সায়েম আর সিয়াম দুই ভাই, দুজনেরই বয়স ১০ বছরের কাছাকাছি। সায়েম একদিন দৌড়াতে গিয়ে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেলো। সে উঠে গিয়ে ব্যথা পাওয়া জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললো, বাসায় এসেও তেমন কিছু জানালো না। যদিও পড়ে যাওয়ার পর তার বন্ধুরা অনেক হাসাহাসি করছিল। আর অন্যদিকে সিয়ামও একদিন খেলতে গিয়ে ব্যথা পেলো, অন্যদের হাসাহাসি দেখে তার কান্না পেলো ভীষণ। তারপর বাসায় এসে মাকে জানিয়ে আরেক দফা কান্না জুড়ে দিলো।
আমরা সিয়ামের কথাই বলছি, তার সংবেদশীলতা বেশি! অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা যখন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে তখন তার চারপাশের সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মানুষের আচরণ, তাদের অভিব্যক্তি, আশপাশের শব্দ, রঙ কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের ব্যবহার সে দারুণভাবে বিশ্লেষণ করে। সে সামান্যতেই বিরক্ত হয়, চুপচাপ নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। তার সঙ্গ পেতে হলে তার মন বুঝতে হয়, নইলে বন্ধুত্ব সম্ভব নয় তার সঙ্গে! তার সমবয়সী অনেক বাচ্চা যখন সবকিছু নিয়ে মেতে থাকছে, তখন সে কেবল নিজের পছন্দের ব্যক্তি আর খেলনা নিয়েই খেলছে।
পিতা-মাতা হিসেবে এমন ‘অদ্ভুত‘ আচরণ হয়তো আপনি বরদাশত করবেন না। সবকিছুতে সংবেদনশীল এমন সন্তানকে লালন-পালন একটু কষ্টই বৈকি। কিন্তু এটা তার একার বৈশিষ্ট্য নয়, বাড়ন্ত শিশুদের ভেতর ১৫-২০ শতাংশের ভেতর এমন আচরণ দেখা যায়! এসব শিশুরা যথেষ্ট সামাজিক, সৃজনশীল, সহানুভূতিশীল আর কৌতূহলী স্বভাবের হয়ে থাকে, তবে সেটা তার খোলসের আড়ালেই ঢাকা থাকে। যতক্ষণ না আপনি তাকে খোলসের বাইরে বের করে না আনেন। এরকম সন্তানদের মানুষ করতে হলে একটু ভিন্নভাবেই আচরণ করা উচিত, সেগুলো নিয়েই আজকের লেখাটি।
আবেগপ্রবণতা মেনে নিন
আপনি যদি বুঝতে পারেন যে, আপনার সন্তানটি আসলে একটু বেশিই আবেগপ্রবণ, তাহলে সেটা সমস্যা মনে না করে স্বাভাবিক হিসেবেই নিন। এটাই হবে তার জন্য আপনার নেওয়া সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত। তার উপর যখন-তখন রেগে যাবেন না। তাহলে একসময় আপনার সঙ্গে বিষয়গুলো শেয়ার না করে নিজের ভেতর লুকাতে শুরু করবে। পরিণতিতে একটা সময় সে বিষণ্নতায় ভুগবে।
তাকে তার আবেগগুলো সহজাত ভঙ্গিতে প্রকাশ করতে দিন। আপনি বরং তার অনুভূতি প্রকাশের প্যাটার্ন লক্ষ্য করুন। আবেগ প্রকাশকালে প্রথমে তার কথা শুনুন। তারপর সমাধান দিন, এর সাথে সাথে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আবেগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটা শিখিয়ে দিন। প্রথমদিকে এটা কাজ না করলেও সে একটা সময় গিয়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণে আপনার পরামর্শ মেনে চলতে শুরু করবে। মনে রাখতে হবে, অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়াটা তার একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটাকে দূর করার চেষ্টা না করে বরং কীভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটাই তাকে শেখাতে হবে। তবেই সে স্বনির্ভর হবে আবেগ প্রকাশের দিক দিয়ে, পরিস্থিতি সামাল দিতেও আপনাকে তার সবসময় প্রয়োজন পড়বে না।
সন্তানের বন্ধু হোন
আবেগপ্রবণ সন্তানদের দেখে রাখা আপনার জন্য সহজ হতে পারে যদি আপনি তার বন্ধু হতে পারেন। শুধু মুখের কথায় নয়, আপনি তার বন্ধু হয়েছেন কি না সেটা সে আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশ করবে। একবার তার বন্ধু হতে পারলে তার কর্মকাণ্ডগুলো সহজেই দেখে নিতে পারবেন। কারণ এমন সন্তানরা সাধারণত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আপনাকে জানাবে। যেখানে স্বাধীনচেতা আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারা সন্তানরা আপনার অনুমতির তেমন তোয়াক্কা করবে না।
আবেগপ্রবণ সন্তানরা যেহেতু পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়; বিশেষ করে উজ্জ্বল আলো, চিৎকার-চেঁচামেচি কিংবা অগোছালো পরিবেশের প্রতি তারা খুবই সংবেদনশীল। এমন পরিবেশে সে বেশিক্ষণ থাকতে চাইবে না, বরং নীরবতাই তার জন্য উপযুক্ত তখন। আপনার বাচ্চার আশপাশে যদি এমন পরিবেশ তৈরি হয় তবে বেশিক্ষণ সেখানে না রেখে বরং জায়গা বদলে ফেলুন। তাকে বই পড়তে দিন (যদি পড়তে পারে), ব্রিদিং এক্সারসাইজ করান কিংবা শান্ত করার জন্য ঘুম পাড়াতে পারেন। বাচ্চা রেগে গেলে তার জন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ খুবই কার্যকরী, বিশেষ করে সে যখন আপনার কাছাকাছি থাকে না।
নিয়মানুবর্তিতা শেখান
বাচ্চাদের ভেতর নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! আর সন্তান যদি হয় আবেগপ্রবণ, তবে তার ভেতর নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস করানোটা আরও জরুরি। ইমোশনাল সন্তানরা যেহেতু বাবা-মায়ের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়, তাদের ভেতর নিয়ম তৈরি করে দেওয়াটা আরও সহজ। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, নিয়মগুলো যেন তাকে আবার রাগিয়ে না দেয়, কিংবা নিয়মের ভারে সে যেন সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। বরং এমন কিছু অভ্যাসের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যেগুলো তার জন্য তার আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। সেইসাথে আপনিও তাকে সময় দিতে পারেন, যখন সে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মিশে। প্রতিনিয়ত একটা ছন্দ পেলে সে নিজের উপর কনফিডেন্স তৈরি করতে পারবে।
সন্তানের চেষ্টাকে সমর্থন জানানো
স্বাভাবিকভাবে আপনার আবেগপ্রবণ সন্তান সহজে কিছু করতে চাইবে না, কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে মিশতে চাইবে না। বিশেষ করে এমন পরিবেশে, যেখানে সে একবার অপদস্থ হয়েছে। তার ছোট ছোট চেষ্টাগুলোকে তাই সমর্থন জানাতে হবে, যত বিচ্ছিন্ন চেষ্টাই হোক না। যেমন, সে যদি ছবি আঁকতে গিয়ে অন্যদের মতো না পারে, অর্থবোধক আঁকিবুকি না করে, তবে তাকে বকা দেবেন না। বরং তাকে জানাতে হবে, সে যেটা চেষ্টা করছে এটা দারুণ! তবে ছবিটা এভাবে আঁকলে আরও সুন্দর হতে পারে। সে তখন আপসেট না হয়ে কিংবা রেগে না গিয়ে নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, আবেগপ্রবণ সন্তানরা সাধারণত কষ্টকর কিংবা যেসব কাজে সে ব্যর্থ সেগুলো থেকে তার মনোযোগ সরিয়ে নেয়। এটা করার ব্যাপারে সে হয়তো আপনাকে মিথ্যে বলতে পারে, যদি না তার চেষ্টাগুলোকে আপনি সমর্থন জানান।
সন্তানকে পুরষ্কৃত করুন
যেকোনো বাচ্চাই উপহার হিসেবে কিছু পেলে খুশি হয়। আর সেনসিটিভ বাচ্চা যদি উপহার পায়, তবে তো কথাই নেই! যে ভয়, অপমানবোধ তাকে পিছে ঠেলে দেয়, সেগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখানো যাবে আপনার বাচ্চাকে পুরষ্কৃত করার মাধ্যমে। তাকে যথাসাধ্য কাজের ফলাফল হিসেবে উপহার দিন। তারপর তাকে জানান, সে অমুক কাজটা ঠিকভাবে (অন্তত চেষ্টা) করার জন্য পুরষ্কারটা পেয়েছে। এতে তার কাজের উদ্যম বহুগুণ বেড়ে যাবে। তার কাজের ফলাফল হিসেবে উপহার প্রদানে ভিন্নতা আনুন। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আপনার উপস্থিতিও তার জন্য বড় উপহার হতে পারে। তাই তার পছন্দ-অপছন্দ, শক্তি-দূর্বলতার জায়গাগুলো জেনে নিন আগে থেকে।
অল্প কথায় আবেগ প্রকাশ
আবেগপ্রবণ বাচ্চারা যত সহজে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে, তত সহজে সেগুলোকে প্রকাশ করতে পারে না। তাই তার আবেগতাড়িত অনুভূতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়তা করুন। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে, কতটুকু আবেগ প্রকাশ করতে হবে, সেটা তাকে শেখানো গেলে পরবর্তীতে আর দ্বিধায় ভুগবে না সে। আবার নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে তার পরবর্তী জীবনে।
সন্তানের সমস্যার সমাধান করুন
সবসময় সন্তানের সব আবদার আর অভিযোগ শোনার মানসিকতা আপনার না-ও থাকতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে রেগে না গিয়ে বরং সন্তানের কাছে সময় চেয়ে নিন, তাকে আশ্বস্ত করুন। রেগে গিয়ে যদি শাস্তি দিতে যান, তবে আপনার সব শিক্ষা বিফলে যেতে পারে! শাস্তির চেয়ে ডিসিপ্লিন শেখালে সে আরও অর্থপূর্ণ আচরণ করবে ভবিষ্যতে। আপনি নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় নিন, অবশ্যই আপনার সন্তান যেনো বুঝতে না পারে তাকে গোছাতে গিয়ে আপনিও অগোছালো হয়ে পড়েছেন!
আপনাকে সবসময় একটা সত্য মেনে চলতে হবে, আপনি অতিসংবেদনশীল বাচ্চা বড় করে তুলছেন। সে আপনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাকে বাদ দিয়ে আপনার জীবন অপূর্ণ। তাই তাকে বড় করে তোলাটা সমস্যা হিসেবে না দেখে, স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। হয়তো সবকিছু সময়মতো হবে না, তবে একদিন হবে- এই বিশ্বাস আর ধৈর্য নিয়ে এগোতে পারলেই তবে সন্তানকে আগামীর জন্য উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।