একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব কেমন হবে, তা আসলে অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি একজন মানুষের আচরণের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। প্রকৃতপক্ষে একটি শিশুর নানা আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পেছনে কেবল জেনেটিক বা বংশগত ক্রিয়াই দায়ী নয়। ছোটবেলা থেকেই সে কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠছে, পরিবার তাকে কীভাবে লালন-পালন করছে ইত্যাদির উপর তার মানসিক উন্নতি নির্ভর করে। এসবের মাধ্যমে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে, তা কেবল সময়ই বলে দেবে।
প্রত্যেক মা-বাবার কাছে তাদের সন্তান সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবার জীবনে সন্তানের অগ্রাধিকার সবচাইতে বেশি। তাই তারা সব সময় চিন্তিত থাকেন কীভাবে নিজেদের সন্তানদের বড় করবেন। নিজের বাচ্চার পড়াশোনা, আচার-ব্যবহার, চাওয়া-পাওয়া সবকিছুর গুরুদায়িত্ব থাকে মা-বাবার উপর। সন্তানের জন্য যে জিনিসটা ভালো, সেটাই তারা করে থাকেন। কিন্তু সব সময় সন্তানকে কেন্দ্র করে মা-বাবার সকল সিদ্ধান্ত যে সঠিক হবে, এমনটি কিন্তু নয়। তাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত সন্তানের জীবনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সন্তানকে বড় করার সময় বাবা-মায়ের নেওয়া অনেক ভুল সিদ্ধান্তের মাঝে একটি হলো নিজের সন্তানকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করা। আরো পরিষ্কার করে বললে, নিজ সন্তানকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়া যে, “তুমিই সবার থেকে সেরা”। আসলে অনেক অভিভাবকের এসব বলার পেছনে একটি ইতিবাচক উদ্দেশ্য কাজ করে। তারা মনে করেন, নিজের বাচ্চাকে এভাবে বললে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আসলে ঘটনা ঘটে উল্টোটা। এমনভাবে নিজের বাচ্চাকে অন্যদের থেকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করলে তা সন্তানের মনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তারা নিজেদের নিয়ে বেশি মগ্ন হয়ে পড়ে। নিজেদেরকে অন্য সবার থেকে স্পেশাল বা বিশেষ কিছু ভাবতে শুরু করে। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে এমন আত্মরতিমূলক মনোভাব থাকাকে নার্সিসিজম বলে। আর এমন মানুষদের বলা হয় নার্সিসিস্ট।
“তুমি অনেক ভালো” এবং “তুমি সবার থেকে ভালো”- এই দুই বাক্যের মাঝে শব্দগত পার্থক্য অনেক কম। কিন্তু দুটি বাক্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনেক বেশি। যেসব মা-বাবা তাদের সন্তানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বাক্যটি ব্যবহার করেন, তাদের সন্তানের ভবিষ্যতে নার্সিসিস্ট বা আত্মমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আর এগুলো মনগড়া কথা নয়। একেবারে গবেষণা থেকে প্রমাণিত।
যখন মা-বাবা তার সন্তানকে বলেন যে, তুমিই সবার থেকে সেরা, তখন সন্তান এটি বিশ্বাস করে ফেলে। এ ব্যাপারটি উক্ত সন্তান ও সমাজ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
এ কথাটি বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ ও মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ব্র্যাড বুশম্যান। তিনি সন্তানদের “নারসিসিস্ট হওয়ার পেছনে মা-বাবার ভূমিকা” বিষয়ক একটি গবেষণাপত্রে সহকারী লেখক হিসেবে কাজ করেছেন। উক্ত গবেষণার প্রতিনিধি ছিলেন নেদারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টারডামের পোস্ট ডক্টোরাল গবেষক এডি ব্রামেলম্যান।
ব্রামেলম্যানের মতে,
সন্তানদের সব জায়গায় অতিরিক্ত মূল্যায়ন করলে তারা আত্মবিশ্বাসী হওয়ার বদলে অসাবধানতাবসত বেশি আত্মমগ্ন বা নার্সিসিস্ট হয়ে যায়।
উপরে উল্লেখিত দুজন গবেষকের সম্মিলিত প্রয়াসে গবেষণাটি এগিয়ে যায়। এই গবেষণায় তারা কীভাবে একজন শিশুর মাঝে সময়ের সাথে আত্মমগ্ন হওয়ার হার বাড়তে থাকে তা পর্যালোচনা করে দেখেন। নেদারল্যান্ডে ৭ থেকে ১১ বছর বয়সী ৫৬৫ জন সন্তান ও তাদের মা-বাবার উপর এই গবেষণা করা হয়। ছয় মাস অন্তর অন্তর মোট চারবার তাদের উপর মনোবিদ্যা বিষয়ক নানা পরীক্ষা ও জরিপ চালানো হয়।
এই গবেষণায় মা-বাবা ও সন্তানদের নানা রকম প্রশ্ন করা হয়। এসব প্রশ্নের নানা স্তর ছিল, যেগুলো গবেষকদের তথ্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় যোগসূত্র স্থাপনে সহযোগিতা করে। অনেক প্রশ্নের মাঝে একটি হলো, “বাবা-মা তার সন্তানদের অন্যান্য বাচ্চাদের জন্য উদাহরণস্বরূপ মনে করেন কি না”। আবার সন্তানদের করা প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে– “তোমার মা-বাবা তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে একটু বলো”।
এসব প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে অনেক সাধারণ মনে হলেও প্রশ্ন করার কৌশল অনেক ভিন্ন ছিল। গবেষণায় পরীক্ষিত সন্তানদের মাঝে আত্মসম্মানবোধ ও আত্মমগ্ন হওয়া উভয়েরই পরীক্ষা করা হয়। অনেকে আবার মনে করতে পারেন, আত্মমগ্নতা আসলে আত্মমর্যাদারই ফুলে ফেঁপে ওঠা রূপ। কিন্তু গবেষকদের মতে ব্যাপারটি তা নয়।
আত্মমর্যাদাবোধ বা সেল্ফ এস্টিম এবং আত্মমগ্নতা বা নার্সিসিজম। উভয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বুশম্যান বলেছেন,
একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ নিজেকে অন্যদের মতোই ভাবে। কিন্তু একজন আত্মমগ্ন মানুষ মনে করে যে সে সবার ঊর্ধ্বে।
একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সন্তানকে অতিমাত্রায় মূল্যায়ন করা এবং তাদের প্রতি কোমলতা এক জিনিস নয়। ভাবুন, আপনার সন্তানের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলো। আপনি এক্ষেত্রে আপনার সন্তানের সাথে কেমন আচরণ করবেন? হয়তো আপনি তাকে বকাঝকা করবেন যাতে সে পরবর্তীতে ভালো করে। কিংবা তার সাথে কোমল আচরণ করে বোঝাবেন, আরো পরিশ্রম করতে হবে ভালো ফলাফল করার জন্য। কিংবা আপনি ধরে নেবেন যে, আপনার সন্তান আসলে খারাপ ফলাফল করতেই পারে না। সে অনেক ভালো শিক্ষার্থী। নিশ্চয়ই শিক্ষক তার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। এই তিনটি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকে সর্বশেষটিই আপনার সন্তানকে বেশি আত্মমগ্ন করে তুলবে। সে মনে করবে যে, সে-ই সঠিক। বাকি সবাই ভুল। তার এই বদ্ধমূল ধারণা ভবিষ্যতে তার ব্যক্তিত্বের সাথে পাকাপোক্তভাবে মিশে যাবে।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, আত্মমর্যাদাবোধ ও নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলো আলাদাভাবে বাচ্চাদের মাঝে গড়ে ওঠে। তাই কোনটা সন্তানদের প্রতি কোমলতা আর কোনটা বাড়াবাড়ি, তা অবশ্যই অভিভাভবকদের বুঝতে হবে। নার্সিসিস্ট মা-বাবার মাধ্যমে সন্তানদের মাঝেও এই মানসিক সমস্যা ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে মা-বাবার সন্তানদের প্রতি আচরণও এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। গবেষণায় দুটি দিকই আলোকপাত করা হয়েছে।
উক্ত গবেষণার আগে ব্রামেলম্যান, বুশম্যান এবং তাদের সহকর্মীগণ একটি জরিপ চালিয়েছিলেন। তারা কয়েকজন মা-বাবাকে তাদের সন্তান সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করেন। শিশুরা ছোটবেলায় তাদের পাঠ্যবইয়ে পড়ে থাকবে এমন জিনিস সম্পর্কে তাদের কাছে প্রশ্ন করা হয়। এই যেমন তাদের সন্তানেরা নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং ও শিশুদের জনপ্রিয় বই “অ্যানিমেল ফার্ম” সম্পর্কে জানে কি না। এসব পরিচিত নানা বিষয় ছাড়াও তাদের সামনে এমন কিছু নাম ব্যবহার করা হয়, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। গবেষকরা পরিচিত বিষয়ের সাথে কিছু অস্তিত্বহীন বিষয়, যেমন – “কুইন অ্যালবার্টা”, “দ্য টেল অফ বেনসন বানি” ইত্যাদি জুড়ে দেন। এই জরিপে দেখা যায়, কয়েকজন অভিভাবক অস্তিত্বহীন বিষয়গুলো সম্পর্কেও তাদের সন্তানদের জ্ঞান আছে বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়টি সরাসরি তাদের সন্তানদের নার্সিসিজমের দিকে ইঙ্গিত করে।
বাবা-মায়ের ভূমিকা ছাড়া যে একটি শিশু ছোটকাল থেকে আত্মমগ্ন হয়ে বড় হবে না কিন্তু নয়। গবেষকরা স্বীকার করেছেন যে, মা-বাবা জড়িত না থাকলেও বিভিন্ন বংশগতিজনিত কারণ ও ব্যক্তিত্ব বিষয়ক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সন্তানদের মাঝে নার্সিসিজম বা নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকার স্বভাব দেখা যায়।
তিন সন্তানের জনক বুশম্যান দাবি করেছেন, এই গবেষণা তার নিজ সন্তানদের বড় করার পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। তিনি বলেছেন,
১৯৯০ সালের দিকে প্রথম আমি এই গবেষণা শুরু করি। তখন আমি মনে করতাম, আমার নিজের সন্তানদের সাথে এমন আচরণ করতে হবে যেন তারা সবসময় নিজেদের অনেক স্পেশাল মনে করে। কিন্তু এখন আমি এ ব্যাপারে অনেক সচেতন।
বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, সন্তানদের পড়ালেখা ও মানসিক উন্নতির জন্য স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো নানা আলোচনা সভার আয়োজন করে। অভিভাবক দিবসগুলোতে ছেলেমেয়েরা কীভাবে পড়ালেখায় মনোযোগী হবে তা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা করা হয়। কিন্তু মা-বাবা কীভাবে সন্তানদের লালন-পালন করবে, তা নিয়ে তেমন কোনো সভা বা সেমিনারের আয়োজন করা হয় না, “প্যারেন্ট ট্রেনিং ইন্টারভেনশন” যেটাকে বলা হয়। বিভিন্ন দেশে সন্তানদের লালন পালন করার উপর অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত বলেই গবেষকরা মনে করেন। কারণ এরকমটি হলে অনেক অল্প বয়সেই শিশুরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে অধিকতর শ্রেয় হিসেবে ভাববে না।