হোক না বৃষ্টি, হোক না ঝড়
থাকে এক ছাদ আমার মাথার উপর,
যেখানে থাকি আমি, সাথে থাকে যে ছাতি!
সত্যিই মাথায় ছাতা থাকলে রোদ, বৃষ্টি যা-ই আসুক না কেন, চটজলদি তার একটা ব্যবস্থা করা যায়। বিশেষ করে বর্ষার দিনে ছাতা ছাড়া ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার শামিল।
এখন কথা হলো ছাতা তো কিনতেই হবে, কিন্তু তার জন্য আপনি কত টাকা খরচ করবেন? হরহামেশাই ব্যবহার করার জন্য যারা ছাতা কেনেন তারা হয়তো ২৫০-৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এমন ছাতাই কিনবেন। যারা একটু ফ্যাশন সচেতন কিংবা ব্র্যান্ডনির্ভর কেনাকাটায় অভ্যস্ত, তারা বেশি জোর দেবেন একটু দামি ছাতার দিকে। কিন্তু সেই দামটা নিশ্চয়ই লাখের ঘর ছাড়াবে না। আর যদি আপনাকে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে একটা ছাতা কেনার প্রস্তাব দেয়া হয়, তাহলে ঐ দোকানদারের উপর আপনার রাগ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় গড়ে ১ লাখ ২৯ হাজার টাকা, সে দেশের মানুষের হাতে আর যা-ই হোক ৪০ লাখ টাকা দামের ছাতা মানায় না বা তারা এমন কোনো ছাতার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না।
স্বপ্নে যা ভাবাও কষ্টকর বাস্তবে তা বানিয়ে দেখিয়েছে ইতালির একটি লাক্সারি ব্র্যান্ড ‘বিলিয়নিয়ার কুচার’। শুধুমাত্র ছেলেদের পোশাক ও প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানটি কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি করেছে এই ছাতাটি। কথায় বলে, সুদিনের সঞ্চয় দুর্দিনের সহায়। কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো বিশেষ এই ছাতাটি নিয়ে বৃষ্টির দিনে বের হওয়ার আগে যে কেউ দু’বার ভাববে। এত দামি জিনিস, ভেজাতেও তো মায়া লাগবে! কাজেই হাতে টাকা থাকলে এই ছাতা কিনে যত্ন করে রেখে দিন আলমারিতে, কোনো এক দুঃসময়ে দুই-তিন গুণ বেশি দামে নিলামে তা বিক্রি হলেও হতে পারে।
কী হবে আর কী হতে পারবে তার হিসেব বাদ দিয়ে বরং যা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘বিলিয়নিয়র কুচারের’ হয়ে কুমিরের চামড়ার এই ছাতাটি ডিজাইন করেছেন অ্যাঞ্জেলো গালাসো। আপনি যদি জীবনকে সুন্দর সব জিনিসে পরিপূর্ণ করে তুলতে চান, ভালো একটি জায়গায় থেকে নিজের পোশাক-আশাকের মাধ্যমে চারপাশে একটি স্টাইলের ঝড় তুলতে চান, তাহলে অনবদ্য এই ছাতাটি আপনার কথা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে। বৃষ্টির দিনেও যে ফিটফাট হয়ে থাকা যায় কিংবা নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখা যায় তার প্রমাণ হতে পারে এমন একটি দুর্দান্ত ছাতা। একই ব্র্যান্ডের দুটি ছাতাও বিলিয়নিয়র কুচার কোম্পানি একরকম করে বানাবে না। ৫০ হাজার ডলার দিয়ে একটি ছাতা যিনি কিনবেন, তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না কোনো এক পার্টিতে গিয়ে একই রকম ছাতাসহ আরেকজন অতিথিকে দেখে কেউ বলে উঠুক, “আরে আপনারা কি একই দোকান থেকে ছাতা কিনেছেন নাকি!”
এমন একটি ছাতাকে নিজের করে পেতে হলে লন্ডনের ফ্ল্যাগশিপ স্টোরে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে। ইতালির ফর্মুলা ওয়ান মুঘল ‘ফ্ল্যাভিও ব্র্যায়োটর’ প্রথম এমন একটি ছাতার আইডিয়া দেন। সেই আইডিয়া থেকেই ছাতার ডিজাইন করে ফেলেন অ্যাঞ্জেলো গালাসো। এটি অসাধারণ একটি ছাতা। যারা ছাতা ব্যবহার করতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তারাও পানি নিরোধী কুমিরের চামড়ার তৈরি গ্লসি এই ছাতাটি পেলে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠবেন নিমেষেই। চটকদার চামড়ার মোড়ক দেখে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে মনে সন্দেহ জাগলেও প্রকৃতপক্ষে এটি বেশ কাজের জিনিস।
এ ব্যাপারে ‘বিলিয়নিয়র কুচার ক্রোকোডাইল স্কিন আমব্রেলা’ প্রস্তুতকারক কোম্পানিকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। তাদের ছাতা এতোটাই মজবুত যে বর্ষার দিনে নিজেই নিজেকে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, সাথে নিজের মালিককেও ভিজতে দেয় না। আর তার শক্ত চামড়া প্রবল বাতাসের তোড়েও ছাতাটি উড়িয়ে নিয়ে যেতে দেয় না। ছাতার সাথে ম্যাচ করে কোম্পানিটি আরও তৈরি করেছে কুমিরের চামড়ার ব্যাগ, জুতা, কোট, বেল্ট এবং তার সাথে থাকছে এক্সক্লুসিভ ঘড়ি, টাই, কাফ লিঙ্ক প্রভৃতি। প্রতিটি আইটেমই তৈরি করা হয়েছে সীমিত সংখ্যায়।
এই ছাতাটি বানানোর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি ছাতাটির দাম ছিল ১,২৭০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার টাকা। ‘সোয়ায়েন অ্যাডেনে ব্রিগ ম্যান মালাকা’ কোম্পানির এই সুদর্শন ছাতাটির রয়েছে দুইটি হাতল। এর সাথে পানি শোষণের জন্য একটা ফ্লাস্কও সংযুক্ত করা হয়েছে। এর শামিয়ানার অংশটি তৈরি করা হয়েছে কালো সিল্কের কাপড় দিয়ে। টিউলিপ কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছে ছাতাটির হাতল। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী এই ছাতার বাটে রূপার প্রলেপ দেয়ার সিস্টেমও রেখেছে কোম্পানিটি।
‘বারবেরি নিউবাক অস্ট্রিক আমব্রেলা’ নামক বিখ্যাত ব্রিটিশ ছাতা প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ডটি তাদের সবচেয়ে দামি ছাতাটি বিক্রি করছে ৮৫০ ডলারে, বাংলাদেশি টাকায় সংখ্যাটি দাঁড়াবে প্রায় ৭০ হাজারে। মার্জিত ডিজাইনের এই ছাতাটির ছাদের অংশটি তৈরি করা হয়েছে পানি প্রতিরোধী পলিয়েস্টারের সাথে সুতি টুইল কাপড়ের মিশ্রণে। দামটি হালাল করার জন্য ছাতার হ্যান্ডল এবং সুইচের অংশটুকু মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে উটপাখির চামড়া দিয়ে।
‘সোয়ায়েন অ্যাডেনে ব্রিগ ম্যান মালাকা’ কোম্পানির আরেকটি এক্সক্লুসিভ ছাতা আছে যার দাম ৭৬০ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬২ হাজার টাকা মাত্র! খামখেয়ালি স্বভাবের গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা গুটিকতক ব্যবহার্য পণ্যের মধ্যে এই ছাতাটি অন্যতম। এর হ্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে বাঁশের শেকড় দিয়ে। বাঁশের নাম শুনে যদি কারো নাক কুঁচকে ওঠে তাহলে তার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভালো, এটি যেনতেন বাঁশ নয়। আফ্রিকার একটি নির্দিষ্ট জায়গার বাঁশ এনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাকে সংরক্ষণ করে তৈরি করা হয় ছাতার বাট। এই বাঁশ সহজে ভাঙে না।
এছাড়া ‘ইল মারকোসাতো’ ব্র্যান্ডের খাঁটি সিল্ক এবং ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি বিশেষ ছাতার দাম পড়বে প্রায় ৩৮৫ ডলার বা ৩১ হাজার টাকা। প্রায় একই রকম দেখতে ইতালীয় ব্র্যান্ড ‘পাসোট্টি’র ক্রিস্টাল নির্মিত ছাতাটির দাম পড়বে প্রায় ৩৬০ ডলার বা ২০,৫০০ টাকা। লন্ডন আন্ডারকভার ব্রাসেলস স্প্রাউট, ব্রুকস ব্রাদার্স, জেফরি’স ওয়েস্ট ডেভিল’স হেড, ফুল্টন স্লিঙ্গার, সেঞ্জ স্মার্ট, জেফরি ওয়েস্ট ক্ল্যাসিক, পলকা ডট আমব্রেলা, গাস্টবাস্টার মেট্রো, এলা এলইডি, সি থ্রো ডিলাক্স- এই ১০টি ছাতা বর্তমানে বিশ্বের সেরা ছাতাগুলোর তালিকায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে। ১৫ ডলার থেকে শুরু করে ২৫০ ডলার পর্যন্ত দাম এগুলোর। রাণী ভিক্টোরিয়া একটি স্বচ্ছ ছাতা ব্যবহার করতেন যাতে ছাতার ভিতরে রাণীকে ঠিকমতো দেখা যায়। ছাতাটি বাইরে থেকে দেখতে যেমন সুন্দর, ভিতর থেকেও তা ঠিক ততটুকুই কার্যকর বলে রাণী উল্লেখ করেছেন। কাজের জিনিস ছাতাও যে অ্যান্টিকে পরিণত হতে পারে, তার নিদর্শন দেখাতেই যেন বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছে আজকালকার ব্র্যান্ডগুলো।
ফিচার ইমেজঃ alux.com