রহস্যপ্রেমীদের অভিজ্ঞতার ঝুলি খানিকটা ভারি করার জন্য ঘুরে আসতে পারেন আঠারো শতকের এক নিষ্ঠুর খুনের সাক্ষী লিজি বোর্ডেন হাউজ থেকে। বর্তমানে রাত্রিযাপনের সুব্যবস্থা রয়েছে এখানে। অনেক সাহসী মানুষই আসেন এখানে শত বছর পুরোনো সেই খুনের রহস্যের কিনারা করতে। চলুন জেনে নেয়া যাক কী ঘটেছিল এখানে, যা জায়গাটিকে আজও রহস্যের কালো ছায়ায় ঢেকে রেখেছে।
আঠারো শতকের শেষের দিকের ঘটনা এটি, ঘটনাস্থল সুদূর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত ফল রিভার শহর। ৯২ সেকেন্ড স্ট্রীটের বোর্ডেন হাউজে দুই কন্যা লিজি ও এমাকে নিয়ে বসবাস করতেন অ্যান্ড্রু এবং অ্যাবি বোর্ডেন (অ্যান্ড্রুর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী) দম্পতি। অ্যান্ড্রু ছিলেন শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং সমাজে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ৭০ বছর বয়সে তিনি ফল রিভার শহরের সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সকলের সাথে তার খুব একটা সদ্ভাব ছিল না। ব্যবসায় উন্নতি করতে গিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপী অনেক শত্রুরও উদয় হয়েছিল। এভাবেই দিন কাটছিল বোর্ডেন দম্পতির।
১৮৯২ সালের ৪ আগস্ট, অন্যান্য দিনের মতোই শুরু হয়েছিল বোর্ডেন দম্পতির দিনটি। ব্যতিক্রম ছিল এটুকুই যে অ্যান্ড্রুর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ভাই জন জে ব্যক্তিগত ব্যবসার কাজে এবং সবার সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রায়ই আসতেন, তিনি গেল রাতে এসেছেন। অ্যান্ড্রুর ছোট মেয়ে এমাও সেদিন বাড়িতে ছিল না, সে কাছেই তার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। প্রতিদিনের মতো সকালে বাড়ির কাজের মেয়ে ব্রিজেট এসে নাশতা পরিবেশন করে গেল এবং তা দিয়ে বোর্ডেন দম্পতি ও জন একসাথে তাদের সকালের নাশতা সারল। এরপর জন তার ব্যবসার কাজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। বাড়িতে রইল বোর্ডেন দম্পতি, আরেক মেয়ে লিজি ও কাজের মেয়ে ব্রিজেট।
এই বাড়িতে এক অদ্ভুত রকমের নিয়ম ছিল- সবাই সবার ঘরের দরজা সবসময় আটকে রাখত। জন চলে যাওয়ার পর অ্যান্ড্রু তার ঘরের দরজা আটকে দেয় এবং অ্যাবি কিছু কাজের জন্য উপরের তলায় চলে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যু পরবর্তী ব্রিজেটের বয়ান অনুযায়ী খুনের দুদিন আগে রাতে বোর্ডেন দম্পতি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দুজনই সে রাতে প্রচুর বমি করেছিলেন। তখন এটিকে ফুড পয়জনিং বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, যদিও বাড়ির অন্য কেউ সেই দিন বাড়ির ওই একই খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়নি। খুনের পরে আজ অবধি জানা যায়নি যে আসলেই সেদিন তাদের ফুড পয়জনিং হয়েছিল নাকি খুনের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল সে ঘটনা।
তখনও দুপুর হয়নি, কিন্তু প্রচন্ড গরম পড়ে সেদিন। বোর্ডেন দম্পতি হয়তো কখনো কল্পনাও করতে পারেননি যে তাদের জীবন প্রদীপের শিখা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চিরদিনের জন্য নিভে যাবে। সোফায় শায়িত অবস্থায় অ্যান্ড্রুর লাশ এবং উপরের তলায় অ্যাবির রক্তাক্ত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। দুজনের শরীরেই ছিল কুঠারের প্রায় ডজনখানেক আঘাতের চিহ্ন, তাদের মাথা হাতুড়ি বা কুঠার জাতীয় কিছু দিয়ে একদম থেঁতলে দেয়া হয়েছিল। এমন নিষ্ঠুরভাবে খুনের ঘটনা পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
খুনের কারণ হিসেবে দুটি যুক্তিকে দাঁড় করানো হয়। প্রথমত, লিজির তার সৎ মায়ের প্রতি বিদ্বেষী আচরণ এবং দ্বিতীয়ত, অ্যান্ড্রুর ব্যবসাগত শত্রুতা। কিন্তু পুলিশের সন্দেহের তালিকায় সর্বপ্রথম যে নামটি আসে তা হলো ‘লিজি’, কারণ বাড়ির কাজের মেয়ে ব্রিজেট বাদে একমাত্র সে-ই তখন উপস্থিত ছিল বাড়িতে। লিজিকে জোড়া খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
বোর্ডেন পরিবারের সামাজিক অবস্থান এবং খ্যাতির কারণে এই খুনের ঘটনা নিয়ে সকলের চরম আগ্রহ ছিল। আর তাই সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন করার তাগিদে বিচারকাজ ফল রিভারে অনুষ্ঠিত না হয়ে পাশের অন্য একটি শহর নিউ বেডফোর্ডে শুরু হয়। লিজির পক্ষের উকিল যথাযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করে আদালতে। বিচারকাজ চলাকালীন মাত্র ৯০ মিনিটের মাথায় আদালত সকল প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে লিজিকে নির্দোষ ঘোষণা করে এবং মুক্তি দেয়।
লিজি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও এলাকাবাসী তাদেরকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। অতঃপর লিজি ও তার বোন বোর্ডেন হাউজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং কিছু দূরে ‘দ্য হিল’ নামে নতুন একটি বাড়িতে ওঠে। ফল রিভার শহরবাসী আর কখনোই লিজিকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেনি, প্রত্যাখ্যাত হিসেবেই সে তার বাকি জীবনটা কাটিয়েছে খুনীর পরিচয়ে।
অনেকে বলে থাকেন, লিজিই তার সৎ মাকে খুন করেছিল এবং তা দেখে ফেলায় সে তার বাবাকেও খুন করে। আবার অনেকে বলে, সেদিন নাকি বোর্ডেন হাউজের পেছন দিক দিয়ে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেছিল। সন্দেহের মাত্রাটা যদিও ক্ষীণ, তবুও বাড়ির কাজের মেয়েকেও অনেকে খুনী মনে করে থাকেন। কারণ খুনের পর ওই রাতে ব্রিজেট বাড়িতে ছিল না এবং একদিন পরে বাড়িতে ফিরে এসেছিল। কিছুক্ষণ থাকার পর আবার বেরিয়ে যায়, আর কোনোদিন সে ফিরে আসে নি।অ্যান্ড্রুর খুনের আগের দিন বিকেলে হঠাৎ করে কিছু না জানিয়ে জনের আসাটাকেও অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। আসল খুনী কে, তা আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত রয়ে গেছে। অজানা রয়ে গেছে সেই মানুষটিকে, যার মনের প্রতিহিংসার হিংস্রতায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছিল বোর্ডেন দম্পতিকে।
১৯২৭ সালের ১ জুন লিজি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে সে ফল রিভার অ্যানিমেল রেস্কিউ লিগকে ৩০,০০০ ডলার, তার বাবার কবরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০০ ডলার এবং তার কাছের বন্ধু-বান্ধব ও কিছু আত্মীয়স্বজনকে ৬,০০০ ডলার দান করে যায়।
১৯৯৬ সালে মার্থা ম্যাজিন লিজি বোর্ডেন হাউজের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন ‘লিজি বোর্ডেন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট মিউজিয়াম’। মার্থা ম্যাজিনের দাদা ১৯৪৮ সালের ৪ আগস্ট এই বাড়িটিকে কিনেছিলেন এবং মার্থা সেই সূত্রেই বাড়িটি পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি রহস্যপ্রেমীদের থাকার সুব্যবস্থা করেছেন এখানে। কেউ চাইলেই সেই নিষ্ঠুর রহস্য ঘেরা খুনের ঘটনাস্থলে রাত কাটাতে পারবে।
মার্থা ম্যাজিন বলেন, এখানে তুর্কি, রাশিয়া, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর পরিদর্শক আসে। লিজি বোর্ডেন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট মিউজিয়ামে সর্বমোট ৮টি ঘর রয়েছে। তিনি সংস্করণ করে নতুন কিছু যোগ করেছেন এখানে। যেমন অ্যান্ড্রু যেখানে খুন হয়েছিলেন সেখানে একটি ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের সোফা রেখেছেন, খাবার ঘরে লিজির ছবি এবং বোর্ডেন দম্পতির থেঁতলানো মাথার নকল খুলি রাখা হয়েছে। প্রবেশদ্বারে রাখা হয়েছে খুনের ভয়ংকর এক ছবি এবং খুনের সেই কথিত অস্ত্র।
প্রায়ই শোনা যায়, এখানে আসা অনেকেই ভূতুড়ে কিছু ঘটনার সম্মুখীন হন। আপনি যদি শুনে থাকেন যে, অনেকে মাঝরাতে ব্যাগপত্র গুছিয়ে এ জায়গা ছেড়ে চলেও গেছে- তাতে অবাক হবার কিছু নেই, এমনটা মাঝে মাঝেই ঘটে থাকে।
লিজি বোর্ডেন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট মিউজিয়ামের বর্তমান মালিক লি অ্যান উইলবার নিজেই শেয়ার করেছেন এক ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা। তার মতে,
“আমি যখন থেকে এর দায়িত্ব নিয়েছি, কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখেছি। প্রায়ই আমি উপরতলা থেকে মেঝেতে চিড় ধরলে যেমনটা আওয়াজ হয়, ঠিক সেরকম আওয়াজ শুনতে পাই। যদিও সেই সময় উপরতলায় কেউই নেই। মাঝে মাঝে দরজা-জানালাগুলো আপনা-আপনি খুলে যায় আবার বন্ধ হয়। এমনকি কখনো কখনো আমি হালকা ফুলের সুবাসের গন্ধও পাই, ঠিক যেমনটা মহিলাদের সুগন্ধির গন্ধ হয়ে থাকে।”
একজন মহিলা পরিদর্শক বলেছিলেন,
“আমি মাঝরাতে আয়নায় ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরিহিত একজনের অবয়ব দেখেছিলাম এবং একসময় অনুভব করলাম যে বিছানায় কেউ বসল, যদিও সেখানে কেউ ছিল না। কিছুক্ষণ পর ঘরের কিছু কিছু জিনিস একা একাই পড়ে যেতে থাকল।”
একজন বলেছিলেন যে,
“রাত তখন অনেক গভীর। হঠাৎ দরজাটা খুব জোরে জোরে খুলতে আর বন্ধ হতে থাকল, এভাবে প্রায় ২০ সেকেন্ড চলল। কিন্তু দরজার ওপাশে কেউ ছিল না।”
অপর আরেকজন বলছিলেন যে,
“আমি মাঝরাতে হঠাৎ করেই এক মহিলার কান্নার আওয়াজ পাই, যদিও সেদিন ওখানে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না।”
অলৌকিক ঘটনায় আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর খুনের ঘটনাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় লিজি বোর্ডেন বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট মিউজিয়ামে থাকতে আসা মানুষগুলোকে।
ফিচার ইমেজঃ www.thedailybeast.com