ইন্ট্রোভার্টনেস বা ইন্ট্রোভার্সন বা অন্তর্মুখিতা একধরনের মানসিকতা, যা কোনো ব্যক্তির নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখার স্বভাবকে নির্দেশ করে। অনেকেই এই অন্তর্মুখিতাকে কারো লাজুকতা হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু লজ্জা এমন একটি ব্যাপার, যা এমন একধরনের ভয়ের মতো যে- “পাছে লোকে কিছু বলে”! অপরদিকে, অন্তর্মুখিতা হচ্ছে নিজে থেকেই নিজেকে লুকানোর স্বভাব।
এ মানুষগুলো সহজে কারো সাথে মিশতে চায় না বা যায় না। তারা যেতে যায় না কোনো অনুষ্ঠানে। গুটিকয়েক মানুষের সাহচর্যে থাকতেই পছন্দ করে এরা। তবে এদের একদম বোকা ভাবা চলবে না। কারণ সৃজনশীলতা কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এরা অনেক সময়ই বহির্মুখীদের ছাড়িয়ে যেতে পারে। চলুন তবে জানা যাক এমন কিছু বৈশিষ্ট্য, যেগুলো থাকলে আপনি ইন্ট্রোভার্ট কিনা বোঝা যেতে পারে।
একা সময় কাটানো উপভোগ করা
‘ইন্ট্রোভার্ট’ শব্দটির মাঝেই লুকিয়ে আছে নিজেকে গুটিয়ে রাখার প্রবণতা। তাই একজন ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি নিজের একাকীত্বকে উপভোগ করেন। খুব ভালোভাবে বলতে গেলে, একাই অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এমনকি ছুটির দিনেও বাসায় শুয়ে-বসে অলস দিন কাটালেও একা থাকাই তার উদ্দেশ্য। বাসায় বসে টিভি দেখা, বই পড়া, আঁকাআঁকি কিংবা ইতস্তত কাজকর্মে দিন কাটাতেই তাদের বেশি ভালো লাগে।
কোনো ধরনের উৎসব বা অনুষ্ঠান, যেমন- কারো জন্মদিন বা বিয়ের অনুষ্ঠানে এদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। আর যদিও বা যায়, নতুন কোনো বন্ধু তৈরির উদ্দেশ্যে অবশ্যই না। হয়তো বেশিরভাগ সময়ই অনুষ্ঠানের কোনো এক কোনে বসে থেকে অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় চলে আসে। যদিও নিজের দুই-একজন বন্ধুর সাথে ঘুরতে যায় তারা, কিন্তু কিছু সময় ঘোরার পরেই তাদের মধ্যে চলে আসে একঘেয়েমি। একে বলা হয়ে থাকে ‘ইন্ট্রোভার্ট হ্যাং-ওভার’।
সহজে কোনো কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলা
ইন্ট্রোভার্টদের মনে এক আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা বাস করে, যে সব সময় এদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। কোনো সৃজনশীল কাজের চিন্তা মাথায় এলেই এই অন্তর্বাসী সত্ত্বাটি বলে দেয়, “তুমি এ কাজ পারবে না”। এই সত্ত্বার বিরুদ্ধে ইন্ট্রোভার্টদের জয়লাভ করা বেশিরভাগ সময়ই অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সহজেই সে তার কাজের উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং সে কাজে আর অগ্রসর হয় না। কিন্তু কয়েক দিন বা মাস বা বছর যেতেই তার কাছে মনে হয়, কী ভুলটাই না সে করেছে!
জনাকীর্ণ আলোচনায় উৎসাহ না পাওয়া
ইন্ট্রোভার্টদের প্রধান সমস্যা, এরা খুব সহজে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে না। হ্যাঁ, এদের মধ্যে বেশিরভাগই কিন্তু ভালো চিন্তাবিদ, কিংবা বেশ বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের এই চিন্তাভাবনা কেবল যখন একা থাকা হয়, তখনই সবচেয়ে বেশি প্রখর হয়। অথচ যদি কোনো আলোচনায় তারা যোগদান করে এবং সবার সামনে এসে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপারে তাদের পরামর্শ দিতে বলা হয়, তাহলে সেটি একটি সমস্যাই হয়ে ওঠে। এরা খুব ভালো শ্রোতা হতে পারে বটে, কিন্তু খুব সহজে সবার সামনে বক্তৃতা দিতে অস্বস্তিবোধ করে। এরা অবশ্যই ভালো বক্তা, যদি শ্রোতা হিসেবে দু-একজন ব্যক্তি থাকে। কিন্তু সবার সামনে নয়।
অনেক মানুষের ভিড়েও একাকীত্ব বোধ
অনেক মানুষের ভিড় যেখানে আছে, যেমন কোনো কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা মিটিং-মিছিল, সেখানেও নিজেকে একা বোধ করার ব্যাপারটা ইন্ট্রোভার্টদের স্বভাবজাত। কারণ এরা এক সময়ে একজন ব্যক্তির সাথে (খুব বেশি হলে দুজন) ঘনিষ্ঠ হতে পারে এবং সাধারণভাবেই যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কিন্তু জনতার মাঝে সে একাই থেকে যায়। এই ভিড়ে থাকার থেকে তার কাছে বরং বাসায় নিজের সাথে সময় কাটানোটাই সহজতর মনে হয়।
নতুন ও অপরিচিতদের সাথে সহজে মিশতে না পারা
অপরিচিত ব্যক্তিদের সাথে সংলাপ শুরু করার ব্যাপারে এদের আছে এক অন্যরকম জড়তা। এমনকি এরা পরিচিতদের সাথেও ছোটখাট কথা বলায় কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। আপনি হয়তো কোনো অপরিচিত ব্যক্তির পাশে বসে আছেন, কিন্তু আপনি কিছুতেই তার সাথে খুব সহজে পরিচিত হতে পারবেন না, যদি আপনি ইন্ট্রোভার্ট হয়ে থাকেন। প্রত্যেকবার মনের সেই অন্তর্বাসী সত্ত্বাটি আপনাকে বাধা দেবে। সেক্ষেত্রে আপনি নিজেকে শিখিয়ে নিতে পারেন এভাবে, নতুন মানুষের দিকে তাকিয়ে একবার হাসুন, আর তারপর শুরু করুন কথা বলা। একবার বলতে গেলেই বুঝবেন ব্যাপারটা কত কঠিন। আপনার মনে তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, আপনি ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রেও কি এমন হয়?
কথা বলার চেয়ে লিখতে বেশি অভ্যস্ত
একজন ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি কথা বলার চেয়ে লেখালেখিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। কারো সাথে ফোনে কথা বলার চেয়ে টেক্সট মেসেজেই এদের ভরসা বেশি। কিংবা নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে সবার সম্মুখে বলার চেয়ে, নিজের ডায়েরি বা নোটবুকে লিখে রাখাই এদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। আর এখানেই ইন্ট্রোভার্টদের আছে সাংবাদিকতা, জার্নাল, নাটক বা উপন্যাস লেখালেখির দারুণ সম্ভাবনা। ‘The Fault in Our Stars’ সিনেমাটির মূল উপন্যাসের রচয়িতা জন গ্রীন ছিলেন এরকমই একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতে,
“লেখালেখি এমনই জিনিস যা একা একাই করতে হয়। একজন ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি তার এই পেশার মাধ্যমেই আপনার সম্মুখে না দাঁড়িয়ে আপনার দৃষ্টি সংযোগ ছাড়াই আপনাকে গল্প শোনাতে পারে।”
পর্যবেক্ষণ শক্তি
কোনোকিছু পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এদের প্রখরতা একটু বেশি হয়ে থাকে। যদিও তারা গুটিয়ে থাকাই পছন্দ করে। কিন্তু কোনো ব্যাপারে কোনোকিছু অন্য মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও, এদের চোখে সেসব ধরা পড়ে খুব সহজে। যেমন এরা খুব সহজেই পাশের বন্ধুটির হাবভাবের সামান্য পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারে যে, তার বন্ধুটির মনে হতাশা চলছে নাকি তীব্র আনন্দ। রঙ, সুর কিংবা ছন্দের প্রতি এদের পর্যবেক্ষণও হয়ে থাকে অন্যরকম। ফলে এরা সহজেই ভাল চিত্রশিল্পী বা গায়ক হয়ে উঠতে পারে।
নিজের পছন্দের বিষয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া
বই পড়া বলুন, কিংবা ছবি আঁকা বা লেখালেখি- পছন্দের বিষয়ের প্রতি ইন্ট্রোভার্টদের অনুরক্তি অনেক বেশি। এরা ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়ে যেতে পারে কিংবা ছবি আকঁতে পারে। কাজের প্রতি এতোটাই মনোযোগ যে, তারা কখনো কখনো অন্য জগতেই যেন চলে যায়। বাইরে অনেক কিছু হয়ে যায়, দিনশেষে রাত আসে। কিন্তু এরা কাজ ছেড়ে উঠে যায় না। কারণ এদের একাকী থাকার সময় অসম্ভব রকমের মনোযোগ বেড়ে যায়। শখের কাজে এরা সবকিছু থেকেই বিমুখ হয়ে যেতে পারে।
কোনো কাজে ধৈর্য ও সৃজনশীলতার পরিচয়
কাজের ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সৃজনশীলতা ইন্ট্রোভার্টদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তারা যেমন অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে সহজে, এই জ্ঞানকে সৃজনশীল কাজে লাগাতেও তারা বেশ পটু। এরা অনেকটা ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ হুট করে কোনো কথা বলে না বা সিদ্ধান্ত নেয় না। বিষণ্নতা সহজে এদেরকে আক্রান্ত করতে পারে না। এরা সাধারণত খুব সহজে কাউকে বিশ্বাসও করে না এরা, কাজেই এদের বন্ধুর সংখ্যা সীমিত হয়ে থাকে।
একাকীত্ব ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য
ইন্ট্রোভার্ট মানুষগুলো যেমন একা থাকতে পছন্দ করে, তেমন মাঝে মাঝে এরা অনেক সামাজিক কাজের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে পারে। এর কারণ এরা স্বভাবসিদ্ধভাবে চারপাশের বিভিন্ন বিষয়ের প্রভাবে অতিমাত্রায় উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এরা এসব সামাজিকতায় বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং শেষে আবার নিজের নীরবতায় ফিরে আসে। অর্থাৎ সামাজিক কাজকর্ম ও একাকীত্বের মধ্যে একধরনের একান্তর ঘটে।
এছাড়াও আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন- জ্ঞানার্জনের প্রতি এদের বিশেষ অনুরক্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাব, বিশ্লেষণধর্মী মনোভাব কিংবা বিশ্বস্ত হওয়ার ক্ষমতা। এসব দোষ-গুণ ইন্ট্রোভার্টদের করেছে স্বতন্ত্র মানসিকতার এক মানুষ। খুঁজে দেখুন, আপনার মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কিনা? যদি থেকে থাকে, তবে নিজেকে মোটেও তুচ্ছ ভাববেন না। নিজের কাজ করে যান নিজের গতিতে।