আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। গবেষকরা দেখিয়েছে যে, এই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মস্তিষ্ক ক্রিয়াকলাপকে অভ্যাসে রূপান্তরিত করে। এমনকি একটি জটিল কাজ, যেটি সবচাইতে বেশি একাগ্রতার দাবী রাখে, সেটিও এক সময় নিরুদ্যম অভ্যাসে পরিণত হয়। যেমন, একজন দক্ষ এবং নিয়মিত সাইক্লিস্ট সাইকেল চালানোর সময় অন্য কোনো যানবাহনের সাথে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ব্রেক কষে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে সেটি থামিয়ে দেয় কোনোপ্রকার একাগ্রতা ছাড়াই। এটি সম্ভব হয়েছে অনেক সময় ধরে সাইকেল চালানোর জন্যই। অর্থাৎ সাইকেল চালানোটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে কোনো নতুন, শিক্ষানবিশ সাইক্লিস্টের বেলায় কিন্তু এমনটা ঘটবে না। তারা সবসময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করবে এবং প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রস্তুত থাকবে। গবেষণা অনুযায়ী, প্রত্যেকদিন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা অসচেতন অবস্থায় অভ্যাসের উপর নির্ভর করে থাকি।
অভ্যাসগুলোকে ভাগ করা যায় তিন ভাগে
প্রথমত, বাহ্যিক সূত্র নির্ভর অভ্যাস, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু ঘটার সাথে সাথেই আশেপাশের দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যমান, কিন্তু অনুভব করা যায় এমন কাজের ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেমন ধরুন, যখন আপনার অ্যালার্ম ঘড়িটি বাজতে থাকে, তখন আপনার মস্তিষ্কে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে এমন কিছু ঘটে, যা ঐ অবস্থায় আপনাকে জুতসই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, রুটিন নির্ভর অভ্যাস, অর্থাৎ নির্দিষ্ট অবস্থায় অথবা নির্দিষ্ট সময়ে যে সকল নির্দিষ্ট কাজ আপনি নিয়মিত করে থাকেন, সেগুলোই রুটিন নির্ভর অভ্যাসের আওতাধীন। প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা রুটিন নির্ভর অভ্যাসের একটি উদাহরণ হতে পারে।
এবং তৃতীয়ত, কোনো কিছুর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তৈরি হওয়া অভ্যাস। অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার পর তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে পানি কিংবা মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কেননা আমরা বেশ ছোটকাল থেকেই প্রমাণ পেয়ে আসছি মিষ্টি অথবা পানিই ঝাল থেকে আমাদের পরিত্রাণ দিবে। আর মজার বিষয় হচ্ছে এখানে বাহ্যিক সূত্র এবং রুটিন নির্ভর দুটি অভ্যাসেরই প্রভাব রয়েছে।
অভ্যাসগুলো বেশ স্থিতিস্থাপক
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রচণ্ড ক্ষতি হওয়ার ফলে মানুষ নিজের নাম, বাসস্থান, এমনকি আত্মীয়-স্বজনের কথাও ভুলে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের পুরনো অভ্যাসগুলো মেনে চলে, নতুন সব অভ্যাসের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। কারণ কোনোকিছু শেখার পর সেটিকে অভ্যাস হিসেবে বজায় রাখার পুরো ব্যাপারটি ঘটে মস্তিষ্কের বাসাল গ্যাংলিয়া (Basal ganglia) নামক অংশে।
দুর্ভাগ্যবশত, এই স্থিতিস্থাপকতার মানে হচ্ছে, এমনকি আপনি যদি সিগারেট খাওয়ার মতো কোনো খারাপ অভ্যাস ছেড়েও দেন, যেকোন সময় তার পুনঃপাতিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
খারাপ অভ্যাসগুলো সৃষ্টি করে আকাঙ্ক্ষার
কল্পনা করুন, দীর্ঘ এক বছর ধরে কাজের জায়গার কাছে অবস্থিত ক্যাফেটেরিয়া থেকে প্রত্যেকদিন বিকেলে আপনি চকলেটে ভরপুর, মজাদার একটি কাপ কেক খেয়ে আসছেন। এটাকে সাধারণভাবে নিজেকে নিজের কাজের জন্য দেয়া উপহার ধরতে পারেন।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আপনার সহকর্মীরা বললো আপনি দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছেন। তাই আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাপ কেক খাওয়ার অভ্যাস থেকে দূরে থাকবেন। কিন্তু ভাবুন একবার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রথম দিন ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে বিকেলে যাওয়ার সময় আপনার অনুভূতি কেমন হবে? হয়তো আপনি শেষবারের মতো আরেকটি কেক খেয়ে যাবেন, নয়তো গোমড়ামুখ করে বাড়ি চলে যাবেন।
পশু-পাখিদের উপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, তারা যখন কোনো একটি অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তাদের মস্তিষ্ক ঐ নির্দিষ্ট অভ্যাসটির জন্য প্রতিদান প্রত্যাশা শুরু করে। কিন্তু যদি প্রতিদান দেয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করে দেওয়া হয়, তাহলে তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নিজেদের কাজের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে।
প্রতিদানের প্রত্যাশা ভালো অভ্যাসের ব্যাপারেও সমানভাবে কাজ করে
যারা অভ্যাসগতভাবে ব্যায়াম করে, তারা প্রত্যেকে ব্যায়াম থেকে নির্দিষ্ট কিছু চায়। কেউ হয়তো অতিরিক্ত ওজন কমানোর ব্যাপারে আগ্রহী, কারো আগ্রহ হয়তো শরীরকে আরো বেশি শক্তিশালী করার ব্যাপারে, কেউ কেউ শুধু সার্বিক সুস্থতার জন্যই ব্যায়াম করে থাকে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, ব্যায়ামের ব্যাপারটি যখনই আসে, তখন তাদের মস্তিষ্কে এন্ডরফিন (Endorphin) প্রবাহিত হতে থাকে। যেটি মস্তিষ্কে কাজটি সম্পাদন করার চেতনা যোগায়।
অভ্যাস বাতিল নয়, কেবল বদলই সম্ভব
অর্থাৎ আপনি চাইলেই আপনার মাঝে গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। শুধু সেগুলো পরিবর্তন করতে পারবেন। যদিও এতে আকাঙ্ক্ষা, কোনো কিছুর জন্য প্রতিদান প্রত্যাশার ব্যাপারগুলো একই থাকবে।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই পদ্ধতিটি বেশ প্রভাবের সাথেই কোনো অভ্যাস পরিবর্তনে সাহায্য করে। এটি অবলম্বন করে অ্যালকোহলিক অ্যানোনিমাস (Alcoholic Anonymous) নামের একটি সংস্থা প্রায় দশ মিলিয়ন মদ্যপ ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। সংস্থাটি মদ্যপ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রথমে জানতে চায়, কেন তারা অতিরিক্ত মদ পানের ব্যাপারে আগ্রহী। কারণগুলো চিহ্নিত করার পর তারা ঐ ব্যক্তির জন্য নতুন রুটিন তৈরি করেন। যেমন- ধরুন, কোনো মদ্যপ ব্যক্তি চিত্তবিনোদনের জন্য মদ পান করে। তাদের জন্য সংস্থাটি এমন একটি রুটিন করে যা পুরোপুরি মদ্যপানের বিপরীত, কিন্তু আসক্ত ব্যক্তিকে তার কাঙ্ক্ষিত বিনোদন দিয়ে থাকে।
বড় অর্জনের জন্য ছোট ছোট অভ্যাস তৈরি করুন
চার্লস এটলাসের সুন্দর একটি কথা আছে, “Step by step and the thing is done”, অর্থাৎ, একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই কোনো কাজ সম্পাদন করা সম্ভব। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। বড় অর্জনের জন্য প্রয়োজন ছোট ছোট ভালো অভ্যাস তৈরি করা, অথবা খারাপ অভ্যাসগুলোকে প্রয়োজনীয় অভ্যাসে রূপান্তর করা। সময় সীমিত, তাই আপনি চাইলেই আপনার সব রকমের কাজ করে যেতে পারবেন না। কিন্তু কম প্রয়োজনীয়, প্রয়োজনহীন অভ্যাসগুলোকে প্রয়োজনীয় কাজে রূপান্তর করতে পারবেন। আপনার লক্ষ্য, কাঙ্ক্ষিত অর্জনের জন্য এটি বেশ প্রয়োজনীয়।
অভ্যাস তৈরি বা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি
উদাহরণ হিসেবে ধরুন, আপনি মাস চারেক পরে একটি ম্যারাথনে যোগ দিতে আগ্রহী। এজন্য আপনার প্রয়োজন নিয়মিত দৌড়ানো, অল্প অল্প করে ইভেন্টের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। বেশ রাত পর্যন্ত মুভি দেখে, গান শুনে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় দেওয়ার কারণে আপনি ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। সারাদিন বিভিন্ন কাজ থাকায় অন্য কোনো সময় দৌড়ানোর সুযোগ হয় না। তো আপনি চাইলেই শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে প্র্যাকটিস করে ইভেন্টটিতে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি ম্যারাথনে কাঙ্ক্ষিত বড় কোনো অর্জনের জন্য দৌড়াতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে প্র্যাকটিস সেশনটিতে অনেক আগে থেকে সময় দিতে হবে। এজন্য আপনাকে অবশ্যই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। মুভি দেখা, গান শোনা কিংবা ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের মতো কাজগুলোকে এড়িয়ে চলে ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে ভোরে উঠার ব্যাপারটিতে মনোযোগী হতে হবে। নিয়মিত একই কাজ করার ফলে দেখবেন দিন কয়েক পরে এটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে; আপনার খারাপ, অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসগুলোর স্থান দখল করে বসে আছে।
কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের অভ্যাস চিহ্নিত করে মার্কেটিং করে থাকে
পণ্য প্রস্ততকারক কোম্পানি থেকে শুরু করে সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোও ভোক্তাদের অভ্যাস চিহ্নিত করার মাধ্যমে তাদের সেবা অথবা পণ্যগুলো প্রস্তুত করে থাকে। বর্তমানে গিফট শপগুলোতে ঢু মারলেই দেখা যায় মার্ভেল, ডিসি কমিকের সুপার হিরো, মিনিয়ন কিংবা গেইম অফ থ্রোনসের প্লেকার্ড, স্টিকার ও পুতুলে ভরা। ট্যুরিজম কোম্পানিগুলো কক্সবাজার, কুয়াকাটার মতো বিখ্যাত জায়গাগুলোর সাথে আজকাল যোগ করেছে বান্দরবনের গহীনে যাওয়ার মতো ইভেন্ট। কেননা এখন এগুলোর হাওয়াই বইছে। এসব মুভি, টিভি সিরিজে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এই সুযোগটাই কোম্পানিগুলো নিচ্ছে। অর্থাৎ আপনার অভ্যাসগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে তারা বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি তৈরি করছে।