কথিত আছে, একটা পুরো রাত ভাল্লুকের সাথে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সাথে দারুণ গোঁফের কাট আর বিরালের প্রতি ভালোবাসার জন্য নারীমহলেও ছিল সুখ্যাতি। কেজিবি ‘আর্গো’ নামের চর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল তাকে। আর সাথে লেখালেখির হাত তো ছিলোই। তবে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের শুধু লেখক হিসেবে বিখ্যাত নন। মানুষ হিসেবেও তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। বিশেষ করে, নিজের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য এবং মস্তিষ্ককে স্থবির অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য একরকম নিজের মতো দারুণ এক পথ বেছে নিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। এই উপায়ের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ইউজফুল ইন্টারেপশন’।
১৯৩৫ সালে এস্কোয়ার ম্যাগাজিনের জন্য দেওয়া নিজের এক সাক্ষাৎকারে ‘দিনে একজন লেখকের ঠিক কতটুকু লেখা উচিত’ এই প্রশ্নের উত্তরে হেমিংওয়ে বলেন, একজন লেখকের লেখার গতি খুব ভালো থাকলে এবং এরপর কী হবে তা জানা থাকলে সে সময় থেমে যাওয়া উচিত। এতে করে কখনোই লেখক তার কাজে স্থবির হয়ে যাবে না।
কিন্তু এই পদ্ধতি কি আসলেই কাজ করে? বছরের পর বছর ধরে হেমিংওয়ের এই যুক্তিকে এড়িয়ে গিয়েছেন সবাই। হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। ২০১৭ সালে হেমিংওয়ের এই পদ্ধতির কথা ইয়োশিনরি ওয়ামা জানার আগে অনেকটা অজানাই ছিল সবাই কাছে ব্যাপারটি। খুব একটা প্রচলিত ছিল না এটি। নিজের জীবনে এমন পদ্ধতি বারবার কাজ করার পর এই গবেষক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একই ঘরানার পদ্ধতিকে খুঁজে পান এবং এক বছর পরই কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ব্যাপারে গবেষণা চালান।
কাজ না শেষ করার পেছনে লুকিয়ে থাকা সফলতা
এই গবেষণার পেছনে থাকা একমাত্র ব্যাপারটিই ছিল এই যে, কোনো কাজ ভালো অবস্থায় শেষ না করলে সেটায় পরবর্তীতে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। হেমিংওয়ে যদিও কৌশলটিকে লেখকদের জন্য বলেছিলেন। গবেষকেরা এটি সবার ক্ষেত্রেই পরখ করে দেখার কথা ভাবেন।
লেখকের কৌশলের সাথে গবেষকেরা আরও দুটি শর্ত জুড়ে দেন। আর সেগুলো হলো- কাজটি প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে এমন অবস্থায় থাকতে হবে, এবং, কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে হবে, যাতে করে আপনি কাজটিতে পুনরায় ফিরে আসার আগ্রহ বোধ করেন।
ওয়ামা নিজের এই গবেষণায় স্নাতক পর্যায়ে থাকা মোট ২৬০ জন শিক্ষার্থীকে একটি বেশ কষ্টকর কাজ করতে দেন। এক্ষেত্রে তাদের পত্রিকা থেকে নির্দিষ্ট একটি অংশ কম্পিউটারে টাইপ করতে বলা হয়। কাজ শুরুর আগে সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তারা কাজটি করতে কতটা উৎসাহিত বোধ করছেন। কাজটি যখনই ২-১ জন শেষ করেছে বলে সংকেত দেয়, ওয়ামা সবাইকেই থামতে বলেন। এরপর সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তারা বাকি কাজটি শেষ করতে কতটা উৎসাহিত বোধ করছে। দেখা যায়, যাদের খুব অল্প কিছু কাজ বাকি তারা খুব দ্রুত কাজটি শেষ করতে চাইছে এবং কাজের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে।
মূলত, আমাদের মস্তিষ্ক কোনো কাজ শেষ করার কাছাকাছি থাকলে অসম্ভব ইতিবাচক অনুভব করে। ফলে কাজটি শেষ করার প্রতি এবং কাজে ফিরে যাওয়ার প্রতি আগ্রহও বেড়ে যায় তাদের। অবাক করা ব্যাপার হলো, যারা ইতিমধ্যেই লেখা শেষ করে ফেলেছেন তারাও আরও কাজ করতে উৎসাহিত বোধ করছিলেন।
জেস্টালিজম
এই পুরো ব্যাপারটিকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একভাবে ভেবেছেন। তবে এই ভাবনা এবং মানুষের ছেড়ে আসা অসম্পূর্ণ কাজের প্রতি যে আগ্রহ সেটা জন্মানোর পেছনে অন্য আরেকটি কারণও রয়েছে, যার নাম জেস্টালিজম। বিংশ শতকে অস্ট্রিয়ান এবং জার্মান কিছু মনোবিজ্ঞানীর তৈরি করা এই মতবাদ অনুসারে, আমাদের মস্তিষ্ক অসম্পূর্ণ কিছু সম্পূর্ণ করতে পছন্দ করে। একটি কাগজে যদি একটি অসম্পূর্ণ ত্রিভুজ আঁকা থাকে তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক সেটা সম্পূর্ণ করার কথা ভাবে সহজাতভাবেই। ঠিক তেমনই এই ব্যাপারটি কাজের ক্ষেত্রেও সত্যি। কাজ অসম্পূর্ণ থাকলে সেটার প্রতি আমাদের আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়।
গবেষকেরা উপরোক্ত দুটি কৌশলের সাথে সাথে আরেকটি পদ্ধতিও ব্যবহার করেন। সেখানে তারা ১৩১ জন শিক্ষার্থীর দলকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। এটা তারা করেন শুধু এটা দেখার জন্য যে, কোনো মানুষকে পরিকল্পনা করে কাজ করার সুযোগ থাকলে সেক্ষেত্রে সে বেশি উৎসাহিত বোধ করে, নাকি এমন কোনো প্রভাবই পড়ে না। দুই দলের মানুষকে নিজেদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত থাকা সমস্ত স্মৃতি লিখতে বলা হয়। একটি দলকে এই স্মৃতিকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত, এবং সেখান থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত- এভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে ভাগ করতে বলা হয়। অন্যদের এমন কোনো পরিকল্পনাই দেওয়া হয়নি। ঠিক আগের মতোই কাজ শেষ হওয়ার ঠিক আগে আগে তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তারা কাজটি শেষ করতে কতটা উৎসাহিত বোধ করছেন, বা কাজে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তারা কতটা আগ্রহী। দেখা যায়, যারা আগে থেকেই কোনো পরিকল্পনা ছাড়া কাজ শুরু করেছেন তাদের মধ্যে উৎসাহ অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম।
এরকম গবেষণা কিন্তু এবারই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে গবেষক ড্যানিয়েল কুপর বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে কাজের মধ্যে কোনোরকম বাধা আসলে এর ফলাফল কী হয় সেটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্ট্যানফোর্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগীদের নিয়ে পরিচালিত এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি চলচ্চিত্রের কিছুটা দেখে হাসির অংশের মাঝখানে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর পর পরই সবাইকে অনলাইন শপ থেকে কিছু কিনতে বলা হয়। দেখা যায়, যাদেরকে চলচ্চিত্রের কিছুটা অংশ দেখান হয়েছে তারা খুব একটা না দেখেই পণ্য কিনে ফেলছেন। অন্যদিকে বাকিরা সহজে কিছু কিনতে পারছেন না। বরং তারা একের পর এক পণ্য দেখে যাচ্ছেন।
এর কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলেন, কোনো একটি কাজে বাধা দেওয়ার ফলে একজন মানুষের মধ্যে অন্যান্য কাজ দ্রুত করার প্রবণতা বেড়ে যায়। কাজ করার আগ্রহ বাড়ে। অবশ্য, এমন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে তাতে ভুলের পরিমাণ বেশি থাকে এবং পরবর্তীতে এ নিয়ে মানুষ অনুশোচনায়ও ভোগেন বলে মনে করেন গবেষকেরা।
তবে তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনি বারবার কাজ থেকে উঠে যাবেন। যখন আপনার কাজটি সম্পর্কে আপনি ভালোভাবে জানেন, তখনই বিরতি নিন। ওয়ামার মতে, এই পদ্ধতিতে অন্যান্য কাজে তো উৎসাহ বাড়ানো যায়ই, বিশেষ করে পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে এটি অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
হেমিংওয়ে যদিও বলেছেন, এই বিরতি হতে হবে নিজের তৈরি। কাজ যদি থামাতে হয়, তাহলে সেটা নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থামাতে হবে। তবে বর্তমানে গবেষকেরা মনে করছেন, নির্দিষ্ট সময়ে বিরতির ব্যবস্থা রেখে কর্মী ও শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম বাড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যবস্থা নিতেই পারেন। সেক্ষেত্রে বিরতি নিজের তৈরি হোক বা অন্যের- ফলাফলটা ইতিবাচকই আসবে। তো, আপনি কি মনে করছেন এই ব্যাপারে?