মৃত্যু নানাভাবেই হতে পারে। পানিতে ডুবে মারা যাওয়া নতুন কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষ কি কেবল পানিতে ডুবেই মারা যায়? পৃথিবীতে এমন অনেক নজির আছে যেখানে ডুবে যাওয়ার ফলেই মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তবে সেটা পানিতে ডুবে নয়। চকোলেট, গ্রীজ ইত্যাদি থেকে শুরু করে রঙয়ের বিশাল পাত্রে ডুবেও মৃত্যু হয়েছে অনেকের। এমন কিছু অন্যরকম ডুবন্ত মৃত্যুর কথাই আজ শোনানো হবে আপনাদের।
রঙে ডুবে মৃত্যু
ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে অবস্থিত ফোর্ড ট্রানজিট ভ্যান প্ল্যান্টে কাজ করতেন ৩০ বছর বয়সী ক্রিস্টোফার শ্যুট। কারখানায় রঙ রাখার জন্য বিশাল বড় একটা ট্যাঙ্ক ছিল। কিছুদিন ধরেই সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেই ট্যাঙ্কে। কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে ট্যাঙ্ক উপচে রঙ গড়িয়ে পড়া শুরু হয়ে যেত। সাধারণত এমন কিছু হলে ছুটে গিয়ে ট্যাংকের উপরে উঠে ঢাকনা বন্ধ করে দেওয়াটাই ছিল ক্রিস্টোফারের কাজ। ২০০০ সালের আগস্ট মাস। সেদিনও ট্যাঙ্ক ভরে গেলে সেটা বন্ধ করতে দৌড়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বন্ধ তো হলোই না, উল্টো পা পিছলে সোজা ভেতরে পড়ে গেলেন ক্রিস্টোফার। সহকর্মীরা সাহায্য করতে এসেছিল। তবে তাতে লাভ হয়নি কোনো। কে যেন ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলে রেখে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেই গেল আর রঙে ডুবে মৃত্যু হলো ক্রিস্টোফার শ্যুটের।
গ্রীজ ট্র্যাপে মৃত্যু
তিন বছরের স্যাডি গ্রেজ এ্যান্ড্রু ২০১৭ সালের অক্টোবরে বাবা-মা’র সাথে আইসক্রিম কিনতে দোকানে গিয়েছিল। দোকানের ঠিক পাশেই নিজের আর দুজন ভাই-বোনের সাথে খেলছিল স্যাডি। এমন সময় হঠাৎ করে তার পা বেকায়দাভাবে গ্রীজ ট্র্যাপের ভেতরে পড়ে যায়। ট্র্যাপের ঢাকনা খুলে প্রায় ৬ ফুট নীচে পড়ে যায় সে। আর মৃত্যুর ব্যাপারটিকে আরো নিশ্চিত করে তুলতে স্যাডি পড়ে যাওয়ার পরপরই আবার ঢাকনা লেগে যায় গ্রীজ ট্র্যাপটির।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করে স্যাডিকে তার বাবা-মা। দোকানের সিকিউরিটি ক্যামেরা ও অন্যান্য সাহায্য নেওার পর গ্রীজ ট্র্যাপে ডুবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় স্যাডিকে। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। তবে ততক্ষণে মারা গিয়েছে মেয়েটি। গ্রীজে ডুবে মৃত্যু হয় তার।
তরল সবজিতে ডুবে মৃত্যু
ভাগ্য যখন বিরূপ হয় তখন তরল সবজিতে ডুবে মৃত্যুটাও আর হাস্যকর বলে মনে হয় না। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ভারতের লক্ষ্ণৌতে এক কেচাপ তৈরির কারখানায় আর সব দিনের মতন কাজ চলছিল। কারখানার প্রায় ২০ ফুটের একটি পাত্রে সবজি গাঁজানো হচ্ছিল। তা এমন কাজ তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। অন্য দিনের মতন তাই নিজের কাজ সেরে নিচ্ছিল নির্দিষ্ট কর্মী। পাত্রের ভেতরে সবজিগুলোকে ভালো করে মেশাচ্ছিল সে।
এমন সময় তার মইটা হেলে পড়ে। আর দেখতে দেখতে সোজা গিয়ে ২০ ফুটের পাত্রে গিয়ে পড়ে সেই কর্মী। আর কেবল সে একাই নয়, কারখানার এই নারী কর্মীর পেছনে একে একে আরো সাতজন কর্মী পড়ে যান ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে দ্রুত তাদেরকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ততক্ষণে কর্মীদের মধ্যে ছয়জনেরই মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানান, কর্মীরা পাত্রের মধ্যে পড়ার পর প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তৈরি হওয়া গ্যাসের প্রভাবে তারা জ্ঞান হারান। এরপর অজ্ঞান অবস্থায় ডুবে গিয়ে মৃত্যু হয় তাদের।
চকলেট যখন মৃত্যুর কারণ
চকলেট খেতে ভালোবাসেন? কিন্তু ভাবুন তো একবার, যদি খুব পছন্দের এই চকলেটে ডুবেই মৃত্যু হয় আপনার? আপনার কথা ছাড়ুন! ইয়োনি কর্ডন, কতটা পছন্দ করতেন তিনি চকোলেট খেতে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০০২ সালে ৪,৫০০ লিটার গলিত চকলেট ভর্তি জালার মধ্যে ডুবন্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায় ইয়োনিকে। পেন্সিলভানিয়ার হ্যাটফিল্ডে কারঘের কর্পোরেশন নামে একটি ক্যানি কারখানায় কাজ করতেন ইয়োনি।
সেখানে একটি জালায় চকলেটের সাথে অন্যান্য উপাদান মেশানোর কাজ করার সময় পা পিছলে ভেতরে পড়ে মারা যান তিনি- এমনটাই ধারণা করা হয়। ইয়োনিকে কেউই জালার মধ্যে পড়তে দেখেনি। তাই ঠিক কখন সে পড়েছে আর কীভাবে পড়েছে তার পুরোটাই ধারণা করে নেওয়া হয়।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, চকলেটে ডুবে মৃত্যুর এই ঘটনা কিন্তু প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এভাবে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। এর আগে ২০০৯ সালে ভিনসেন্ট স্মিথ নামে আরেকজন কর্মী মারা যান চকলেটের জালায় পড়ে গিয়ে। ২৯ বছরের স্মিথ কাজ করতেন কোকোয়া সার্ভিস নামক একটি চকলেট কোম্পানিতে। মৃত্যুর আগে ৯ ফুট উঁচু একটি জালার কিনারে দাঁড়িয়ে চকলেট মেশাচ্ছিলেন তিনি। সেসময় চকলেট মেশানোর একটি ব্লেডের ধাক্কা লেগে জালায় পড়ে যান স্মিথ আর সেখানেই মৃত্যু হয় তার।
তেলের ট্যাঙ্কে মৃত্যু
২০০১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি। খাবার তেলের জালার উপরের অংশটুকু মেরামত করছিলেন সেবার টেক্সাসের লুবকে অবস্থিত ফ্রিটো-লে ফ্যাক্টরির কর্মী ডোনাল্ড বুন। সাথে ছিলেন অন্য এক সহকর্মীও। নীচের দিকে উবু হয়ে যন্ত্রপাতি তুলতে ঝুঁকেছিলেন বুনের সহকর্মী। মিনিটখানেকও হয়নি। কিন্তু এর ভেতরেই যা হওয়ার হয়ে গেল। মাথা উপরে উঠিয়ে আর বুনকে দেখতে পেলেন না তিনি। বুনের পা তখনো তেলের ট্যাঙ্কের উপরে দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। দ্রুত ট্যাঙ্কের তেল বের করে দেওয়ার অংশটুকু খুলে ফেললেন কর্মীরা। সেই সাথে আতিপাতি করে খোঁজা হলো বুনকে। তবে তেল বেরিয়ে যাওয়ার পরেই পাওয়া গেল বুনের দেখা। তড়িঘড়ি করে বুনকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। ততক্ষণে বুন আর নেই। মৃত্যু হয়েছে তার।
চিকিৎসকেরা জানান, পাত্রে পড়ার সাথে সাথেই মাথায় আঘাত লেগে জ্ঞান হারান বুন। এজন্য আর উপরে উঠে আসার চেষ্টা করতে পারেননি তিনি। রান্না করার তেলে ডুবেই তাই মৃত্যুবরণ করতে হয় বুনকে।
মনুষ্য বর্জ্য যখন মৃত্যুর কারণ
আফ্রিকান গ্রাম পোলোকওয়ানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা ৫ বছরের মাইকেল কোমাপ সেবার মাত্র পড়াশোনা শুরু করেছে। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি, বিদ্যালয় থেকে ফোন এল মাইকেলের বাবা-মায়ের কাছে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মাইকেলকে। ছুটে এলেন বিদ্যালয়ে মাইকেলের মা রোজিনা। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না বাচ্চা ছেলেটিকে।
এমন সময় মাইকেলের এক বন্ধু জানালো, গ্রামের বিদ্যালয়ের বাথরুমে মাইকেলের পড়ে যাওয়া ঘটনা। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় সেখানের বিদ্যালয়ে আমরা যেটাকে বাথরুম বলে মনে করি সেটা ছিল না। গোল একটা গর্তের মতো স্থানে বাথরুম করতে হত শিক্ষার্থীদের। তো এই পিট টয়লেটেই অবশেষে পাওয়া গেল মাইকেলকে। সে তখন মনুষ্য বর্জ্যে ডুবে গিয়েছে। পরবর্তীতে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি মাইকেলকে। নিজের সন্তানকে হারিয়ে পাগল হয়ে যান মাইকেলের বাবা-মা। তাদের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ে আধুনিক বাথরুম নির্মিত হয়।
বিয়ারের সুনামি
১৮১০ সালের কথা। লন্ডনের সেইন্ট গিলসে অবস্থিত হর্স শ্যুজ ব্রিউয়ারি বা শুঁড়িখানাতে প্রায় ২২ ফুটের একটি বিয়ারের কাঠের জালা আটকে ছিল বেশ কিছু রিঙয়ের মাধ্যমে। ১৮১৪ সালের ১৭ অক্টোবর হঠাৎ করে সেই রিঙগুলোর একটি স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে আর পুরো জালার বিয়ার একসাথে বাইরে বেরিয়ে আসে।
এই বিয়ারের তোড়ে পুরো শুঁড়িখানার অনেকখানি অংশ ভেঙে যায়। ভেঙে যায় আরো অনেক বিয়ারের জালা। সব বিয়ার বেরিয়ে এক রকমের সুনামি সৃষ্টি করে। প্রায় ১.২ মিলিয়ন লিটার বেরিয়ে আসে একসাথে। প্রাথমিকভাবে মোট ৮ জন মানুষ বিয়ারের তোড়ে ডুবে মারা যান। পরবর্তীতে অ্যালকোহল থেকে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় এবং বেশ কিছুদিন এর প্রভাবে আরো কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়।
ফিচার ইমেজ- Google Play