সফলতা শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণভাবেই ঘটতে পারে, কেননা এর ভিতটা গাড়া রয়েছে আবেগ-অনুভূতির মধ্যে। সবচাইতে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে আপনার নিজের সাথে সম্পর্কটাই ‘সফলতা’। অধিকাংশ মানুষই মিথ্যের সাথে বসবাস করছে। তারা জেনেশুনে নিজেকেই এড়িয়ে চলে এবং মনের খুব গভীর থেকে যা চায়, তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে।
অনেকেই নিজের জন্য অনেককিছু চায়। তাদের অনেক স্বপ্ন এবং লক্ষ্য থাকে। যদিও খুব কম মানুষই যা চায়, তা পেয়ে থাকে। শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়াই যথেষ্ট নয়, এর চাইতেও বেশি প্রয়োজন সংকল্পবদ্ধ হবার। নিজের স্বপ্নের প্রতি দায়বোধ থেকেই সফলতার সম্ভাবনা আসে। যখন আপনি কোনোকিছুর প্রতি দায়বোধ অনুভব করবেন, তখন তাতে সফলতা অর্জনের জন্য যা হওয়া এবং করা উচিত, আপনার চেষ্টার মধ্য দিয়ে তা অর্জিত হবে। তখন আপনি শুধু চিন্তা-ভাবনা এবং আকাশকুসুম স্বপ্ন বোনা ছেড়ে দিয়ে সত্যিকার একটি রূপ দিতে সচেষ্ট হবেন। লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া নয়, বরং শিক্ষা গ্রহণ শুরু হবে। আপনি নিজেকে যুক্ত করবেন, আপনি বারবার ব্যর্থ হবেন। আর ব্যর্থতা সফলতার ভিত্তি, কে না জানে?
আপনি যা সত্যি সত্যি চান, এক এক করে তা অর্জন করে নিন, নয়তো আপনার উচ্চাকাঙ্খার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে! নিজের মধ্য থেকে কিছু দক্ষতা বের করে আনুন যাতে আপনার ভেতরকার লক্ষ্য, নীতি এবং মূল্যবোধকেই প্রতিফলিত করে।
আপনি যদি বিবাহবন্ধনে স্বেচ্ছায় দায়বদ্ধ হয়ে থাকেন, এতে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আপনি যাবেন। আপনি তা-ই করবেন যাতে এটি একটি সফল বন্ধনে রূপ নেয় ও টিকে থাকে। শিল্পীর মন যদি শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করে, তবে এর স্বার্থে নিজেকে ঝালিয়ে নেয়া এবং সফলভাবে সৃষ্টি করতে যা যা লাগে, তা-ই করবেন তিনি। নিজের আকাঙ্ক্ষার সীমা নিজেই অতিক্রম করতে হয়। এই দায়বোধ আপনার কাছে কোনো মানসিক সীমাবদ্ধতা মনে হবে না, এবং তা নয়ও। সব সীমারেখা বদলে যাবে শুধু এই জোরালো আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণের জন্য। সব সীমানা দূরে সরে যাবে যাতে তারা আপনাকে রুখতে না পারে!
যারা নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে শুধু একটি ‘ইচ্ছা’ বানিয়ে না রেখে তার প্রতি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবে এবং যথেষ্ট দায়বোধ রাখবে, তারাই চূড়ান্তভাবে তা অর্জন করতে পারবে। জীবনের অন্যান্য দিক, সুখ, স্বস্তিও হয়তো ত্যাগ করতে হয় এই তাগিদগুলো পূরণের জন্য। কিন্তু তারপরও ‘সফলতা’ এমনই একটি প্রাপ্তি, যার জন্য হাসিমুখে ছেড়ে দিতে হয় অনেককিছুই।
আজকে খুব করে আপনি যা চাইছেন, তা পাবার জন্য কিন্তু আপনাকে আজকের অনেককিছুই বদলাতে হতে পারে। আর যদি সেই বদলানোর ভারটুকু আপনি নিয়ে না পারেন, তবে হয়তো বর্তমানে যা কিছু আছে বা যেমনটি আছে তা থেকে পরিবর্তন কিংবা উত্থানের আশা করাটা অসঙ্গত। পরিবর্তনে যদি বিশ্বাস না রাখেন, তবে হয়তো আকাঙ্ক্ষা থেকে সফলতার পথে যাত্রাটাও রয়ে যাবে স্থির পথের বিন্দুতে। দেখবে না আর নতুন কোনো গন্তব্য। জীবন যা দিয়েছে, তার চাইতেও বেশি কিছু যদি কেউ পেতে চায়, তবে তাকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার মতো কিছু নিজের তাগিদেই করতে হবে। গন্তব্যে পৌঁছুনোর জন্য পথ বেছে নেয়া এবং সেই পথে চলার সিদ্ধান্তও জীবনের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না।
অপরিবর্তনের ভ্রান্ত ধারণাটি কতদিন টিকে থাকে?
“কোটি কোটি অর্থের জন্য কোটিপতি হবেন না, কোটিপতি হতে আপনাকে যে চেষ্টাটুকু করতে হয়, তা অর্জনের জন্য হবেন” – জিম রন
জীবন আপনার প্রতিচ্ছবি। যদি জীবনটাকে পরিবর্তনই করতে হয়, তবে নিজেকে পরিবর্তন করাটা অনিবার্য। কোনো পরিবর্তন আনতে হলে, সিঁড়ির শুরু ধাপের সেই পরিবর্তনটি নিজেকেই হতে হয়। পরিবর্তন আনুন, তার আগে সে অনুযায়ী পরিবর্তিত হন। কোটিপতি হতে গেলে নিজেকে তা হবার যোগ্য ও সমর্থ করে তুলতে হবে। আপনার ভেতরের কোন দক্ষতা সেই পথে ইন্ধন যোগাতে পারে, তা খুঁজে বের করতে হবে, তাকে শাণিয়ে তুলতে হবে আসন্ন যুদ্ধের জন্য, সাফল্য যাত্রার উদ্দেশ্যে। কারো সাথে সুস্থ সম্পর্ক চাইলে, সেই সম্পর্কে আপনার যে ভূমিকা তা পালন করতে নিজের সবটুকু চেষ্টা দিন। অপরের কাছ থেকে সম্পর্কে বিশ্বস্ততা, সুস্থতা আশা করলে আপনাকে তা প্রথমেই নিজের মধ্যে আনতে হবে।
একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব শুধু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে না। তার চারপাশের মানুষজন, প্রকৃতি ও পরিবেশ সবকিছুই ভূমিকা রাখে ‘ব্যক্তিত্ব’ গড়ে তোলার যাত্রায়।
নিজের স্বাতন্ত্র্যের উপর অতি-বিশ্বাস অনেক স্বাভাবিক একটি বিষয়। স্বাতন্ত্র্য বলতে নিজেকে শুধু নিজের মাধ্যমেই গড়া এবং তাতে আশেপাশের কোনোকিছুর বিন্দুমাত্র আঁচ না লাগাকে যদি বোঝানো হয়, তবে তা নিশ্চিতভাবেই একটি ভ্রান্ত ধারণা। স্বাতন্ত্র্য তার শুদ্ধতম রূপে এসেও অপরিবর্তিত থাকে না।
“মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়, সকালে-বকালে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়”।
কেন? কারণ তার চারপাশ বদলায়। মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবার প্রতিটি বাহ্যিক নিয়ামক বদলায় এবং তার ছাপ এসে পড়ে মানুষের মধ্যে। তাই স্বাতন্ত্র্যের সংজ্ঞাও পাল্টায়। কেউ কোনোভাবেই চিরন্তন রূপে থাকে না, আসলে ‘চিরন্তন রূপ’ ব্যাপারটি একটি মিথ, তা কারুর ভেতরেরই হোক অথবা বাইরেরই হোক!
সত্য এই যে আপনি প্রতিদিন বদলাচ্ছেন। আপনার মস্তিষ্ক এবং শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-কোষ সব বদলাচ্ছে। আর পৃথিবীর প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি? তা-ও নিত্যনতুন তথ্যে বোঝাই হচ্ছে, কিছু বাদ যাচ্ছে তো কিছু তৈরি হচ্ছে। অবিরতভাবে তথ্যের আদান-প্রদান ঘটছে আপনার মনে।
যখন কোনো সমগ্র বস্তুর যেকোনো একটি অংশ পরিবর্তন করা হয়, তার প্রভাব পুরো বস্তুতেই লক্ষণীয়। অর্থাৎ একটি ছোট পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বস্তুই পরিবর্তিত হয়। বাটারফ্লাই ইফেক্ট বলে, পৃথিবীতে একটি প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর ফলে হয়ে যেতে পারে সুদূরে থাকা তীরে কোনো ঘূর্ণিঝড়! ঠিক তেমনি এটিও ঘটে। নতুন লোকজনের সাথে দেখা হওয়া, নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, নতুন কিছু শেখা- এসব কিছু আপনাকে করে দেয় নতুন একটি মানুষ! কিন্তু বাস্তবজীবনে এগুলো এতোই ধীরে ধীরে ঘটে যে তা হঠাৎ করে আপনি বুঝতে পারেন না। হয়তো যার সাথে আপনার অনেকদিন দেখা হয়নি অথচ সে আপনাকে একটা সময় খুব ভালো করে চিনতো-জানতো, তার কাছে সহজেই ধরা পড়বে পরিবর্তনগুলো।
তারপরও মস্তিষ্ক নতুন তথ্য গ্রহণের মাধ্যমে হয়ে ওঠে অনেকটাই সমৃদ্ধ এবং ‘নতুন’। আজ এই মুহূর্তে যে মস্তিষ্ক আপনি ধারণ করে আছেন, ঠিক এক বছর পর তা আর এমন থাকবে না। এবং এর পরিবর্তনগুলো আরো বেশি স্পষ্ট হবে, যদি আপনি সচেতনভাবে একে সমৃদ্ধ করতে চান।
এবং এভাবেই, যখন পুরোপুরিভাবে কোনোকিছু অর্জনের জন্য আপনি প্রচন্ডভাবে সংকল্পবদ্ধ থাকবেন, তখন অপরিবর্তনের সকল মিথ ঝেড়ে ফেলে দেবেন এবং গতিময় জীবনে আপনার অংশে সাফল্য ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। একবার সংকল্প করলে আপনি আর অপরিবর্তন কিংবা শুদ্ধতার নামে মধ্যবর্তী কোনো প্রাপ্তিকে সফলতা ভেবে নেবেন না। আপনার বিশ্বাস এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজের সাথে মিথ্যা বলা বন্ধ করুন। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করুন যা আপনার ইচ্ছেকে পাখা মেলতে দেবে। কারণ আপনি জানেন যে পরিবেশ আপনাতে প্রভাব ফেলে। লক্ষ্য পূরণের স্বার্থে এবার আপনি নিজেই বেছে নেবেন কোনটি আপনার উপর প্রভাব ফেলবে এবং কোনটি দূরে থাকবে। ভেতর এবং বাইরে থেকে আপনার গঠনে যা প্রভাব ফেলে, তা আপনিই বেছে নিন।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া এমন কিছু না, সবাই-ই জীবন থেকে বেশি কিছু চেয়ে থাকে। সাফল্য তা-ই, যখন ব্যক্তি তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে লেগে থাকে। সংকল্পবদ্ধ হন, ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন, আকাঙ্ক্ষাগুলো তা অর্জন করে নিন। শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষাই সফলতা বয়ে আনে না, সাথে চাই সংকল্পও!