নাইজেরিয়া।, আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ। প্রায় ১৭০ মিলিয়ন মানুষের বাস। দারিদ্র্যে এই দেশটির মানুষের জীবন নানা সমস্যায় জর্জরিত। তারপরও তারা সবাই প্রচন্ড রকমের উৎসব প্রিয়। নাইজেরিয়ার রাস্তাগুলো যেন আরও রঙিন। বিভিন্ন গায়ক, অভিনেতা, সার্কাস দল, নাচিয়ে সবাই তাদের কারিশমা দেখানোর জন্য বেছে নেয় রাস্তাগুলোকেই। সাধারণ মানুষজনও তাদের এসব প্রদর্শনী দেখতে ভিড় করে মহা উৎসাহে। তবে তাদের মধ্যে যে দলটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধরনের খেলা প্রদর্শন করে তারা হলো বিখ্যাত দ্য হায়েনা ম্যান বা হায়েনা মানব।
হায়েনা মানবদের কাছে এসব প্রদর্শনী শুধুই কোনো খেলা দেখানো নয়। এটি তাদের কাছে ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে তারা এটাই করে আসছে। হায়েনাসহ আরও ভয়ঙ্কর সব প্রাণী, যেমন- সাপ, হনুমান, বেবুন ইত্যাদি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এই বিদ্যা তারা পুরুষানুক্রমে বহন করে আসছে। শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য এবং পরিবারের কাছের কেউ, যারা তাদের সাথে ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে, তারাই এই বিদ্যা শেখার অধিকার রাখে।
নাইজেরিয়ার অধিকাংশ মানুষের কাছেই হায়েনা মানবেরা এক অপার রহস্যের নাম। এক্ষেত্রে তাদের উদ্ভট ও জনবিচ্ছিন্ন জীবনযাপন পদ্ধতিই দায়ী। জীবিকার জন্য তারা তিন ধরনের কাজ করে থাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় তারা চাষাবাদ করে কাটায়। তাদেরকে কামারের কাজ করতেও দেখা যায় বছরের অন্য একটি সময়ে। তবে তাদের কাছে বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময় হলো খেলা দেখানোর মৌসুম। সেসময়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নাইজেরিয়ার বিভিন্ন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষদের হায়েনা, বেবুন, সাপ ইত্যাদি সব প্রাণী দিয়ে কসরত করে দেখায়। এর ফাঁকে ফাঁকে তারা একধরনের ঔষধ বিক্রি করে যে ঔষধ অলৌকিকভাবে রোগ নিরাময় ক্ষমতাসম্পন্ন বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। এসব ঔষধ ম্যালেরিয়া, পেটের ব্যথাসহ বেশ কিছু অসুখের নিরাময়ে সক্ষম বলে দাবি করে হায়েনা মানবেরা। কয়েকমাস একটানা সার্কাস দেখিয়ে একসময় তারা বাড়ি ফিরে আসে। তাদের এই দীর্ঘ যাত্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে থাকে বেশ কয়েকটি হায়েনা, বেবুন এবং সাপ।
এরকমই একটি দলের প্রধান হায়েনা মানব হলেন মুস্তফা। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, “আমি খুব সহজেই বন্য হায়েনা ধরতে পারি এবং তাদের নিয়ে খেলা দেখাতে পারি। আমাকে আমার বাবা ছোটবেলা থেকে এটাই শিখিয়েছেন। আমার বয়স যখন ১০ বছর, হায়েনাদের সাথে সম্পর্কের শুরুটা সেই তখন থেকেই। এর আগে মাত্র একবারই আমি হায়েনাদের কামড় খেয়েছি। তা-ও এমন কিছু না। নিজেদের তৈরি ওষুধ খেয়েই ক্ষত সেরে গিয়েছিল।”
আমি এই কাজ করতে ভালোবাসি, কারণ এটাই আমাদের উপার্জনের প্রধান মাধ্যম। এই কাজ করেই আমি আমার পরিবার চালাতে পারছি। এই বিদ্যা আমি আমার বাচ্চাদেরকে শিখিয়ে দেব যাতে করে তারা ভালোভাবে বাঁচতে পারে। তারাও তাদের সন্তানদের এটি শেখাবে। এভাবে আমাদের এই কাজ টিকে থাকবে যুগ যুগ ধরে।“
এসব প্রাণীর সাথে একসময় মুস্তফাদের একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। প্রাণীগুলোকে তারা নিজেদের পরিবারের অংশ হিসেবেই গণ্য করে। আফ্রিকার অনেক স্থানেই যেখানে এসব প্রাণীকে অভিশপ্ত বলে মনে করা হয় এবং হত্যা করা হয়, সেখানে মুস্তফাদের মতো হায়েনা মানবেরা তাদেরকে আশ্রয় দেয় এবং পরিবারের সদস্য হিসেবে ঠাই দেয়। তার বদলে হায়েনারা মুস্তফাদের জীবিকা অর্জনের পথ করে দেয়। একেকটি প্রদর্শনী থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে তারা পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেয় এবং প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ কেনে।
তবে এসব বন্য জন্তু এবং মানুষের মধ্যে যে সবসময়ই মধুর সম্পর্ক বিরাজ করে তা-ও না। পরিবারের সদস্যদের মাঝে যেমন কখনো কখনো মনোমালিন্য হয়, তেমনই এসব প্রাণীও মাঝে মাঝে বেঁকে বসে। মুস্তফাদের দলের বেবুন বিশেষজ্ঞ শামাহিলা তার ক্ষতবিক্ষত হাত দেখিয়ে বলেন, “আমি যখন বেবুনগুলোকে প্রশিক্ষণ দিই বা তাদের কোনো ভুল কাজের জন্য শাস্তি দিতে যাই, তখন তারা প্রায়ই রেগে যায় এবং আমার হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।“
হায়েনারাও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসব কারণে অনেকেই এই পেশাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। তবে এ ব্যাপারে ঐ দলের সাপ বিশেষজ্ঞ ইয়াহায়া উদু বলেন, ”সবাই কী বলছে তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না, যেমন যায় আসে না কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না তাতেও। কারণ আমরা খুব ভালো করেই জানি আমরা কী করছি।“
অনেক সময়ই দেখা যায়, অতি সামান্য একটি কাজ বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করে। হায়েনা মানবদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয় যখন তারা নতুন করে খেলা দেখানোর মৌসুম শুরু করতে যায়। যেহেতু দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে, তাই তাদের খুঁটিনাটি নানা বিষয় মাথায় রাখতে হয়। অথচ সামান্য একটি ব্যাপার তাদের প্রতিবারই নাকাল করে ছাড়ে। আর তা হলো যোগাযোগ সমস্যা। এমন নয় যে তারা যেসব জায়গায় শো করে সেসব জায়গায় কোনো গাড়ি-ঘোড়া চলে না। আসলে গাড়ি তো তৈরি হয়েছে মানুষের জন্য, হিংস্র হায়েনাদের জন্য নয়! চালকেরা স্বভাবতই এসব ভয়ঙ্কর প্রাণীর সাথে একই গাড়িতে যাত্রা করতে রাজি থাকে না। অনেক বোঝানোর পর এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে যেসব চালক তা-ও রাজি হয়, তারা সামান্য পথের জন্য চড়া দাম হাকিয়ে বসে। ফলে গাড়ি যোগাড় করা হায়েনা মানবদের জন্য বেশ বিড়ম্বনার একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
হায়েনা মানবেরা যখন শো’র জন্য নতুন কোনো এলাকায় পৌঁছায়, তখন চারদিকে বিশাল সাড়া পড়ে যায়। আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ তাদের একনজর দেখতে ভিড় জমায়। ছোট বাচ্চারা প্রতি মুহূর্ত তাদের পিছু লেগে থাকে। সবার আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হায়েনাগুলো।
নাইজেরিয়ার গ্রামগুলোতে একটি প্রচলিত বিশ্বাস হলো, যদি কেউ কখনো কোনো হায়েনার পিঠে উঠতে পারে, তাহলে সে যাবতীয় জাদুটোনা এবং অশুভ আত্মার হাত থেকে মুক্ত থাকবে। এছাড়াও অনেকে বিশ্বাস করে, হায়েনার পিঠে উঠতে পারলে নারীমহলে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এসব কারণে হায়েনা মানবেরা যখন কোনো এলাকায় তাঁবু গাড়ে, তখন চারপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ নিজে এবং তাদের সন্তানদের হায়েনার পিঠে চড়ানোর জন্য নিয়ে আসে, যাতে তারা সারা জীবন জাদুটোনার হাত থেকে বেঁচে থাকতে পারে।
নতুন কোনো শো শুরু করার আগে হায়েনা মানবেরা তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে নেয়। প্রাণীগুলোর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটায়। তাদেরকে ভালোমন্দ খাবার খাইয়ে নেয়। গুছিয়ে নেয় বিক্রি করার জন্য তৈরি করা ওষুধগুলো। এরপর তারা রংচঙে পোষাক পরে, পায়ে ঝুনঝুনি লাগায়, মানুষ ভয় পায় বলে হায়েনাগুলোর মুখ জালি দিয়ে বেঁধে দেয়, ঢোল, লাঠি ইত্যাদি ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখে নেয়। এ সময় তারা নিজেদের তৈরি একধরনের বিশেষ পানীয় পান করে। কিন্তু এই পানীয় তারা কারো কাছে বিক্রি করে না। তাদের বিশ্বাস, এটা পান করলে খেলা দেখানোর সময় সকল প্রকার দুর্ঘটনা থেকে তারা বেঁচে থাকতে পারবে।
সকল প্রস্তুতি শেষ হলে হায়েনা মানবেরা ঐ এলাকার মূল রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। প্রাণীগুলোকে দেখে ধীরে ধীরে ভিড় জমতে থাকে। যখন আশেপাশে সন্তোষজনক মানুষ জড়ো হয়ে যায়, তখন হায়েনা মানবেরা তাদের চলা থামিয়ে খেলা দেখানো শুরু করে।
যারা হায়েনা নিয়ে খেলা দেখায়, তারা থাকে সকল আকর্ষণের কেন্দ্রে। ঐসব হায়েনা মানবেরা গলায় দড়ি বাঁধা হায়েনাদের একবার দূরে ঠেলে দেয়, পরমূহুর্তেই আবার দড়ি দিয়ে নিজেদের দিকে টান দেয়। এ সময় হায়েনাগুলো তাদের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে ছুটে যায়। তখন তারা দুই হাত দিয়ে হায়েনাটিকে ধরে ফেলে। এভাবে চলতে থাকে। চারপাশের মানুষজন এই দৃশ্য দেখে যেমন অসম্ভব আনন্দিত হয়, তেমনি তাদের মাঝে একধরনের ভয়ও কাজ করে। হায়েনাগুলো হঠাৎ হঠাৎ দর্শকদের খুব কাছে চলে যায়, তখন ভয়ে সবাই অনেক দূর পিছিয়ে যায়। কিন্তু প্রবল উৎসাহে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।
হায়েনা মানবেরা বিভিন্নভাবে খেলা দেখিয়ে থাকে। মুস্তফা বলেন, ”হায়েনা নিয়ে খেলা দেখানোর বিভিন্ন স্টাইল আছে। কখনো কখনো হায়েনাগুলোকে আমি নিজের দিকে এমনভাবে টেনে নিই যেন তারা আমাকে আক্রমণ করছে। আবার কখনো তাদেরকে নিজের পিঠে তুলে নিই এটা দেখানোর জন্য যে, হায়েনাগুলোর চেয়ে আমি শক্তিশালী। তবে আমার মূল লক্ষ্যই থাকে মানুষকে আমাদের ওষুধ কিনতে উৎসাহিত করা।“
অন্য প্রাণীগুলো এ সময় পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকা পালন করে। হায়েনা মানবদের বেবুনটি খেলা দেখানোর সময় জড়ো হওয়া মানুষদের কাছ থেকে টাকা তুলতে থাকে। দলের একজন সদস্য সবার কাছে ওষুধ বিক্রি করতে শুরু করে। আরেকজন সদস্য বিশালাকৃতির একটি সাপ গলায় পেঁচিয়ে বিভিন্ন কসরত দেখাতে থাকে। টাকা সংগ্রহ শেষ হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে খেলা শেষ করে আপন গন্তব্যে ফিরে যায় হায়েনা মানবেরা।
অনেকের মতেই, হায়েনা মানবদের এসব কর্মকান্ড অবৈধ এবং প্রাণীদের প্রতি নির্যাতনের নামান্তর। তবে এটাও ঠিক যে এসব প্রাণীর মধ্যে অনেকগুলোকেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আশ্রয় দেয় হায়েনা মানবেরা। তার বদলে এসব প্রাণী তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের পথ করে দেয়।