বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই সাধারণ একটি ঘটনা হলো প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়া। ঝামেলা শুরু হয় গ্রুপের সদস্য নির্বাচন থেকে শুরু করে কে প্রেজেন্টেশন স্লাইড বানাবে সেটা নিয়েও। প্রায়ই দেখা যায়, কাকে নেয়া হবে আর কাকে নেয়া হবে না এই নিয়ে চলে চরম মনোমালিন্য। কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে গ্রুপ তো হলো বটে, কিন্তু স্লাইড কে বানাবে? অমুক ভাবছে তমুক বানাক, তমুক আবার ভাবছে আরেকজন বানাক। এভাবে পুরো সপ্তাহ পার (ক্ষেত্র বিশেষে পুরো মাস পার!) হওয়ার পর প্রেজেন্টেশনের আগের রাতে শুরু হয় চূড়ান্ত ঝগড়াঝাঁটি। এরপর রাগের মাথায় কেউ একজন যেচে দায়িত্ব নিয়ে আবারও কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে স্লাইড বানিয়ে প্রস্তুত করা হয় প্রেজেন্টেশন।
বলা বাহুল্য, এরকম ঘটনা শুধু যে প্রেজেন্টেশনেই ঘটে তা নয়, দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনাতেই এরকম লেজেগোবরে অবস্থা তৈরী হয় শুধু ভালোভাবে ‘টিমওয়ার্ক’ করতে না পারায়। ‘মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে আমাদেরকে সবাই মিলে মিশে বাস করতে হয়’ এই আপ্ত বাক্য তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের মাধ্যমে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হলেও হাজারটা দরকারি অভ্যাসের মতো এটাও আমাদের স্বভাবে আসে না।
এ জাতীয় সমস্যা সব বয়সের মানুষের সাথে সব জায়গাতেই হয়। টিমওয়ার্কে অদক্ষতা এখানে একটি সমস্যা তো বটেই, মূল সমস্যাকে মনোবিদ্যায় বলা হয় ‘Diffusion of responsibility’, এটি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা যা দলগতভাবে থাকার সময় মানুষ অনুভব করে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় এগিয়ে এসে প্রতিরোধ করা বা না করা নিয়ে মানুষ যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে, সেটাই হলো Diffusion of responsibility।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, সমুদ্র সৈকতে বালিতে বসে আছেন। আপনার চারপাশে আরো অনেকেই আছে। কোনো ব্যক্তি হয়তো শার্ট-প্যান্ট সাগরপাড়ে রেখে পানিতে নেমেছেন। এমন সময় কেউ একজন ফেলে রাখা প্যান্ট থেকে মানিব্যাগ বের করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আপনি কী করবেন সেই মুহূর্তে? হয়তো চোখ বড় বড় করে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবেন এবং নিশ্চিত থাকুন, এভাবে অনেকেই তাকাবে। কিন্তু সশরীরে বাধা দিতে কেউ এগিয়ে আসবে কিনা বলা মুশকিল।
এবার ধরুন, ঐ জায়গায় আপনি একাই আছেন এবং আপনি চোরকে দেখলেন মানিব্যাগ বের করতে। এ ক্ষেত্রে এই সম্ভবনাই বেশি যে আপনি দরকারি কাজটাই করবেন, যেমন চিৎকার করে চোরকে ধমক দেওয়া বা ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে হয়তো উঠে গিয়ে বাধাও দেবে। এর কারণ আর কিছুই না, আশেপাশে কেউ না থাকাতেই আপনাকে উদ্যোগী হতে হয়েছে।
আশেপাশে আরো কিছু মানুষ থাকলে যেটা হতো, আপনি ‘Diffusion of responsibility’-তে ভুগতেন। অর্থাৎ আপনার তখন মনে হতো ‘এটা তো শুধু আমার দায়িত্ব না, আশেপাশে তো আরো মানুষ আছে, কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে’। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ফলে দেখা যায় কেউই এগিয়ে আসে না শেষ পর্যন্ত। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেকোনো জায়গায় অপরাধ সংঘটনকালে যত বেশি সংখ্যক মানুষ সেখানে উপস্থিত থাকে, আপনার সহযোগীতা পাওয়ার সম্ভবনা ততই কমে যায়।
এতক্ষণ মনোবিদ্যার এই তত্ত্ব আওড়ানোর মূল কারণ হলো এই একই মানসিক অবস্থা শুধু যে অপরাধ সংঘটনকালে দেখা যায় তা নয়। এটা টিম ওয়ার্কের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অর্থাৎ ‘আমি কেন শুরু করব, সে-ই করুক না’। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এই শিকল ভাঙতে না পারলে সবসময় ঐ আগের রাত্রের ঝগড়ায় সমাধান খোঁজা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ‘এ শিকল ভাঙবো মোরা কেমন করে?’ আমাদের ছাত্রজীবনে টিমওয়ার্কের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না বা সেভাবে শেখানোও হয় না। ক্লাসে শিক্ষক কখনো নিজে থেকে তার পছন্দ অনুযায়ী রোল নম্বর অনুযায়ী একটি দল তৈরী করে দেন অথবা বলে দেন ইচ্ছানুযায়ী চার সদস্যের দল বানিয়ে কাজ জমা দিতে। ইচ্ছানুযায়ী দল বানাতে বললে আমরা যেটা করি তা হলো ঘনিষ্ঠ ৪ বন্ধু মিলে দল বানিয়ে ফেলি। ঘনিষ্ঠতার ফলে এখানে আপনাতেই কিছু ঝক্কি কমে আসে, কিন্তু এখানেও প্রকৃত টিমওয়ার্ক হয় না। কারণ ঘনিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে সাধারণত একজনের দায়িত্ব আরেকজনের ঘাড়েই চাপানো হয়।
আবার যখন দলে বন্ধুবান্ধব বাদে অন্য কেউ আসে তখন সংঘাত আর অসহযোগীতাই যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু টিমওয়ার্কের মূল পরীক্ষাটা এই জায়গাতেই। কিছু কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো টিমওয়ার্কে বাধা তৈরী করে; যেমন ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উদার মানসিকতার অভাব, বৈচিত্রে বিশ্বাস না থাকা, অবিশ্বাস এবং লক্ষ্য সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা। কীভাবে এগুলো কাটিয়ে ওঠা যায় এ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. উদার হোন
ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটি আপনাকে অর্জন করতে হবে দলের বাকিদের সাথে নিয়ে। নিজের স্বার্থ নিয়ে মেতে থাকলে আপনি নিজেও ব্যর্থ হবেন। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করতে শিখুন এবং সবাইকে নিয়ে চলুন।
সামরিক একাডেমিতে কঠোর প্রশিক্ষণের সময় ক্যাডেটরা একাধিক দল হিসেবে চলেন, প্রশিক্ষকেরা প্রতিটি দলের নম্বর মূল্যায়ন করেন একতাবদ্ধ হয়ে কোনো কাজ সম্পন্ন করার উপর। যে কারণে কোনো ক্যাডেট যদি আহত হয়ে অচল হয়ে পড়ে, দলের বাকী সদস্যদেরকে তাকে বহন করতে হয়, কারণ সবাই মিলে শেষ লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারলে পুরো দলকেই অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। এভাবেই দলগতভাবে চলতে শিখে ক্যাডেটরা সৈনিক হয়ে ওঠে। এ সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে কখনোই আহত সহযোদ্ধাকে পেছনে ফেলে আসে না।
২. বৈচিত্র্যে আস্থা রাখুন
টিম ওয়ার্কে একটি সাধারণ ঘটনা হচ্ছে ‘অমুক যদি এই দলে থাকে তবে আমি থাকবো না’। বলা বাহুল্য, শিক্ষাজীবনে এ ধরনের গোয়ার্তুমির সুযোগ থাকলেও কর্ম জীবনে তা থাকে না, ফলে অফিসে বাধ্য হয়েই অপছন্দের লোকের সাথে কাজ করতে হয়। অথচ আপনি যদি শিক্ষাজীবন থেকেই অভ্যাসটি গড়ে তোলেন তাহলে কর্মজীবনে এসে একে আর ঝামেলা বলেই মনে হবে না।
আপনি হয়তো ভাবছেন দলে শুধু বহির্মুখী ধাঁচের লোক নেবেন যারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে চটপটে হবে। কিন্তু ভেবে দেখুন, অন্তর্মুখী ধাঁচের মানুষ বুদ্ধি ও চিন্তাশীলতার মাধ্যমেও অবদান রাখতে পারে।
৩. বিশ্বাস গড়ে তুলুন
ইংরেজীতে একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘Don’t let the one apple spoil the bunch’ অর্থাৎ একটি আপেল খারাপ হলে পুরো ডাল ধরে বাদ দেওয়ার মানে হয় না। দলের একজনের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে সবার মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। দলের সদস্যদের ভেতর বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুললে কাজে গতি আসবে।
৪. সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি থাকুন
কাজের চাপে মাথা খারাপ অবস্থা, তার উপর মতবিরোধ (যেটা খুবই স্বাভাবিক)। এরকম পরিস্থিতিতে তীব্র বাদানুবাদ না চালিয়ে বিরতি নিন, ৫ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়ে খোলা বাতাসে দাঁড়ান, তারপর ফিরে আসুন। ফিরে এসে আবার শুরু করুন, চাপমুক্ত হয়ে আবার দলের সদস্যের সাথে আলোচনায় যোগ দিন।
৫. লক্ষ্য ঠিক করুন ও কাজ বন্টন করে নিন
সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য ঠিক করে নিন অর্থাৎ কী করতে চান এবং সব শেষে কে কী কাজ করবে তা ভালোভাবে বন্টন করে নিন। টিম ওয়ার্কের সার্থকতাই হলো একটি কাজ সবাই মিলিতভাবে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা, যেটা কিনা এককভাবে কোনো ব্যক্তির করতে চার-পাঁচ গুণ বেশি সময় লাগতো।
শুরুতে দেয়া উদাহরণটি এখানেও প্রাসঙ্গিক। প্রেজেন্টেশন স্লাইড বানানোর জন্য সবাই সশরীরে উপস্থিত না হলেও সমস্যা নেই, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এখন সশরীরে না থাকলেও চলে। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ খুলে সেখানেই কাজ শুরু করে দিতে পারেন। প্রেজেন্টেশনের জন্য প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয় ঠিক করে নিন, এরপর বিষয়ানুযায়ী নিজের স্লাইড নিজে বানিয়ে গ্রুপে পাঠিয়ে দিন।
একজন দায়িত্ব নিয়ে (সেটা হতে পারে আপনিও) প্রত্যেকের স্লাইডগুলো জড়ো করে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রেজেন্টেশন স্লাইডে রূপ দিন। অ্যাসাইনমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন ‘গুগল ডক’, দলের সদস্যরা যার যার ঘরে বসেই একটি গুগল ডক ফাইলে টাইপ করে লিখে ফেলতে পারেন অ্যাসাইনমেন্টের নিজের অংশটুকু। আর এভাবেই যে যার জায়গা থেকে জন্ম দিলো একটা সফল টিমওয়ার্ক।
ফিচার ছবি- EGN Thailand