দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, আতঙ্ক ইত্যাদির সমাধানে প্রায়ই মাইন্ডফুলনেসকে চিকিৎসার মাধ্যম হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজ পন্থাগুলোর মাঝে রয়েছে মাইন্ডফুল ব্রিদিং এবং মাইন্ডফুল বডি অ্যাওয়ারনেস।
মাইন্ডফুল ব্রিদিং পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগী হতে হয়। শ্বাস গ্রহণের সময় নাকের ভেতর দিয়ে প্রবেশকৃত বাতাসের শীতলতা, বুক, পেট বা তলপেটের ফুলে উঠা এবং শ্বাস ছেড়ে দেওয়ার সময় নাক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বাতাসের উষ্ণতা এবং বুক, পেট কিংবা তলপেটের নিচে নেমে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা শুধু সেটির উপরেই গভীরভাবে মনোযোগ প্রদান করা হয় মাইন্ডফুল ব্রিদিং পদ্ধতিতে।
অন্যদিকে বডি অ্যাওয়ারনেস প্রক্রিয়ায় মূল কথা হলো শারীরিক অনুভূতির নন জাজমেন্টাল এক্সপেরিয়েন্সিং। অর্থাৎ নীরব কোনো জায়গায় শুয়ে অথবা বসে শরীরের কোথায় কী অনুভূত হচ্ছে সেটাকে শুধু খেয়াল করে যাওয়া। মাথার চুল থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পায়ের পাতা পর্যন্ত অগ্রসর হতে হতে প্রতিটি স্থানে কীরকম অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে সেটির প্রতি কোনোরকম বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ না করে শুধু খেয়াল করে যাওয়া। কোথাও শিরশির লাগতে পারে, কোথাও চুলকাতে পারে, হাতে সামান্য ব্যথা হতে পারে, পায়ে হালকা টান লাগতে পারে, মাথার চুলে বাতাস খেলে যেতে পারে। এসবের প্রতিটিই শুধু লক্ষ্য করে যেতে হবে, কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখানো ছাড়াই।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনের প্রাথমিক উপকারিতা হলো বর্তমানে বাস করতে শেখা। অতীতে কী হয়েছিল, কিংবা ভবিষ্যতে কী হতে পারে— সেই পাহাড়সম অনুভূতি থেকে তাৎক্ষণিক এই মুহূর্তে কী হচ্ছে সেদিকে নিজের চিন্তাকে সরিয়ে নিয়ে আসা। গত প্রায় এক দশক ধরে মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে উর্ধ্বমুখী। তবে সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
২০১৯ সালে নিয়মিত মেডিটেটরদের মাঝে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। একাধিক মহাদেশ থেকে ১৩২২ জন স্বেচ্ছাসেবী এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ২৫.৬% অর্থাৎ ৩১৫ জন উল্লেখ করেন যে, মেডিটেশনকালে অথবা মেডিটেশন পরবর্তী সময়ে তারা নেতিবাচক বিভিন্ন অনুভূতির সম্মুখীন হয়েছেন। এবং তারা প্রত্যেকে এই ধারণাও পোষণ করেছেন যে, অনুভূত নানা ধরনের নেতিবাচক আবেগ-অনুভূতির উৎস মূলত মেডিটেশন। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই (৫৩.৬%, ৬০০ জন) ছিলেন নারী, অধিকাংশই নিজেদের (৬১.৪%, ৭৫৬ জন) ধার্মিক বলে উল্লেখ করেছেন, এবং অধিকাংশেরই (৭৩.০%, ৮৯৯ জন) অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন হয়েছিল। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ৩১৫ জনের উল্লেখকৃত নেতিবাচক অনুভূতিগুলোর মাঝে ছিল দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অস্থিরতা, নেতিবাচক চিন্তা, ভয় ইত্যাদি।
মেডিটেশনের বেশ কিছু রকমভেদ আছে- ডিকন্সট্রাক্টিভ, নন-ডিকন্সট্রাক্টিভ, অ্যাটেনশনাল ইত্যাদি। একদম অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে এগুলোর প্রতিটিই মূলত মেডিটেটরদের বর্তমান মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে শেখায়। বর্তমানে বাস করেও চিন্তার জগতে মানুষ যখন অতীতের কোনো ঘটনার দ্বারা তাড়িত হয়, কিংবা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে উঠে, ঠিক সেই জায়গাটিতেই মাইন্ডফুলনেস চর্চার মাধ্যমে অতীত কিংবা ভবিষ্যতের অযাচিত অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসা যায়।
অতীতে যা ঘটেছে তা কিন্তু ঘটেই গেছে। ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা অথবা দুর্ঘটনাকে পালটে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। আবার ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন কোনো আশঙ্কা সত্যি নাও হতে পারে। এই দুই সময়, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই— সেখান থেকে যে সময়টাতে মানুষ বাঁচে, যে বাস্তবতায় তার অস্তিত্ব বিদ্যমান, সেটিকে স্বীকার করে নেওয়ার (acknowledge) মাধ্যমে মস্তিষ্কের প্রভূত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। মেডিটেটরদের মস্তিষ্কের স্ক্যানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের মস্তিষ্কের ইনসুলা কর্টেক্স স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। মস্তিষ্কের ইনসুলা কর্টেক্স অংশটি শারীরবৃত্তিক অনুভূতি এবং আবেগ প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে সম্পর্কিত।
মাইন্ডফুলনেস চর্চার একটি পদ্ধতি হলো শারীরবৃত্তীয় সচেতনতাবোধ। অর্থাৎ মাইন্ডফুলনেস চর্চাকালে নিজের শরীরের প্রতিটি স্থানে কখন কীরকম সাড়া পাওয়া যাচ্ছে সেটির প্রতি মনোযোগী হওয়া। এর মাধ্যমে মেডিটেটর তার শরীরে চলমান বিভিন্ন স্নায়বিক প্রক্রিয়ার (emotions) ফলে সৃষ্ট অনুভূতিসমূহের (feeling) প্রতি আরও বেশি সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারেন, ভালো অনুধাবন করতে পারেন। অনুভূতির বিভিন্নতার মাঝে মেডিটেটর সুস্পষ্ট ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্য করতে পারেন। ধীরে ধীরে এই দক্ষতাটি আয়ত্ত করতে পারা মেডিটেটরকে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে পারদর্শী করে তোলে। তবে মেডিটেশনের যে একটি অত্যানুকূল মাত্রা আছে সেটি অতিক্রম করে গেলে তখন সেটি হিতে বিপরীত হয়ে যায় অনেকের জন্য।
আরেক দল মেডিটেটরদের মাঝে ভিন্ন কিছুর নিদর্শন মিলেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেডিটেশন মস্তিষ্কের ডরসোল্যাটেরাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে যেটি আবার মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম এবং অ্যামিগডালাকে প্রভাবিত করে। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে প্রক্রিয়াজাত করতে অ্যামিগডালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক উপায়ে এবং পরিমিত পরিমাণে মেডিটেশন লিম্বিক সিস্টেমের উপর ডরসোল্যাটেরাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের নিয়ন্ত্রণকে ভারসাম্যে রাখে। ফলাফল হিসেবে মানুষের মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং আবেগের প্রতি তার প্রতিক্রিয়াকে সে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সীমা অতিক্রম করে গেলেই অ্যামিগডালার এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় যার কারণে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক সকল অনুভূতিই সম্পূর্ণভাবে এলোমেলো হয়ে যায়। তখন এসব মেডিটেটররা কোনো চূড়ান্ত অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। কোনো কিছুই তাদের বিচলিত করে না। না তারা অত্যন্ত খুশি হয় কোনো কিছুতে, না তারা মারাত্মকভাবে বিমর্ষ হয়ে যায় কোনো পরিস্থিতিতে।
ঘুম আনার ক্ষেত্রে মেডিটেশন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাহায্য করলেও বিপরীত ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। একটি মাইন্ডফুলনেস কোর্স প্রস্তুত করা হয়েছিল যার ব্যপ্তি ছিল ৮ সপ্তাহ। ৮ সপ্তাহব্যাপী এই কোর্সে প্রতি সপ্তাহে ৫ দিনের প্রতিদিন যারা অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য মেডিটেশন করেছিলেন তারা সকলেই ঘুমের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। অন্যদিকে একই কোর্সে যারা তুলনামূলকভাবে কম সময়ের জন্য মেডিটেশন করেছিলেন তাদের ঘুমের সময় এবং মান উভয়ই ছিল ইতিবাচক। মনোযোগ বৃদ্ধিকারী বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন- ক্যাফেইন, কোকেইন, এবং রিট্যালিন মূলত মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে কিছু সময়ের জন্য। এসবের প্রভাবে মানুষের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট সময়, যতক্ষণ ওষুধ বা রাসায়নিক দ্রব্যের কার্যকারিতা বজায় থাকে, তখন পর্যন্ত অত্যধিক পরিমাণে সতর্ক এবং মনোযোগী হয়ে ওঠে।
একইভাবে কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে মেডিটেশনও একই ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম মানুষের মস্তিষ্কে। পরিমিত মাত্রার চেয়ে বেশি মেডিটেশনের কারণে যখনই মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সজাগ, সতর্ক হয়ে ওঠে তখন মস্তিষ্কের দায়িত্ব বেড়ে যায়, সে নানান বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ঘুমের জন্য মস্তিষ্কের যে আরামদায়ক অবস্থা দরকার হয় সেটি সে পায় না। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ তখন ঘুমাতে পারে না।
কিছুদিন আগেও মেডিটেশন নিয়ে প্রকৃতপক্ষে একচেটিয়া ধারণা ছিল সকলের। তবে বর্তমানে মেডিটেশনের কারণে উদ্ভূত নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। গবেষকরা এখনও এক বাক্যে একে অকার্যকর, ক্ষতিকর বলেননি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সমস্যা সমাধানে মেডিটেশন কতটা কার্যকর এবং নেতিবাচক প্রভাব ব্যতীত কীভাবে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাবে সেটিই এখন গবেষণার বিষয়।