খানিক আগেই জয়ীর সাথে কথা হলো বন্ধু নীলার। কলেজের বন্ধ শুরু হয়েছে। আজ সারাদিন শহরের রাস্তাঘাট চষে বেড়াবে দুজন, সারাদিন বাইরের খাবারে উদরপূর্তি করে আর কেনাকাটায় পকেটের টাকা-পয়সা সব শেষ করে তবেই ঘরে ফেরা হবে। দুই বন্ধুই খুব উত্তেজিত এই পরিকল্পনা নিয়ে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে না তুললে জয়ীর বের হতে ঠিক দুপুর গড়াবে, তাই সকাল হতে না হতেই ফোনে অস্থির করছে নীলা তাকে। জয়ীকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হতে পাঠিয়ে তবেই নীলা নিশ্চিন্ত হয়, ঘণ্টাখানেক বাদে জয়ীর বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে সে।
খুশি মনে নীলা যখন জয়ীর বাসায় উপস্থিত হয়, জয়ীকে দেখতে পায় ঘরের পোশাকে আলুথালু বেশে। তৈরি হওয়া তো দূরের কথা, মুখটাও না ধুয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে মেয়েটা। নীলার দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে জয়ী জানায়, তার আসলে ভালো লাগছে না, বের হতে চাচ্ছে না সে। নীলা হতবাক, এই তো এক ঘণ্টা আগেই তো কথা হলো দুজনের, জয়ীকে তো ফোনের ওপাশে হাসিখুশিই লাগছিলো! এখন এমন বিভ্রান্ত হয়ে গেলো কী করে জয়ী? জয়ীর পরিবারের লোকজনও কোনো কারণ জানাতে পারছে না তার এই আচরণের। কী হলো তবে এই এক ঘণ্টার ব্যবধানে? কেন মন পাল্টালো জয়ী?
জয়ী আসলে মন পাল্টায়নি। বরং মনই পালটে দিয়েছে জয়ীকে, ঐ সময়ের জন্য। এক ঘণ্টা আপাতদৃষ্টিতে খুব অল্প সময় ঠেকলেও আপনার মনের অলি-গলিতে মহাযুদ্ধ ঘটে যেতে একটা ঘণ্টা অনেকখানি সময়! এই যে এত দ্রুত মেজাজ বদলে যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণে থাকছে না নিজের মন, এই আপদের নাম জানেন কি? এটি হলো ‘মুড সুইং’, বাংলায় সোজাভাবে একে আপনি ‘দোল খাওয়া মেজাজ’ বলতে পারেন। ঠিক যেন, আজব একটা দোলনায় আপনাকে বসিয়ে দিলে এটি ক্রমাগত দোল খাবে, একবার নিয়ে যাবে ভালো কোনো অনুভূতির দিকে, তো পরমুহূর্তেই টেনে নেবে উল্টো দিকে, ভিন্নধর্মী এক অনুভূতির ভাগে।
মনের এক আজব অবস্থা
মুড সুইং খুব একটা অপরিচিত টার্ম নয়। মানুষের একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক পর্যায় এই মুড সুইং। যখন একজন মানুষের মেজাজে খুব দ্রুত পরিবর্তন হয় এবং হতেই থাকে, সেই অবস্থাকে মুড সুইং নামে অভিহিত করা হয়। যেমন ধরুন, আপনার মেজাজ এই ভালো তো এই বিগড়ে যাচ্ছে, কখনো হাসছেন তো পরক্ষণেই হতাশায় চুপসে যাচ্ছেন, ক্রমাগত বিপরীতমুখী সব আবেগের মুখোমুখি হচ্ছে আপনার মন; তবে বুঝে নিন, আপনি মুড সুইংয়ের অদ্ভুত অবস্থায় পড়েছেন। কেন হতে পারে এই মনের অসুখ, অসুখ সারানোর উপায়ই বা কী, সে বিষয়ক কথাবার্তায় নিয়েই সাজানো হয়েছে এই লেখাটি।
নারীরা ভুগছে বেশি মাত্রায়
চরম হাসিখুশি দিনেও আপনি আক্রান্ত হতে পারেন বিচ্ছিরি রকম মুড সুইংয়ে। নারীরা এই অসুখে ভোগে বেশি, তাদের বিশেষ শারীরিক অবস্থায় মারাত্মক পর্যায়ের মুড সুইং হতে পারে। বিশেষ শারীরিক অবস্থা বলতে মাসিকের সময় এবং গর্ভাবস্থাকে বোঝানো হচ্ছে। এসব দিনে শরীরে হরমোনের তারতম্য, পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি একজন নারীকে মুড সুইংয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
ভেদাভেদ নেই নারী-পুরুষে
তবে ভেবে নেবেন না যে, এই সমস্যা পুরোপুরিই নারীকেন্দ্রিক! ছাড় নেই পুরুষদেরও। মনের আবার নারী-পুরুষ ভেদাভেদ আছে নাকি যে, মনের অসুখ নারীতে আর পুরুষে ভিন্ন হবে! মুড সুইং হতে পারে যেকোনো মানুষেরই, এটি জীবনের খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
সমস্যার মাত্রা নির্ণয় করা জরুরি
সামান্য মুড সুইং খুব স্বাভাবিকভাবেই আসতে পারে যে কারো জীবনে, কাজেই তেমনটা নিজের মধ্যে টের পেলে উপেক্ষা করে যেতে পারেন। যখন এই দোল খাওয়া অস্থির মেজাজ আপনার স্বাভাবিক কাজকর্মে ঝামেলা পাকাচ্ছে না, খুব দীর্ঘ সময় ধরে আপনাকে জ্বালাতন করছে না এবং দ্রুতই আপনি আগের মতো স্বাভাবিক বোধ করা শুরু করছেন, বুঝে নিন সেটা ছিলো মুড সুইংয়ের সামান্য রূপ। তাকে পাত্তা না দিলেও চলবে। তবে পাত্তা দেবেন কখন? অস্থিতিশীল মেজাজ নিয়ে ভুগছেন এমন অবস্থা প্রায় সপ্তাহকাল পার করে গেছে, এর প্রভাব পড়ছে আপনার সব কাজকর্ম এবং সম্পর্কগুলোতেও, তবে বুঝে নিন যে ঘটনা গুরুতর। এই অবস্থায় আপনার পেশাদার কারো সাহায্য প্রয়োজন, যে এই সমস্যার সঠিক নির্ণয় করে সমাধানের পথ দেখাতে পারবে। সময়ের সাথে নিজে নিজেই সেরে যাবে, এতটাও সামান্য ব্যাপার না গুরুতর পর্যায়ের মুড সুইং। বরং কখনো কখনো যত দিন যায়, সমস্যার মাত্রা ততই বাড়তে থাকে।
নারীদের অধিক মুড সুইংয়ের কারণ
নারীদের কেন খুব বেশি মুড সুইং হয়? আর পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থাই বা কেন মুড সুইং ঘটাতে ভূমিকা রাখে? ভূমিকা যে কেন রাখে, তার যথাযথ নির্ণয় সম্ভব হয়নি। তবে সাধারণত মুড সুইং নারীদের শরীরে হরমোনের তারতম্য দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মাসিকের আগে এবং মাসিক চলাকালীন একজন নারী ভীষণ রকম মুড সুইংয়ে আক্রান্ত হতে পারেন। প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম কিংবা পিএমএস, এই জিনিসটি নারীদের মুড সুইংয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আর মাসিক চলাকালীন পুরো সময়টা জুড়েই একজন নারী মেজাজের এই জটিল চড়াই-উৎড়াই পার করতে পারেন। এই সময়ে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন শরীরে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, মুড সুইং ঘটার সেটি বড় একটি কারণ। তাছাড়াও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরায় খানিকটা হলেও ছেদ পড়ে এই সময়, যা সব নারী সহজে মেনে নিতে পারেন না। তখন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, চট করেই বিরক্তি পেয়ে বসে এবং কখনো প্রবল দুঃখবোধ হতে থাকে। তবে স্বস্তির কথা হলো মেডিটেশন, নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা এবং রোজকার জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন, এসব মাসিকের সময়কালীন মুড সুইং কিছুটা সহজে এড়াতে সাহায্য করে।
সাধারণ কিছু পিএমএস লক্ষণ হলো-
- খিটখিটে ভাব
- রাগ
- বিষণ্ণতা
- কান্না
- অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা
- উদ্বিগ্ন ভাব
- পর্যায়ক্রমিক বিষাদ ও রাগ
হবু মায়ের অস্থির মেজাজ
একজন নারীর আরেকটি বিশেষ শারীরিক অবস্থা হচ্ছে গর্ভাবস্থা, তার জীবনের সবচেয়ে দারুণ সময়গুলোর মাঝে একটি। এই সময়েই যেহেতু তার শরীরে সবচেয়ে বড় বদল আসে, বড়সড় মুড সুইংও আসবে সহজাতভাবেই। স্বাভাবিকভাবেই ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এক্ষেত্রেও, সাথে থাকে প্রজেস্টেরন হরমোন। এদের তারতম্য হবু মায়ের মেজাজেও চরম তারতম্য ঘটিয়ে দেয়, যা কিনা বাচ্চার হবু বাবা এবং অন্য আপনজনদের ঘাবড়ে দিতে পারে! প্রথম তিন মাসের সাইকেলে অর্থাৎ প্রথম ট্রিমেস্টারে বেশি মুড সুইং দেখা দেয় একজন হবু মায়ের, যা আবার ঘটে শেষ তিন মাসের সাইকেলে অর্থাৎ তৃতীয় ট্রিমেস্টারে।
শারীরিক এসব জটিল প্রক্রিয়া বাদেও হবু মায়ের মনে চলে আরো জটিল সব চিন্তা-ভাবনা। সে একজন ভালো মা হতে পারবে কিনা, বাচ্চা সুস্থ থাকবে কিনা, বাবা-মা হিসেবে বাচ্চাকে ঠিক মত লালনপালনে তারা সক্ষম কিনা, এসব প্রশ্নের জাল বুনে চলেন একজন গর্ভবতী নারী। আর তখন আরো বেশি করে মুড সুইংয়ে আক্রান্ত হতে পারেন তিনি।
মুড সুইং সম্পর্কে সচেতন থাকলে গর্ভাবস্থার নাজুক সময়েও একজন নারী সহজে মোকাবেলা করতে পারবেন এই সমস্যার। সঙ্গীর সাথে বেশি সময় কাটানো, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ঘুম, স্বাভাবিক কাজকর্ম, হাঁটাচলা, আপনজনদের সাথে সময় কাটানো ও তাদের সাথে ঘুরতে যাওয়া এবং নিজেকে একা মনে না করা, এগুলো একজন গর্ভবতীর আবশ্যক কাজের তালিকায় পড়ে। মুড সুইং নামের ঝমেলা অনেকটাই কমে যাবে এতে।
সমস্যা দেখা দিলেই সচেতন হওয়া চাই
যেহেতু মুড সুইং নামের এই আপদ পেয়ে বসতে পারে যে কাউকেই, তাই সচেতনতার দায়িত্ব কেবল নারীদের নয়, সকলেরই। আপনি খোশমেজাজের একজন নিপাট ভদ্রলোক, জীবনে মন খারাপ খুব কমই হয়, মেজাজ আপনার ভীষণ রকম নিয়ন্ত্রণে, সেই আপনাকেও কাবু করে দিতে পারে মুড সুইং। কাজেই সাবধান হতে শুরু করুন গুরুতর লক্ষণ নিজের ভেতর টের পাওয়ার সাথে সাথেই! হেলাফেলায় মনের ভেতর বড় অসুখ যেন বাসা না বানিয়ে বসে!
সাবধানতা কখন দরকার?
- নিজের ক্ষতিসাধন করতে চাচ্ছেন, জীবন শেষ করে দেয়ার চিন্তাও আসছে কখনো কখনো।
- বন্ধুবান্ধব, আপনজনদের এড়িয়ে যাচ্ছেন, কাজ করতে এমনকি চলাফেরা করতেও অনীহা হচ্ছে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে।
- মানুষের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না, কোনো অপ্রীতিকর আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন।
এসব লক্ষণ আবিস্কার করল এবার একটু সামলে চলুন, হয়তো আপনার চিকিৎসকের সাহায্য প্রয়োজন!
যেমন করে কাটিয়ে উঠতে পারেন মুড সুইং-
- সময়সূচী মেনে চলার অভ্যাস করুন
- ব্যায়াম একটি ভালো উপায় মানসিক চাপ কমানোর
- পর্যাপ্ত ঘুম অত্যাবশ্যক
- খাদ্য তালিকা হোক সুষম
- যোগ ব্যায়ামে আসবে মনের প্রশান্তি
- মানসিক পীড়া পাশ কাটান যতটা সম্ভব
- গুটিয়ে না থেকে নিজেকে প্রকাশ করতে শিখুন
- একজন অন্তত মানুষ আপনার থাকা চাই, হোক সে বন্ধু বা পরিবারের কেউ, কিংবা জীবনের বিশেষ সেই মানুষটি যার কাছে মন একদম মেলে ধরতে পারবেন
বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে কিনা এখনো মনের অসুখ নিয়ে মাথা ঘামানোটা আদিখ্যেতার সমান, সেখানে মুড সুইংয়ের ব্যাপারে সচেতনতাও ব্যাপক আকারে দেখা যাবে না। তবুও আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকেই চেষ্টা করে যেতে পারি একটু যাতে অবস্থা পাল্টায়। শরীরের রোগের পাশাপাশি মনের দিকটাও খেয়ালে আসুক মানুষের। মন তো ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভালো-মন্দ মনেরও থাকে, অসুখ তারও হয়, বরং শরীরের চেয়েও নাজুক রকম অসুখ হতে পারে আমাদের মনের। তাই খানিক যত্ন করি না কেন আমরা নিজেদের মনের, ক্ষতি তো নেই!