ইদানিং ওজনটা কেবল বেড়েই চলেছে ফয়সালের। তার গোলগাল ভুড়িতে হাত বুলিয়ে মজা নিচ্ছে বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মী সবাই। খাবারের বেলায় ফয়সাল বাছবিচার কমই করে, তবে একেবারে বেহিসাবি কখনোই হয় না। আর এই ওজনবৃ দ্ধির ঝামেলাটা এতদিন ছিলো না। সাতাশ বছর বয়সে যদি মেদভুড়ি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়া লাগে, এর চেয়ে বড় হতাশা কী আর হবে!
পুরো বিপরীত চিত্র নিয়ে ঝামেলায় আছে সুস্মিতা। পাটকাঠি নামখানা যে তার আসল নামকে ছাপিয়ে গেছে! হবেই না বা কেন? বয়স বেড়েছে তার, স্বাস্থ্য নয়। প্রায় স্থির ওজন নিয়ে তাই পাটকাঠিই রয়ে গেছে সুস্মিতা। শরীরের যত্নে ঠিক কী করবে, কীভাবে চলবে, তা-ই নিয়ে চিন্তার রেখা দেখা যায় ফয়সাল আর সুস্মিতার কপালে। স্বাস্থ্য নিয়ে বিপাকে পড়ে রয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় কিন্তু!
স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দিতে গেলে জীবনটাকে মিলিটারি শাসনের মতোন কঠিন নিয়মের বেড়াজালে আটকাতে হবে, তা কিন্তু নয়। এই কাজে দরকার আপনার দৃঢ় ইচ্ছা, মনোবল, আর কিছু কৌশল যা আপনাকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার দিকে নিয়ে যাবে। হুট করেই আপনি কফির নেশা ছেড়ে দেবেন না, কিংবা রাতজাগা পাখি থেকে ভোরের ঘুমভাঙানি পাখি হবেন না, এই প্রক্রিয়াটা সময় নেবে অনেকখানি। এবং শুরুতেই এটা জেনে রাখুন, পুরোপুরি স্বাস্থ্যকর জীবনে ঢুকে পড়ার বাধ্যবাধকতাও নেই আপনার। তাহলে কী করবেন? এই প্রতিবেদন কিছু এমন নিয়মই জানাচ্ছে, যা আপনার জীবনযাত্রাকে খুব কঠিন না বানিয়েই স্বাস্থ্যকর করে তুলতে শেখাবে।
৮০/২০ শতাংশের সহজ সূত্র
জীবনে অনিয়ম থাকবে, সেটাই বরং অনেক বেশি ‘নিয়ম’ আমাদের জন্য! কিন্তু তাই বলে অনিয়মের পাল্লাটাকে বেশি ভারী করে ফেলতে নেই। তাহলে গোটা জীবনটা অসুস্থতায় ভরে যেতে পারে কিন্তু! কেমন হয় যদি নিয়ম আর অনিয়মের একটা মিশ্র জীবন বেছে নেয়া যায়?
শতকরা আশি ভাগ মেনে চলুন স্বাস্থ্যকর জীবনের সূত্র, আর বিশ ভাগ চলতে দিন অনিয়মের স্বেচ্ছাচার। তাতে বিশেষ ক্ষতি নেই। প্রতিদিন দুই বেলা ক্যাফেইনের অভ্যাস আপনার, ভাজাপোড়ায় রুচি থাকে দিনের যেকোনো প্রহর। অবশ্যই এগুলো আপনাকে অসুস্থ করে ফেলবে একসময়, কিংবা নিয়মিতই অসুখের সাথে লড়তে হবে আপনাকে। এই অভ্যাসগুলোকেই ৮০/২০ সূত্রের আওতায় আনুন। সপ্তাহে চৌদ্দটা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়ের সংখ্যাটা নামিয়ে আনুন তিন কিংবা চারে, খুব একটা অসম্ভব কিছু নয়। খাবারের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই। সপ্তাহের যেকোনো দু’দিন অস্বাস্থ্যকর খাবার চলতে দিন, বাকি পাঁচদিন শরীরের খেয়াল রেখে সঠিক খাদ্য গ্রহণ করুন। এভাবে চললে নিজেকে খুব কঠিন নিয়মের জালে বন্দী অনুভব করবেন না। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মানেই শাস্তি, এমনটা লাগবে না আর।
শরীরচর্চা চলুক যেকোনো উপায়ে
শরীরচর্চায় আলাদাভাবে প্রতিদিন সময় ব্যয় করছেন? জিমে যাচ্ছেন বা জগিং হচ্ছে রোজ সকালেই? তাহলে তো বেশ ভালো! কিন্তু এই সময়টুকু ক’জনের হয়? বেশিরভাগ মানুষই রোজকার কর্মব্যস্ত দিনলিপিতে শরীরচর্চার সময় বরাদ্দ করতে পারেন না। সময় নেই, ধৈর্য নেই, বাড়তি সময় বের করার তাড়না নেই; আর এতসব ‘নেই’ এর ভিড়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে নিজের শরীরটাই! কাজেই, দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই কিছু ছোটখাট অভ্যাস গড়ে তুলুন যা শরীরচর্চার পরিপূরক হবে। শুরুটা করুন বহুতল ভবনের উপরতলায় উঠতে লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করার মাধ্যমে। খুব প্রয়োজন হলে তবেই লিফটে চড়ুন। এই যেমন, আপনি মিটিং ধরতে চাচ্ছেন অথবা রাগী স্যারের ক্লাসটা শুরু হয়ে যাচ্ছে বলে! নিজের গাড়িতে যাতায়াত যাদের, তারা সম্ভব হলে গন্তব্য থেকে খানিক দূরে গাড়ি থামান। কিছুটা পথ হেঁটেই চলুন। বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলায় অংশ নিন, অল্প দৌড়ঝাঁপ হোক। শরীর ভালো থাকবে।
শরীরচর্চার অংশ হিসেবে বেছে নিন এমন কোনো কাজ যা মজাদার। কোন কাজটা আপনাকে আনন্দ দেয়, যা একই সাথে আপনার দৈনন্দিন শরীরচর্চায় সহায়ক, খুঁজে বের করুন। ঘরের টুকিটাকি কাজের ফাঁকে এক দফা নাচ চলতে পারে, কিংবা সাইকেল নিয়ে আধ ঘন্টা ঘুরে আসা, যেকোনো কিছুই হতে পারে আপনার মজাদার ব্যায়াম। মূল সূত্রটা হচ্ছে, বেশিরভাগ সময় নিজেকে সচল রাখুন, স্থির থাকার সময় কমিয়ে আনুন। অন্যভাবে এটাও বলা যায় যে, অযথা বসে থেকে গায়ে চর্বি জমাবেন না!
অবাস্তব চিন্তা-ভাবনাকে প্রশ্রয় নয়
বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা রাখুন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মানেই হয় সবকিছু, নয় কিছুই না, এমনটা তো নয়! চিনি একদম ভুলে যাবেন, তেল বাদ দিয়ে দেবেন, এসব হাস্যকর চিন্তাভাবনা বাদ দিন বরং। সব মিলেমিশেই জীবন, ভালো অংশগুলো কীভাবে বেশি রাখা যায় তা-ই ভাবা উচিত। স্বাস্থ্যের বারোটা বাজানো প্রিয় খাবারগুলো একবারে ছেড়ে দেয়ার পণ করবেন না। কমিয়ে আনুন ধীরে ধীরে। সেই আশি/বিশ শতাংশের নিয়ম মাথায় রাখা চাই সবসময়।
রাতের বেলায় ফ্রিজে রাখা আইসক্রিমের বাটিতে হামলা চলে প্রায়ই? পরিমাণ কমিয়ে দিন। বড় বাটির বদলে ছোট বাটি বা কাপে নিয়ে খান। কখনো দই খেয়ে দেখুন আইসক্রিমের বদলে। বিকল্প কিছু না কিছুর অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। রাতারাতি কিছুই হয়ে যায় না, আর তাই আপনার চেষ্টাও যেন বাড়াবাড়ি না হয় সেই খেয়াল রাখা জরুরি। সুস্বাস্থ্য একদিনের প্রতিযোগিতা নয় যে জীবন-মরণ পণ করে জিতে নিলেন।
মনোবল বড় বল
মনোবল বৃদ্ধি করুন। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রেই মনোবলের বিকল্প হয় না। আপনি মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে যা ধারণ করবেন, কর্মফল অনেকটাই তার উপর নির্ভর করবে। যদি কাজের শুরুতেই নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে থাকেন, তাতে সাফল্য বাধাগ্রস্ত হবে। বিপরীত দিকে, সাফল্যের চিন্তা করাটা ভীষণই ইতিবাচক ব্যাপার। তাতে সত্যিকার অর্থেই সফল হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকখানি নিয়মতান্ত্রিক আর একটুখানি অনিয়মের যে জীবন বেছে নিয়েছেন, তার প্রতি প্রসন্ন থাকুন। শরীর ও মনের উপর এই জীবনযাপনের ভালো প্রভাবগুলো চিহ্নিত করুন। তাতে মনোবল আরো বাড়বে, স্বাস্থ্যকর জীবনের প্রতি পদক্ষেপ দৃঢ় হবে আরো।
প্রতিটা পরিবর্তন উপভোগ্য হোক
ছোটখাট অর্জনগুলোকে প্রাধান্য দিন। বেশি পরিমাণে পানি করার পর থেকে ত্বকে অনেক সজীবতা লক্ষ্য করছেন না? কিংবা, ইদানিং সিঁড়ি ব্যবহার করাটা আগের চেয়ে অনেক কম বিরক্তিকর লাগে না? আজকে দুপুরের খাবারে বিরিয়ানির বদলে ভাত খেয়েও তৃপ্তি হয়েছে, তাই না? নিজের মধ্যেকার এসব পরিবর্তনকে স্বাগত জানান। যেসব পদক্ষেপ আপনাকে একটা স্বাস্থ্যকর সুন্দর জীবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেসব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন।
খুঁজে নিন নিজের প্রেরণা
ভালো কাজের জন্য বাহ্যিক অনুপ্রেরণা দরকার পড়ে অনেক সময়। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার প্রতি অগ্রসর হওয়ার মতো কর্মযজ্ঞে! এই যেমন, একা হাঁটতে একটুও ভালো লাগছে না, হয় না এমন? কিংবা, সবাই লিফটে চড়ছে তো আপনিই একা সিঁড়ি বাইবেন কেন? আপনাকেই কেন লালশাক আর পটলের ঝোলে এই বেলাটা খেয়ে উঠতে হবে? এরকম অভিমানী কুমন্ত্রণা ভেতর থেকে আসে বটে! আর তাই, নিজের কর্মযজ্ঞে সঙ্গী বেছে নিন বন্ধু অথবা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে। এমন কাউকে খুঁজুন যে আপনার মতোই জীবনযাত্রায় বদল আনতে চাচ্ছে। আর তারপর, মিলেমিশে শাক-সবজি খান এবং সিঁড়ি দিয়ে চলাচল করুন! পরিবার আর বন্ধুদের কাছে নিজের পরিকল্পনা খুলে বলুন। তারা আপনাকে উৎসাহিত করতে পারে, বাহবা দিয়ে এবং কখনো একটু জোর করেও আপনাকে লক্ষ্যের প্রতি আরো উদ্বুদ্ধ করতে পারে তারা। তাছাড়া, আপনার সুস্বাস্থ্য কেবল আপনার জন্যই, তা তো নয়। আপনজনদের জন্যেও প্রিয় মানুষের স্বাস্থ্যকর জীবন খুব জরুরি।
বাজে অভ্যাসকে বিদায় জানান চিরতরে
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে খেয়াল থাকছে না আপনার। সকালের নাস্তাটা বাদই দিচ্ছেন কাজের তাড়ায়, আবার বাইরে থাকছেন বলে দুপুরের খাবারে চলছে স্ন্যাকস। শরীর ক্লান্ত, চোখ জড়িয়ে আসছে অথচ ঘুমোতে যাচ্ছেন না। হয় কাজ নিয়ে বসে আছেন, কিংবা কোনো মুভি দেখার আয়োজন চলছে, বা স্রেফ অনলাইন আড্ডায় বুঁদ হয়ে আছেন। এদিকে শরীরটা যে ভেঙে চলেছে, তার বেলা?
এড়িয়ে চলুন এই সকল অভ্যাস যা আপনাকে প্রতিনিয়ত শারীরিকভাবে দুর্বল করছে। এসবের মারাত্মক ফল আপনার শরীর ভোগ করে চলেছে। একটা সময় অনেক চেষ্টা করেও সুস্থ শরীরটা ফিরিয়ে আনা যাবে না আর, সচেতন হন সময় থাকতেই। আপনার সামান্য সচেতনতা এসব ক্ষতিকর অভ্যাসকে কমিয়ে আনবে, যদি সত্যিই আপনার মনে সুন্দর একটা জীবনের ইচ্ছা থেকে থাকে।
আর এভাবেই ছোট ছোট পদক্ষেপে চূড়ান্ত অনিয়মের জীবনেও সুস্বাস্থ্যের বার্তা নিয়ে আসা সম্ভব। দরকার আপনার অদম্য ইচ্ছা, আর সত্যিকারের চেষ্টা!
ফিচার ইমেজ: Hosbeg.com