানসিকতাই আপনার ফলাফল বদলে দেবে। আপনার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণিত করতে এমন একটি দক্ষতা থাকা আবশ্যক।
৬. সম্পদ ব্যবস্থাপনা
বিশ্লেষণমূলক দক্ষতাকে পূর্ণতা দিতে হলে আপনার সম্পদ ব্যবস্থাপনা জানতে হবে। এটা ব্যক্তি এবং জায়গাভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। একেকজন মানুষের কাছে সম্পদের সংজ্ঞা একেকরকম। কেউ সময়কে গুরুত্ব দেন, কারও কাছে তথ্য গুরুত্বপূর্ণ, কিংবা টাকা-পয়সা। সম্পদ যা-ই হোক, সেগুলোর সঠিক উপায়ে ব্যবহার আপনাকে জানতে হবে। তাই সম্পদ থাকলেই যে একজন জীবনে সফল হবেন এমন কোনো গ্যারান্টি নেই।
বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা বাড়াবেন যেভাবে
উপরের বিষয়গুলোর কোনোটি যদি আপনার ভেতর কম থাকে তবে হতাশ হবার কিছু নেই। কারণ এগুলো এমন কিছু সক্ষমতার সন্নিবেশ, যেগুলো চাইলেই শেখা যায়। প্রয়োজন কেবল আগ্রহ আর লেগে থাকার মানসিকতা। একটা সময় আপনিই দেখবেন, আপনার নেয়া সিদ্ধান্তগুলো আরও নিখু্ঁত এবং দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে। তো চলুন, জেনে নিই এমন কিছু উপায়।
১. বেশি বেশি বই পড়ুন
বই পড়ার অভ্যাস যেকোনো প্ল্যাটফর্মে কাজ করার জন্য বাহবার দাবিদার। জ্ঞানের জন্য যেমন বই পড়া উচিত নিয়মিত, তেমনি গল্প-উপন্যাসের জগতে মাঝে মাঝে ডুব দিতে হয়। ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে পারা, জটিল চিন্তন, সূত্র খুঁজে বের করা, এবং গঠনমূলক আন্দাজ করার মতো ছোট ছোট সক্ষমতাগুলো তৈরি হয় একজন মানুষের মাঝে।
সম্ভব হলে মাঝে মাঝে পাঠচক্রে যোগ দিতে পারেন, কিংবা নিজেই আয়োজন করতে পারেন এমন কিছু। নিজেদের ভেতর পড়া জিনিস কিংবা কোনো গল্প নিয়ে আলোচনা করে, গল্পের বিষয়বস্তু এবং মোড়গুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করুন।
২. ব্রেন গেমস্
আমরা অনেকেই সুডোকু মেলানোর খেলায় পারদর্শী। এটা মজার একটি খেলা এবং বিশ্লেষণমূলক দক্ষতা বাড়ানোর ভালো একটি উপায়। পাজল, অ্যাকশনধর্মী গেমসগুলো নিছকই কোনো খেলা নয়, ব্রেন পাওয়ার বাড়াতে এ ধরনের খেলাগুলো খুবই কার্যকরী। পাশাপাশি এগুলো খেলার জন্য আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করে নিতে হবে অল্প সময়ের মাঝে। বাস্তব জীবনে এগুলোর কার্যকরিতা ঠিক কতটুকু সেটা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এটা সত্য যে, অনেকেই নিজের জীবনের সাথে খেলাগুলোর মিল খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছেন।
৩. প্রতিদিন নতুন কিছু শিখুন
আমরা অনেকেই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেই সময় পার করে দিই। বর্তমানে স্মার্টফোন কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমগুলো আমাদের কাছে খুবই সহজলভ্য। তাই এগুলোকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করে শেখার কাজে লাগাতে হবে। আপনার পছন্দের কোনো বিষয় নিয়েই প্রতিদিন অল্প অল্প করে শিখতে পারেন। একটা সময় গিয়ে দেখবেন, আপনি লেগে ছিলেন বলে বিষয়টিতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। উৎসের ব্যাপারেও এখন আর অযুহাত মানায় না। আপনার ইচ্ছে থাকলে কেবল কয়েকটি ক্লিকই যথেষ্ট যেকোনো কিছু শেখার জন্য।
এভাবে প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখার কারণে আপনার ব্রেনের কার্যকারিতা বেড়ে যায়।
৪. টাস্ক মেনেজমেন্ট
প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজগুলো গুরুত্ব নিয়ে শেষ করুন। আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখবেন না। এভাবে যখন নিয়মিত কাজগুলো করে রাখবেন, তখন নিজেই বুঝতে পারবেন কোন কাজটা আগে করতে হবে, আর কোনটা পরে। আর কাজগুলোর একটি লিস্টও তৈরি করে রাখতে পারেন সবসময়। যে কাজটা যখন হয়ে যাবে, তাতে টিক দিয়ে দিবেন।
টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে ঝামেলা! টাকার হিসাব রাখার অ্যাপ ব্যবহার করুন। কাজের বেলায়ও এমন অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। যখন আপনার টাকার হিসাব কিংবা কাজের পর্যালোচনা করতে বসবেন, নিজের বিশ্লেষণ দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।
৫. ডায়েরি লিখুন
অনেকেই প্রতিদিনকার ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে বিরক্তবোধ করেন। আলসেমি করে একদিন লিখে আর লেখেন না, এমন মানুষও কম নয়। ডায়েরি লেখাটা খুব ভালো একটা অভ্যাস। আপনি যদি কোনোদিন পুরনো লেখাগুলো দেখতে বসেন তখন নিজের ভুলগুলো দেখতে পাবেন। কোন ব্যাপারগুলো আপনাকে বিরক্ত করে, কোনগুলো আপনার পছন্দের, আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন- এরকম ব্যাপারগুলো ডায়েরি পর্যালোচনা করেই জানতে পারবেন। তাই ভবিষ্যত করণীয় ঠিক করা সহজ হয়ে যায়।
আমাদের সবার ভেতরেই চমৎকার কিছু করার সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজন কেবল নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জন করা। ক্রমাগত কোনো কাজে লেগে থাকার কারণে আমরা সফলতা পাই। কাজের ভেতর সমন্বয় থাকাও জরুরি একটা ব্যাপার। বিশ্লেষণ করার দক্ষতা সবগুলো কাজের ভেতর সমন্বয় তৈরিতে সহায়ক। আপনার পরবর্তী পদক্ষেপের উপর নির্ভর করে আপনার ভবিষ্যতও নির্ধারিত হয়ে যায়। তাই প্রতিটি পদক্ষেপ হোক নিয়ন্ত্রিত।