ভদ্রলোকের নাম জন গটম্যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকে তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী। এছাড়া তিনি গণিত নিয়েও পড়াশোনা করেছেন এম.আই.টিতে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন ক্যাম্পাসের পাশেই অবস্থিত তার লাভ-ল্যাব বা ভালোবাসার গবেষণাগার। বহু সুখী-অসুখী দম্পতি আসেন, তাদের সম্পর্ককে রাখেন গটম্যানের মাইক্রোস্কোপের নিচে। তিনি কয়েক ঘণ্টা তাদের পর্যবেক্ষণ করেন, এরপর জটিল সব গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করে জানান তাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা এবং কোন কোন বিষয়ে তাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
কিন্তু গাণিতিক হিসাব নিকাশে কীভাবে ভালোবাসা পরিমাপ করা সম্ভব? এছাড়া কয়েক ঘণ্টার পর্যবেক্ষণেই বিয়ের মতো একটি সম্পর্ক নিয়ে সিদ্ধান্তেই বা আসা যায় কীভাবে? বিয়ে একটি জটিল বিষয়। টাকা-পয়সা, যৌনতা, সন্তানাদি, চাকুরী, পরিবার ইত্যাদি নানা বিষয়ের সমন্বয়ে একটি জটিল ব্যবস্থা ঘিরে থাকে বিয়েকে। তাছাড়া দম্পতিদের মানসিকতাও সবসময় একইরকম থাকে না। কোনো দম্পতিকে হয়তো কখনো ভীষণ সুখী দেখা যায়। কিছুদিন পরেই আবার দেখা যায় ভীষণ ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেছে। এর কিছুদিন পরই হয়তো কোথাও বেড়িয়ে এসে আবার তারা নববিবাহিতের মতো আচরণ করতে শুরু করে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, কোনো একটি দম্পতিকে ভালোভাবে জানতে তাদের সাথে যথেষ্ট সময় কাটাতে হবে। তাদের সাথে স্রেফ কথা বলেও বিষয়টা বোঝা মুশকিল, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের সম্পর্ককে নিজেরাই স্পষ্ট বোঝেন না। তাই তাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে সবরকমের পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আনন্দিত, ক্লান্ত, রাগান্বিত, বিরক্ত, সুখী এরকম সব ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করতে হবে। তারপর হয়তো তাদের সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। কিন্তু জন গটম্যান বলেন এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। কয়েক ঘণ্টার পর্যবেক্ষণেই তিনি বুঝতে পারেন, কোনো দম্পতির সম্পর্কের মধ্যে কোন বিষয়টি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
তার ল্যাবে দম্পতিকে তিন ধাপে পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রথম ধাপে দুজন আলাদাভাবে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন এবং বর্তমানে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন। দ্বিতীয় ধাপে কীভাবে তারা পরস্পরের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন তা জিজ্ঞেস করা হয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেখা যায় যে সম্পর্কের প্রথম ধাপে যে প্যাটার্ন দেখা যায় তা পরে সবসময় একটি শক্ত প্রভাব বজায় রাখে। যেসকল দম্পতির সম্পর্ক শুরুর সময়কার সুখস্মৃতি থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরবর্তীকালেও তাদের বন্ধনও দৃঢ় হয়।
এরপর আসে তৃতীয় ধাপের পর্যবেক্ষণ, যেখানে একটি বদ্ধ কক্ষে দুটি চেয়ারে বসানো হয় দুজনকে। বিভিন্ন ইলেকট্রোড ও সেন্সর জুড়ে দেওয়া হবে তাদের হাতে ও কানে। এগুলো দিয়ে পরিমাপ করা হয় তাদের হৃৎকম্পন, ঘাম নিঃসরণ, গায়ের তাপমাত্রা ইত্যাদি। চেয়ারের নিচে বসানো একটি যন্ত্র পরিমাপ করে তারা কতটা নড়াচড়া করছে। আর দুটি ভিডিও ক্যামেরা ধারণ করে তাদের মুখের অভিব্যক্তি। এরপর দুজনকে বলা হয় তাদের বৈবাহিক জীবনে ঝামেলার সৃষ্টি করেছে এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে ।
ধরুন একজন দম্পতি তাদের কুকুরটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। পুরুষ লোকটির কুকুর পছন্দ না, সে কুকুরের বিষয়ে অভিযোগ করলো। মেয়েটির আবার কুকুরটিকে ভীষণ পছন্দ, সে ছেলেটির অভিযোগের জবাব দিল। এভাবে শান্ত তর্ক শুরু হলো। পুরো কথোপকথনে তেমন কোনো রাগারাগি হয়নি, কান্নাকাটি হয়নি, বড়সড় কোনো কিছুই হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা এটি নিয়ে আলোচনা করলো। কখনো আবার তারা সব অভিযোগ ভুলে ঠাট্টা পরিহাস শুরু করলো। এখন এ ভিডিও দেখে আমরা কী বলতে পারবো এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে? তেমন কিছুই না।
কিন্তু জন গটম্যানের কর্মীদের জন্য এ ভিডিওটিই যথেষ্ট। তারা SPAFF (specific affect) নামের একটি কোডিং সিস্টেমের সাহায্যে এ ভিডিওর বিশ্লেষণ করবেন। এ কোডিং সিষ্টেমে বিরক্তি, রাগ, অবজ্ঞা, রক্ষণাত্মক প্রবণতা, নিরপেক্ষতাসহ প্রায় বিশ ধরনের অনুভূতির হিসাব করেন তারা। গটম্যান তার কর্মীদের শিখিয়েছেন, কীভাবে মানুষের চেহারা দেখে তাদের অনুভূতি জানা যায়, কীভাবে তাদের অস্পষ্ট বক্তব্যকে বুঝে নিতে হয় ইত্যাদি।
তারা যখন কোনো দম্পতির ভিডিও বিশ্লেষণ করেন তারা এর প্রত্যেক সেকেন্ডে একটি করে SPAFF কোড যোগ করেন; অর্থাৎ প্রত্যেক সেকেন্ডে তাদের অনুভূতির অবস্থা নির্ণয় করেন। ১৫ মিনিট কথোপকথনের ভিডিও থেকে একজনের নয়শ করে মোট আঠারোশ সেকেন্ড হয়ে যায়। এরপর আসে অন্যান্য তথ্য, কখন তাদের হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছিল, কখন তারা ঘামতে শুরু করেছিল, কখন বেড়ে গিয়েছিল তাদের শরীরের তাপমাত্রা বা কে কতটা নাড়াচাড়া করছিল তাদের আসনে ইত্যাদি।
এরপর তথ্যগুলো একটি জটিল সমীকরণে ব্যবহার করা হয়। এসব হিসাব নিকাশের মাধ্যমে গটম্যানের অর্জন অসামান্য। তিনি যদি কোনো দম্পতির কথোপকথনের এক ঘণ্টার ভিডিও বিশ্লেষণ করেন, তবে তিনি প্রায় ৯৫% নিখুঁতভাবে দম্পতির ডিভোর্স বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হন বলে জানা যায়। পনের মিনিটের ভিডিও বিশ্লেষণে তার সফলতার হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। সেই ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে, প্রায় তিন হাজার দম্পতির ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এ পরিসংখ্যান।
তবে তার এই ‘ভবিষ্যদ্বাণী’র পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক আছে কিছুটা। অনেকের মতে তিনি তার পর্যবেক্ষণ করা কোন দম্পতির ডিভোর্স হবে, কাদের সম্পর্ক টিকে থাকবে এসব নিয়ে আগেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি। পর্যবেক্ষণের কয়েক বছর পর যখন তিনি সেসব দম্পতিদের সম্পর্কের ফলাফল বিষয়ে জেনেছেন, তখন তিনি এ ফলাফলকে তার বিশ্লেষণে পাওয়া সম্পর্কের প্যাটার্নের সাথে তুলনা করে দেখেছেন যে তার পর্যবেক্ষণ কতটা মিলে যায়। তাই এটিকে সত্যিকারের ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায় না। ভবিষ্যদ্বানী না হলেও, বিয়ে নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এটিও যে অসাধারণ সফলতা তাতে সন্দেহ নেই।
এখন দেখা যাক গটম্যানের এ সফলতার নেপথ্যে কারণ কী? জন গটম্যান আসলে দম্পতিদের সম্পর্কের প্যাটার্ন খুঁজে বের করেন। এটি সরাসরি চোখে পড়ে না, তারা যখন প্রত্যেক সেকেন্ডে দম্পতিদের অনুভূতির বিশ্লেষণ চালান, তখনই তাদের চোখে পড়ে তাদের অনুভূতির আসল রূপ। হয়তো সাধারণভাবে দেখা যাবে দুজন স্বামী-স্ত্রী শান্তভাবে কথা বলছে, তর্ক করছে, একজন আরেকজনের সাথে ঠাট্টা-পরিহাসও করছে। কিন্তু জন গটম্যান হয়তো দেখতে পাবেন যে, স্ত্রী তার কথাবার্তায় সবসময় অনড়। অথবা হয়তো দেখা যাবে স্বামী স্ত্রীকে তার প্রাপ্য কৃতিত্ব দিচ্ছে না। কিংবা স্ত্রী নিন্দা করে চলছে স্বামীর যেকোনো কাজের এবং বেচারা রক্ষণাত্মকভাবে সে সমালোচনা সামলাচ্ছে। সাদা চোখে এরকম অনেক বিষয়কেই ইতিবাচক মনে হবে, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নেতিবাচক।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের এ প্যাটার্নগুলো সহজাতভাবে, তাদের অবচেতন মনের যোগসাজশে তৈরি হয়। তারা কেউ সচেতনভাবে এটি তৈরি করতে চায় না। এজন্যেই এ প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ। গটম্যানের দল আসলে এ ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনুভূতির অনুপাত বের করেন। সেখান থেকে তাদের অনুভূতির উত্থান-পতনের গ্রাফ দেখতে দেখতে তিনি বুঝতে পারেন আসলে কোনদিকে যাচ্ছে এটি। গটম্যানের মতে দম্পতিরা তাদের সম্পর্কে যেকোনো দুটি অবস্থার একটিতে থাকে, ইতিবাচক অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত অথবা নেতিবাচক অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত।
স্বামী-স্ত্রীর কোনো একজন কোনো একটা খারাপ কাজ করে বসতেই পারে। সেরকম কিছু করলে, যদি সে দম্পতির সম্পর্ক ইতিবাচক অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত থাকে তখন অন্যজন তার পক্ষে থাকবে। হয়তো বলবে ‘তার আসলে মন ভালো নেই, তাই অমনটা বলেছে।’ কিন্তু যদি নেতিবাচক অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত থাকে তবে আরেকজন সেই বাজে কাজটির সূত্র ধরে বিষয়টিকে আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে। গটম্যানের মতে কোনো দম্পতির সম্পর্ক একবার নেতিবাচক দিকে যেতে থাকলে, প্রায় ৯৪ শতাংশের ক্ষেত্রে এতে নেতিবাচকতা আরো বাড়তেই থাকে।
জন গটম্যান তার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন যা কোনো সম্পর্কে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ চারটি হলো- পরস্পরের নিন্দা করা, অন্যের মতামতকে এড়িয়ে যাওয়া, কোনো একজনের রক্ষণাত্মক প্রবণতা ও অন্যকে অবজ্ঞা করা। এরমধ্যে অবজ্ঞা করা বিষয়টি সবচেয়ে ক্ষতিকর। কোনো দম্পতির মধ্যে একজন যখন নিজেকে অন্যজনের তুলনায় উচ্চতর (সুপিরিয়র) ভাবতে শুরু করে তখনই অবজ্ঞা চলে আসে। দুজনই পরস্পরকে সমান যোগ্য না ভাবতে পারলে এটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবে অনুভূতির হিসাব নিকাশ করে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করাটা অভিনব এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণেই জন গটম্যান বিশ্ববাসীর নজরে কেড়েছেন। তার বই বেস্টসেলার হয়েছে, পৃথিবীর বিখ্যাত সব মিডিয়ায় তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে সবাই যে এ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন এমনটি নয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন মানুষের মনের অবস্থার পরিবর্তনের এরকম গাণিতিক হিসেব নিকেশ করার যৌক্তিকতা নিয়ে। মানুষের মন কি আসলেই এমন গাণিতিক পরিসংখ্যান মেনে চলে?
তথ্যসূত্র
Blink: The Power of Thinking Without Thinking (2005) by Malcolm gladwell
ফিচার ইমেজ- vimeo.com