কম বেশি আমরা সবাই বিষণ্নতায় ভুগি। তবে বিষণ্নতার মাত্রা বেড়ে গেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ আত্মহত্যাও করে। বিষণ্ণতায় ভুগে অনেক তারকাই আত্মহত্যা করেছেন। বাংলাদেশে নারীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। অধিকাংশ নারী শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। বাংলাদেশ নারী সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৪,৭৪৭ জন নারী শুধু মাত্র শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের দরুন আত্মহত্যা করেছেন।
এদিক থেকে পুরুষরাও বেশ এগিয়ে আছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে ১৫৮ জন নারী এবং ১০০ জন পুরুষ আত্মহত্যা করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত এত মানুষ যে আত্মহত্যা করছে, তার পেছনে যে বিষণ্নতা কিংবা যে দীর্ঘশ্বাস, তা থেকে মুক্তির উপায় কী? কীভাবে মুক্তি পাবেন এই বিষণ্নতা থেকে? আর বিষণ্নতার মাত্রাই বা কতটুকু তা বুঝবেন কীভাবে?
নিজেকে জানুন
- নিজেকে কি খুব অকর্মণ্য বা ‘আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’ মনে হচ্ছে? এই অনুভূতির কারণে আপনি কি কোনো কাজেই উৎসাহ পান না?
- কখনো কি এমন হয় যে অল্প কাজেই হাঁপিয়ে উঠছেন যা সচরাচর হয় না আপনার সাথে?
- মানুষের সঙ্গ খুবই বিরক্তকর লাগে? একা একা থাকতেই বেশি ভালো লাগে?
- রাতভর বিছানায় এপাশ ওপাশ করছেন কিন্তু ঘুম হচ্ছে না? ধীরে ধীরে অনিদ্রায় ভুগছেন কিংবা অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছেন?
- মাঝে মাঝে তীব্র আত্মহননের ইচ্ছা হয়?
উপরোক্ত লক্ষণগুলো বিষণ্নতার লক্ষণ। তবে শেষোক্ত লক্ষণটি যদি দেখা দেয় তবে আর অপেক্ষা না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কনসালটেন্সিতে যাবেন।
বিষণ্নতার কারণ
বিষণ্নতা খুব স্বাভাবিক একটি মানবাচরণ। তবে মাত্রাধিক হয়ে গেলে তা অবশ্যই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। বিষণ্নতার বিভিন্ন কারণ রয়েছে বলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা জানান। বংশগত, সামাজিক, পরিবেশগত সমস্যা এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতার দরুন বিষণ্নতার প্রবণতা দেখা দেয়।
- অনেকে বিষণ্নতার দূর করার জন্য মাদক বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন। কিন্তু অধিংকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মাদক সেবনের কারণে বিষণ্নতা আরো বাড়ে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বাঁচতে হলে মাদক ছাড়তে হবে।
- বিষণ্নতা বংশগত সমস্যাও হতে পারে। আপনার পরিবারের যেকোনো সদস্যের বিষণ্নতা থাকতে পারে। আপনার বাবা-মাও হয়তবা বিষণ্ন থাকেন অধিকাংশ সময়। তবে বিষণ্নতা আপনার বংশগত কিনা নিজে পরীক্ষা করে নিতে হবে।
- অনেক সময় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। থাইরয়েডের সমস্যা থাকলেও বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে।
- অসুস্থতা বিষণ্নতার আরেকটি কারণ। কিছু রোগ যেমন স্কিৎজোফ্রেনিয়া, উদ্বেগজনিত রোগ OCD ইত্যাদি হলে মানুষ অধিকাংশ সময় বিষণ্ন থাকে। এক্ষেত্রে আপনাকে ডাক্তার ভালো সাহায্য করতে পারবেন।
- ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুন বিষণ্ণতা দেখা দেয়।
- কখনো কখনো বিষণ্নতা ঋতুগত সমস্যা রূপে দেখা দেয়। এমন হতে পারে যে শীতকাল এলেই আপনি কেন জানি মনমরা হয়ে যান মানে বিষণ্নতায় ভোগেন। মনস্তাত্ত্বিকগণ এর একটি ভারিক্কি নামও দিয়েছেন- Seasonal Affective Disorder (SAD)।
- বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের বিষণ্নতার অন্যতম কারণ হলো ভালবাসা বা মন দেয়া-নেয়াজনিত সমস্যা। সম্পর্কচ্ছেদের কারণে অনেক তরুণ-তরুণী মাদকদ্রব্যের দ্বারস্থ হয়, যা তাকে অন্তিম পরিণতির দিকে ধাবিত করে। আবার কখনো কখনো সম্পর্কে থাকাকালীন সময়েও অনেকে সন্দেহ এবং আত্মমর্যাদাহীনতার দরুন বিষণ্নতায় ভোগে। সুতরাং যতটা সম্ভব সুস্থ ভালবাসাময় জীবনযাপন করার চেষ্টা করুন।
- এছাড়াও আর্থিক সমস্যা, বেকারত্ব এবং পারিবারিক নানা ঘটনার কারণে মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে।
এবার আসা যাক সমাধানের কথায়। প্রথমেই রিলেশনশিপ জনিত বিষণ্নতার সমাধান করা যাক।
তিক্ত সম্পর্কগুলো ঝেড়ে ফেলুন
যে মানুষটির সাথে আপনার তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাকে তা সরাসরি বুঝিয়ে বলুন। এটি স্বামী/স্ত্রী এবং ছেলে/মেয়েবন্ধুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। খুব দ্রুত সেসব মানুষের সংস্পর্শ থেকে সরে আসা চেষ্টা করুন, অন্তত স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। অযথা দাম্পত্য কলহ করে নিজের সন্তানদের শৈশব নষ্ট করবেন না। তবে তিক্ততা বা খারাপ লাগা যদি পরিবারের কারো উপর হয় যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাচ্ছে না, তবে তার সাথে যাতে কম দেখা সাক্ষাত হয় সেই ব্যবস্থা করুন।
সম্পর্কের সুস্থতা বজায় রাখুন
আপনার যদি একা থাকতে খারাপ লাগে বা কখনো বিষণ্নতায় ভোগেন, তবে এমন কোনো মানুষের সঙ্গ নিন যাকে আপনার ভালো লাগে। সেটা হতে পারে বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, হতে পারে প্রিয় মানুষটির সাথে দু’দন্ড সময় কাটানো। বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করলেও দেখবেন মন খারাপ ভাবটা খানিক কমে যাবে। মোদ্দা কথা, আপনার যা ভালো লাগে তা করতে হবে।
পরিবারের কেউ বিষণ্ন থাকলে নিজ দায়িত্বে তার প্রতি মনোযোগী হন। তাকে সময় দিন এবং মন দিয়ে তার কথাগুলো শুনুন। বিষণ্ন মানুষটার জন্য কিছু করতে পারেন আর নাই বা পারেন, অন্তত ভালো শ্রোতা হয়ে তাকে সহমর্মিতা জানান। এতে সে বুঝবে, এই পৃথিবীতে একজন হলেও তার পাশে আছে
পরিবারের প্রতি মনোযোগী হন। বাচ্চাদের সময় দিন। তাদের একটি হাসি খুশি পারিবারিক জীবন উপহার দেয়ার চেষ্টা করুন। কারণ শৈশবের বিষণ্নতা মানুষের জীবনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে। বিষণ্নতা বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়।
ভালবাসার মানুষটিকে সময় দিন। ব্যস্ততার মাঝেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করুন।
নিত্য নতুন কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন
প্রবাদে আছে- অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। অলস মস্তিষ্ক কিন্তু বিষণ্ণতারও জন্ম দেয়। সুতরাং যত পারেন নিজেকে পছন্দমত কাজে ব্যস্ত রাখুন। আপনি চাইলে প্রতিদিন রাতে তার একটা প্ল্যানও করে রাখতে পারেন। পড়াশুনা, খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি, বন্ধুদের সাথে একসাথে কোনো মানবসেবামূলক কাজ করতে পারেন। ইচ্ছে হলে গান, নাচ এবং শখের যেকোনো কাজ করতে পারেন। ব্যায়াম মানসিক প্রফুল্লতার অন্যতম দাওয়াই। সকাল বিকাল ব্যায়াম করতে পারেন। দেখবেন ঝরঝরে লাগছে।
স্বপ্নগুলোকে ডানা মেলতে দিন
অধিকাংশ তরুণ চাকুরীজীবীদের নিজের স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে না পারার কারণে বিষণ্ন থাকতে দেখা যায়। পড়াশোনা শেষে নিজের পরিবার ও সমাজের কথা চিন্তা করে চাকুরীতে ঢুকেছেন, কিন্তু মনে মনে আপনি অতৃপ্ত। কারণ আপনারও একটা স্বপ্ন ছিল দেশকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে। আর বিষণ্ন না থেকে নতুন উদ্যমে সেই কাজে মনোযোগ দিন। দেখবেন বিষণ্নতার ভূত আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে।
এইতো গেলো জীবনযাপন নিয়ে কথাবার্তা। এবার আসা যাক খাবার দাবারের কথায়।
- সপ্তাহে ৩-৫ বার দৈনিক ২০-৩০ মিনিট দৌড়ান। চাইলে হাল্কা ব্যায়ামও করে নিতে পারেন। খোলা বাতাসে দৌড়ালে দেখবেন মনটা ঝরঝরে হয়ে যাবে।
- একটা ডায়েরী রাখুন। প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিখে রাখুন।
- যাদের বেশি চকোলেট, উচ্চ ফ্যাট জাতীয় খাবারে আসক্তি, তাদের মাঝে বিষণ্নতা বেশি দেখা যায়। যদিও বিষণ্নতার খাবার দাবার সরাসরি দায়ী নয়। কিন্তু পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু উচ্চ ফ্যাটজাতীয় খাবার হৃদরোগের জন্য দায়ী, সেহেতু বিষণ্নতার সাথে এ ধরণের খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্ক থাকতে পারে। তাই বেশি বেশি ফল, শাক-সবজি ও মাছ খান এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন। আপনি চাইলে খাবারের কারণে আপনার মানসিক পরিবর্তনের একটা ট্রেস রাখতে পারেন। একটি চার্ট করে দেখুন, কোন ধরনের খাবার গ্রহণের পর আপনার বিষণ্নতা কমে যায়। ২-৩ সপ্তাহ পর দেখবেন শাক সবজি আর ফলমূলেরই জয় হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন, পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করুন। সবশেষে জীবনটাকে উপোভোগ করুন। নিজের জীবনের ভালো ভালো দিকগুলো খুঁজে বের করুন। মনে রাখবেন, মৃত্যু কখনোই কোনো সমস্যার সমধান নয়।